ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৫ জুলাই ২০২৪, ২০ আষাঢ় ১৪৩১

শিক্ষক-কর্মচারীদের কর্মবিরতি অব্যাহত

দ্বিতীয় দিনেও অচল ৩৫ পাবলিক ভার্সিটি

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ০০:৩৫, ৩ জুলাই ২০২৪

দ্বিতীয় দিনেও অচল ৩৫ পাবলিক ভার্সিটি

দ্বিতীয় দিনেও অচল ৩৫ পাবলিক ভার্সিটি

মঙ্গলবার সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচির প্রজ্ঞাপন প্রত্যাহারের দাবিতে টানা দ্বিতীয় দিনের মতো দেশের ৩৫ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালন করেছেন শিক্ষক-কর্মচারীরা। সকাল থেকে অবস্থান কর্মসূচি ও প্রতিবাদ সভার আয়োজন করা হয়। কর্মকর্তাদের মধ্যে গ্রুপিংয়ের জেরে আহতের ঘটনাও ঘটেছে। বন্ধ হয়েছে শত শত পরীক্ষা। হুমকিতে লাখো শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন। আর তাতেই কার্যত অচল হয়ে পড়েছে দেশের উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থা।
আমলাদের প্রতি ক্ষোভ কেন তা জানতে এই আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় অধ্যাপক জিনাত হুদা জনকণ্ঠকে বলেন, আমি ব্যক্তিগতভাবে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর বিষয়ে কোনো মন্তব্য করিনি। তবে একটি মন্ত্রণালয়ের কতিপয় কর্মকর্তা যে এই বিষয়ে জড়িত তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যে কারণে বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে তাদের ওপর ক্ষোভ প্রকাশ করা হচ্ছে।
নানাভাবে মানসিক নিপীড়ন করা হচ্ছে জানিয়ে এই অধ্যাপক বলেন, আমলাদের কত সুযোগ-সুবিধা। আমরা চাকরিজীবন শেষে একটি মোটা অঙ্কের টাকা পাই, যদিও এই টাকাটি অনেকের কাছে নস্যি। আর মাসে মাসে বেতন পাই। এ ছাড়া কিছু ছোটখাটো অ্যালাউন্স আছে। কিন্তু আমলাদের সুযোগ-সুবিধা তো বলে শেষ করা যাবে না। ২০১৫ সালে সরকারের পক্ষ থেকে সুপার গ্রেড চালু করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু আজ অবধি তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। এমনকি গবেষণার জন্য যে ভাতা ছিল সেটিও বন্ধ করা হয়েছে।
আন্দোলনে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে জবাব চাওয়া হলেও জবাব দিয়েছেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। আর এই আন্দোলনকে অযৌক্তিক বলে মন্তব্য করেছেন। এ বিষয়ে আন্দোলনকারীরা বলছেন, এটি দুঃখজনক। হাজারো শিক্ষক, চুলচেরা বিশ্লেষণ, গাণিতিক হিসাব ও যৌক্তিক আন্দোলনকে অযৌক্তিক বলা যেতে পারে না। তারা বলেন, অনেক ধরনের অপপ্রচার চলছে এ আন্দোলন নিয়ে। বলা হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে এ আন্দোলন করা হচ্ছে। মূলত, শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের জন্যেই এ আন্দোলন করছে। যা চলবে। আর, প্রত্যয় স্কিমের মাধ্যমে পুরো বাংলাদেশের শিক্ষকদেরই মূলত জিম্মি করা হচ্ছে।
দ্বিতীয় দিনও অচল ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ॥ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রিপোর্টার জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করলেও একাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে অংশ নিচ্ছেন না। তাদের কর্মবিরতির কারণে অচল হয়ে গেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মঙ্গলবার দুপুর ১২টা থেকে ১টা পর্যন্ত ঢাবির কলা অনুষদের মূল ফটকে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে। এ ছাড়া সকাল থেকে ঢাবির প্রশাসনিক ভবনের মূল ফটকে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবে বলে জানিয়েছে। 
ঢাবি সাদা দলের আহ্বায়ক অধ্যাপক লুৎফুর রহমান বলেন, এই পেনশন স্কিমটি শিক্ষকদের মান-সম্মানের ব্যাপার। যারা পেনশন স্কিমের পক্ষে কথা বলছেন তারা তাদের নিজস্ব অবস্থান বজায় রাখার জন্য এসব বলছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্ররা সবসময় আন্দোলন-সংগ্রামের মাধ্যমে এই জাতিকে দিক-নির্দেশনা দিয়েছে। তাই আমি মনে করি এই আন্দোলন শিক্ষার্থীদেরও আন্দোলন। 
অবস্থান কর্মসূচিতে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের মহাসচিব ও ঢাবি শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. নিজামুল হক ভুঁইয়া বলেন, ৩৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহারের দাবিতে একযোগে আন্দোলন চলছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। দাবির বিষয়ে আমরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ঘোষণা চাই। চলমান কর্মবিরতির কারণে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হচ্ছে, তা পরে বিশেষ ক্লাস নিয়ে পুষিয়ে দেওয়া হবে।
এদিকে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্তা সচিবদের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ঢাবি অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক মো. আব্দুল মোতালেব। তিনি বলেন, রাতের আঁধারে একটি কুচক্রী মহল এবং সচিবরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের পাঁয়তারা করছে। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর দিয়েই সচিবালয়ে অফিস করতে যায়। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর দিয়ে অফিসে যাওয়ার কোনো অধিকার তাদের নাই। প্রয়োজনে আমরা তাদের যাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দেব।
ববি-তে কর্মকর্তাদের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ॥ স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল জানান, সর্বজনীন পেনশন কর্মসূচির প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহারের দাবিতে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে (ববি) চলমান আন্দোলন কর্মসূচির দ্বিতীয় দিনে মঙ্গলবার বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে দুই অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। প্রশাসনিক ভবন সংলগ্ন এলাকায় এ সংঘর্ষে উভয় গ্রুপের কমপক্ষে ১০ জন আহত হয়েছেন।

তাদের মধ্যে চারজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয় কর্মকর্তাদের দুই গ্রুপের মধ্যে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তাদের একটি সূত্র জানিয়েছেন, অফিসার অ্যাসোসিয়েশনে সাবেক মেয়রপন্থিদের সংখ্যাধিক্য হলে বর্তমান মেয়র অনুসারীরা আরেকটি অফিসার অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তুললে দুই গ্রুপের মধ্যে রেষারেষি শুরু হয়। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি মো. বাতেন চৌধুরী জানান, যারা সরাসরি অফিসার ও যারা পদোন্নতি নিয়ে অফিসার হয়েছে তাদের মধ্যে মানববন্ধনে অংশ নেওয়া নিয়ে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।

এতে ডিরেক্ট অফিসার অ্যাসোসিয়েশনের বেশকিছু সদস্য আহত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাব বিভাগের কর্মকর্তা এসএম ইকবাল বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে পেনশন স্কিমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করেছিলাম। এ সময় হামলার ঘটনা ঘটেছে। আমাদের বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে উপপরিচালক আবুল হোসেনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
জবি ॥ জবি সংবাদদাতা জানান, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্তি বাতিলের দাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো লাগাতার কর্মবিরতি ও প্রতিবাদ সভা পালন করেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। প্রতিবাদ সভায় জবি কর্মচারী সমিতির সভাপতি মো. জামাল হোসাইন বলেন, আমাদের দাবি যদি না মানা হয়, অনতিবিলম্বে সবকিছু বন্ধ করে দিয়ে আন্দোলনে নামব। এই আন্দোলন চলছে, চলবে। দরকার হলে আমরা রাজপথে রক্ত দেব।
এ ছাড়া জবি কর্মকর্তা সমিতির সভাপতি মো. কাদের (কাজী মনির) বলেন, আমাদের দাবি যদি না মানা হয়, তাহলে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ অচল করে দেওয়া হবে। আমাদের সঙ্গে সকল বিশ্ববিদ্যালয় একাত্মতা ঘোষণা করেছে। আমরা আমাদের দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ঘরে ফিরে যাব না। একটা রেজাল্ট নিয়েই আমরা ফিরব।
চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয় ॥ সংবাদদাতা জানান, অনির্দিষ্টকালের জন্য ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি। এ কর্মসূচির সঙ্গে যোগ দিয়েছে চবি অফিসার সমিতি ও কর্মচারী ইউনিয়ন। ফলে কার্যত বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রমে অচলাবস্থা নেমে এসেছে। জানা যায়, ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের প্রথম বর্ষের ওরিয়েন্টেশন ক্লাস ৩০ জুন শুরু হওয়ার কথা থাকলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের চলমান কর্মবিরতির কারণে তা সম্ভব হয়নি।

আন্দোলনের ফলে স্থগিত করা হয়েছে ৭টি বিভাগের পরীক্ষা। বিভাগগুলো হলো- জিন প্রকৌশল ও জৈবপ্রযুক্তি বিভাগ, প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগ, পরিসংখ্যান বিভাগ, আরবি বিভাগ, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, সংস্কৃত বিভাগ এবং পালি বিভাগ। বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের আহ্বানে এর আগেও কয়েক দফায় অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করেছে চবি শিক্ষক সমিতি। তবে সে সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত পরীক্ষা ও দাপ্তরিক  কার্যক্রম চলমান ছিল।

কিন্তু এবার দাপ্তরিক কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় নিজেদের সার্টিফিকেট ওঠানোর মতো কাজগুলোও করতে পারছেন না অনেক শিক্ষার্থী। এ ছাড়া পরীক্ষা নেওয়া বন্ধ করে দেওয়ার কারণে সেশনজট সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। চবি শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এবিএম আবু নোমান বলেছেন, চলমান আন্দোলনের কারণে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন বিলম্বিত হবে না। করোনা-পরবর্তী সময়ের মতো অতিরিক্ত ক্লাস ও অন্যান্য উদ্যোগ গ্রহণ করে শিক্ষার্থীদের ঘাটতি পুষিয়ে দেওয়া হবে। 
বাকৃবি ॥ সংবাদদাতা জানান, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বাকৃবি) দ্বিতীয় দিনের মতো চলছে শিক্ষকদের সর্বাত্মক কর্মবিরতি। একইসঙ্গে বাকৃবির কর্মচারীরাও অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করছে, যার ফলে অনেকটা অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ে। মঙ্গলবার বেলা ১২টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের করিডরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন শিক্ষকরা। সকল ধরনের ক্লাস পরীক্ষা এবং কোনো প্রশাসনিক কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেননি শিক্ষক ও কর্মকর্তারা। এ সময় শিক্ষকেরা তাদের বক্তব্যে দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন।

শিক্ষকদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে বাকৃবির কর্মচারীরাও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন এবং অর্ধদিবস কোনো দাপ্তরিক কাজে যোগ দেননি। বাকৃবির শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলাম সরদারের সভাপতিত্বে এবং শিক্ষক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. তানভীর রহমানের সঞ্চালনায় এই কর্মসূচিতে প্রায় শতাধিক শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন।

×