![মতিউরের ৮৬৬ শতক জমি ও চার ফ্ল্যাট জব্দের নির্দেশ মতিউরের ৮৬৬ শতক জমি ও চার ফ্ল্যাট জব্দের নির্দেশ](https://www.dailyjanakantha.com/media/imgAll/2024April/f3-2407041759.jpg)
বেনজীর ও মতিউর
বহুল আলোচিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমান ও সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক বেনজীরের দুর্নীতি বিষয়ে নড়েচড়ে বেসেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতোমধ্যে বৃহস্পতিবার মতিউর রহমানের ৮৬৬ শতক জমি ও ৪টি ফ্ল্যাট জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। একই দিন সাবেক আইজিপি বেনজীরের বান্দরবানে ২৫ একর জমি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে জেলা প্রশাসন। এ ছাড়া কাস্টমস কমিশনার এনামুলের সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এনবিআর সাবেক কর্মকর্তা মতিউর রহমানের ৮৬৬ শতক জমি ও ৪টি ফ্ল্যাট জব্দ করার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ জগলুল হোসেন এ আদেশ দেন। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পাবলিক প্রসিকিউটার (পিপি) মীর আহমেদ আলী সালাম এ তথ্য জানান।
পিপি মীর আহমেদ আলী জানান, ক্রোক হওয়া সম্পত্তির মধ্যে বরিশালের মুলাদী উপজেলায় মতিউরের নামে ১১৪ শতাংশ জমি, নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলায় মরজাল ইউনিয়নের মরজাল মৌজায় মতিউরের প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে ৫২২.৫২ শতাংশ জমি, তাদের ছেলে আহমেদ তৌফিক অর্ণবের নাম ২৭৫.৮৭৫ শতাংশ জমি ও মেয়ে ফারহানা রহমান ইপ্সিতার নামে ১০৬.৫৬ শতাংশ জমি।
এদিকে ঢাকার চারটি ফ্ল্যাটের মধ্যে মতিউরের স্ত্রী লায়লা কানিজের নামে বসুন্ধরায় একটি ফ্ল্যাট, দ্বিতীয় স্ত্রী শাম্মী আখতার শিভলীর নামে ঝিগাতলায় একটি ও বসুন্ধরা আবাসিকে একটি এবং ফারহানা রহমান ইপ্সিতার নামে বসুন্ধরা আবাসিকে একটি ফ্ল্যাট রয়েছে।
দুদকের উপপরিচালক ও অনুসন্ধান টিমের প্রধান মো. আনোয়ার হোসেন আবেদনে উল্লেখ করেন, নথি পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মো. মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে অবৈধ সম্পদ অর্জনসহ হুন্ডি ও আন্ডারইনভয়েসিং/ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচার করে শত শত কোটি টাকার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগ রয়েছে।
অনুসন্ধানকালে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যাচ্ছে যে, অভিযোগ সংশ্লিষ্ট মো. মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যরা তাদের মালিকানাধীন স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের চেষ্টা করছেন যা করতে পারলে এই অনুসন্ধানের ধারাবাহিকতায় মামলা রুজু, আদালতে চার্জশিট দাখিল, আদালত কর্তৃক বিচার শেষে সাজার অংশ হিসেবে অপরাধলব্ধ আয় হতে অর্জিত সম্পত্তি সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্তকরণসহ সব উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে।
তাই এই অনুসন্ধান শেষে মামলা রুজু ও মামলা তদন্ত সম্পন্ন করে আদালতে চার্জশিট দাখিলের পর আদালত কর্তৃক বিচার শেষে সরকারের অনুকূলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের সুবিধার্থে সুষ্ঠু অনুসন্ধান ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা একান্ত প্রয়োজন।
এর আগে গত ২৪ জুন মতিউর, তার প্রথম স্ত্রী লায়লা কানিজ লাকি ও প্রথম স্ত্রীর ছেলে আহমদ তৌফিকুর রহমানের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন ঢাকার আদালত।
এবার পবিত্র ঈদুল আজহার সময় এনবিআরের সদস্য মতিউর রহমানের দ্বিতীয় স্ত্রীর ঘরের ছেলে মুশফিকুর রহমান ১৫ লাখ টাকার ছাগল কিনতে গিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনায় আসেন। ছেলের বিলাসী জীবনযাপনের সূত্র ধরেই মতিউরের সম্পদের বিষয়টি আলোচনায় আসে।
এর পরই মতিউর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পদের তথ্য বেরিয়ে আসছে। এখন পর্যন্ত তার দুই স্ত্রী, সন্তান, ভাইবোনসহ স্বজনদের নামে ছয় জেলায় জমি, ফ্ল্যাট, শিল্পপ্রতিষ্ঠান, রিসোর্টসহ নানা সম্পত্তির খোঁজ পাওয়া গেছে। এর বাইরে পুঁজিবাজারেও তার বিপুল বিনিয়োগ রয়েছে।
এখন পর্যন্ত আলোচিত এই কর্মকর্তা ও তার স্বজনদের নামে থাকা ৬৫ বিঘা (২ হাজার ১৪৫ শতাংশ) জমি, ৮টি ফ্ল্যাট, ২টি রিসোর্ট ও পিকনিক স্পট এবং ২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্পত্তি তার প্রথম স্ত্রী লাকির নামে।
লাকির নামে প্রায় ২৮ বিঘা জমি ও ৫টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এর মধ্যে রাজধানীর মিরপুরে একটি ভবনেই রয়েছে চারটি ফ্ল্যাট। কলেজশিক্ষক লায়লা কানিজ লাকি বর্তমানে নরসিংদীর রায়পুরা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এবং জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণবিষয়ক সম্পাদক।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, এনবিআর কর্মকর্তা মতিউরের বিরুদ্ধে এর আগে চারবার দুর্নীতির অভিযোগ পায় দুদক। কিন্তু প্রতিবারই বিভিন্ন কৌশল আর প্রভাব খাটিয়ে দুর্নীতির দায় এড়িয়ে যেতে সক্ষম হন তিনি।
মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম দুদকে অভিযোগ আসে ২০০৪ সালে। সে সময় তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচারের। অভিযোগ আছে, হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা টাকা মতিউর তার প্রবাসী কোনো এক আত্মীয়ের মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে এনে তা রেমিটেন্স বাবদ দেখিয়ে দিয়েছিলেন ট্যাক্স ফাইলে। এরপর ২০০৮ সালে আবারও দুদকে অভিযোগ জমা পড়ে তার বিরুদ্ধে। এবার অভিযোগ বিলাসবহুল পণ্যের শুল্ক মাফ করিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে অবৈধভাবে অর্থ উপার্জন।
কিন্তু তদন্ত শুরু হতে না হতেই প্রভাবশালীদের চাপে তা ধামাচাপা পড়ে যায়। সেই যাত্রাও মতিউর বেঁচে যান। এরপর ২০১৩ ও ২০২১ সালে আরও দু’বার দুদকে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু সেবারও কৌশলী মতিউর অবৈধ সম্পদকে পারিবারিক ব্যবসা ও ঋণ দেখিয়ে প্রস্তুত করেন ট্যাক্স ফাইল। সবশেষ এবারের কোরবানি ঈদ উপলক্ষে সাদিক অ্যাগ্রো থেকে ১৫ লাখ টাকার এক ছাগল কিনে আলোচনায় চলে আসে তার ছেলে মুশফিকুর রহমান ইফাত। এর পরই বেরিয়ে আসে মতিউরের নানা অপকর্ম ও দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিশাল সম্পত্তি। পরিস্থিতি সামাল দিতে না পেরে ইতোমধ্যে গা-ঢাকা দিয়েছেন তিনি।
বান্দরবানে বেনজীরের ২৫ একর জমির রিসিভার নিয়োগ ॥ এবার আদালতে নির্দেশে বেনজীরের নামে পর্বত্য চট্রগ্রাম বান্দরবানের সুয়ালক ইউনিয়নের ২৫ একর জমির রিসিভার নিয়োগ করে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে জেলা প্রশাসন। বৃহস্পতিবার দুপুরে বান্দরবানের জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন ও তার নেতৃত্বাধীন একটি টিম বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের জমির ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।
উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নে এসব জমির অবস্থান। এ সময় বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের বিভিন্ন সম্পদ পরিদর্শন শেষে ২৫ একর জমিতে আদালতের আদেশ ছাড়া এই সম্পত্তি বিক্রয় বা হস্তান্তর করা যাবে না বলে বিশেষ বিজ্ঞপ্তি জারি করে সাইন বোর্ড স্থাপন করে দেয়।
জেলা প্রশাসক শাহ্ মোজাহিদ উদ্দিন সাংবাদিকদের জানান, বৃহস্পতিবার থেকে এই জমির রিসিভার নিয়োগ করা হয়েছে। একই সঙ্গে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এসএম মঞ্জুরুল হককে আহ্বায়ক করে একটি ৮ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি এখন থেকে এই বিষয়ে সার্বিক তদারকি করার পাশাপাশি সকল আয়-ব্যয়ের হিসেবে দুদকের মাধ্যমে আদালতে উপস্থাপন করা হবে।
এ সময় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) এস এম মঞ্জুরুল হক, সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা উম্মে হাবীবা মীরা, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বান্দরবানের উপপরিচালক এম এম শাহনেয়াজ, জেলা মৎস্য কর্মকর্তা অভিজিৎ শীল, বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আবদুর রহমানসহ জেলা প্রশাসন, উপজেলা প্রশাসন এবং এলাকাবাসী উপস্থিত ছিলেন।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বান্দরবান সদর উপজেলার সুয়ালক ইউনিয়নের মাঝেরপাড়া এলাকায় পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের প্রায় ২০ কোটি টাকার সম্পত্তি, বাগানবাড়ি, গরু ও মাছের খামার তত্ত্বাবধানে নিয়েছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসক বলেন, আদালতের নির্দেশনার পর বেনজীর আহমেদের সম্পত্তি তত্ত্বাবধানে নেওয়া হয়েছে। এসব সম্পত্তি থেকে যা আয় হবে তা সরকারের কোষাগারে জমা হবে।
কাস্টমস কমিশনার এনামুলের সম্পত্তি ক্রোক ॥ জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদকের করা মামলায় সিলেটের কাস্টমস, এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনার মোহাম্মদ এনামুল হকের স্থাবর সম্পত্তি ক্রোকের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। বৃহস্পতিবার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা দুদকের উপ-পরিচালক ফারজানা ইয়াসমিন তার সম্পত্তি ক্রোকের আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ মোহাম্মদ আসসামছ জগলুল হোসেনের আদালত এ আদেশ দেন। দুদকের আইনজীবী মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর এ তথ্য জানান।
আবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা ফারজানা ইয়াসমিন উল্লেখ করেন, ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে ৯ কোটি ৭৬ লাখ ৯৭ হাজার টাকা মূল্যের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আসামির বিরুদ্ধে দুদক আইন ২০০৪ এর ২৭(১) ধারায় মামলা দায়ের করা হয়। তদন্তকালে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়, আসামি তার মালিকানাধীন ও স্বার্থসংশিষ্ট স্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তরের চেষ্টা করছেন, যা করতে পারলে এ মামলার ধারাবাহিকতায় আদালতে চার্জশিট দাখিল, আদালত কর্তৃক বিচার শেষে সাজার অংশ হিসেবে অপরাধলব্ধ আয় থেকে অর্জিত সম্পত্তি সরকারের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করাসহ সব উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হবে। তাই মামলার তদন্ত সম্পন্ন করে আদালতে চার্জশিট দাখিলের পর আদালত কর্তৃক বিচার শেষে সরকারের অনুকূলে সম্পত্তি বাজেয়াপ্তের সুবিধার্থে তথা সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে স্থাবর সম্পত্তি ক্রোক করা একান্ত প্রয়োজন।