ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ০১ জুলাই ২০২৪, ১৭ আষাঢ় ১৪৩১

চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম

দেশজুড়ে গ্যাস সংকট

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:১০, ২৮ জুন ২০২৪

দেশজুড়ে গ্যাস সংকট

.

ঘূর্ণিঝড়  রেমালে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এক মাস যাবৎ বন্ধ রয়েছে আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) একটি টার্মিনাল। গত ২৭ মে সাগরে ভাসতে থাকা ভাঙা একটি পন্টুনের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামিটের এই ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের (ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট বা এফএসআরইউ) ব্যালাস্ট ট্যাংক। এতে করে এই টার্মিনাল দিয়ে গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। এটি মেরামতের জন্য সিঙ্গাপুরে পাঠানো হলেও জুলাই মাসের ১৭ তারিখের আগে এটি ঠিক হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। টার্মিনাল বন্ধ থাকায় এর মধ্যে দুই কার্গো এলএনজি ফেরত পাঠানো হয়েছে। আরও একটি ফেরত পাঠানোর কথা ভাবা হচ্ছে। এতে চাহিদার চাইতে অন্তত  ৫শএমএমসিএফডি গ্যাস সরবরাহ পাওয়া যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে দেশজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে তীব্র গ্যাস সংকট।

শিল্প-কারখানা থেকে শুরু করে বাসা বাড়িতেও পাওয়া যাচ্ছে না প্রয়োজনীয় গ্যাসের চাপ। এমনকি গ্যাস সংকটে ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপাদনও। দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে লোডশেডিং। বিশেষ করে পল্লী অঞ্চলে লোডশেডিংয়ের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। পেট্রোবাংলা বলছে, এফএসআরইউটি মেরামত হয়ে দেশের উদ্দেশে রওনা দেবে জুলাই মাসের তারিখ। দেশের সীমানায় পৌঁছতে পৌঁছতে ১২ বা ১৩ তারিখ হতে পারে। এর পর এটি প্রতিস্থাপন শেষে পূর্ণাঙ্গরূপে পুনরায় উৎপাদনে ফিরতে আরও অন্তত দিনের প্রয়োজন। এতে করে আগামী মাসের ১৬ বা ১৭ তারিখের আগে গ্যাস পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এই সময়টায় গ্যাস সংকট কাটানোর বিকল্প কোনো উপায়ও নেই জ্বালানি বিভাগের কাছে।

আমদানি তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস তথা এলএনজির জন্য দেশে দুটি টার্মিনাল রয়েছে। এর একটি পরিচালনার দায়িত্বে বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের কোম্পানি সামিট গ্রুপ। অন্যটি মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি। জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দুটি টার্মিনালের প্রতিটির ধারণক্ষমতা লাখ ৩৮ হাজার ঘনমিটার। আর এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশন টার্মিনাল দুটির সম্মিলিত দৈনিক সক্ষমতা হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। স্থানীয় সরবরাহ এফএসআরইউ দুটি থেকে পূর্ণ সক্ষমতায় এলএনজি সরবরাহের পরও জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের চাহিদার তুলনায় ঘাটতি থাকে দৈনিক প্রায় হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। পেট্রোবাংলা বলছে, সামিটের এলএনজি টার্মিনালটি বন্ধ থাকায় এখন এক্সিলারেটের টার্মিনাল দিয়ে সরবরাহ হচ্ছে মাত্র ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। অভ্যন্তরীণ কূপগুলো থেকে পাওয়া যাচ্ছে আরও ২০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এর বিপরীতে চাহিদা রয়েছে অন্তত হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের। এতে করে প্রতিদিনই ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের ঘাটতি থাকছেই জানিয়ে পেট্রোবাংলার পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মাইনস) মো. কামরুজ্জামান খান জনকণ্ঠকে বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত এফএসআরইউটি বর্তমানে সিঙ্গাপুরে রয়েছে মেরামতের জন্য। জুলাইয়ের মাঝামাঝি সময়ে এটি ঠিক হয়ে ফেরত আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এই সময়টায় গ্যাস সংকট মেটাতে আপনাদের পরিকল্পনা কি এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, গ্যাস পাওয়া গেলেও তো সংকট মেটানো সম্ভব না। সংকট থাকবেই।

এদিকে গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাসাবাড়ি, সিএনজি স্টেশন শিল্প-কারখানায় গ্যাসের চাপ কমে গেছে। জনজীবনে নেমে এসেছে দুর্ভোগ। রাজধানীর অনেক এলাকায় বাসবাড়িতে গ্যাস নেই। বাধ্য হয়ে নগরবাসীকে বৈদ্যুতিক চুলা লাকড়ি জ্বালিয়ে রান্নার কাজ সারতে হচ্ছে। নগরীর ফিলিং স্টেশনগুলোতেও যানবাহনের দীর্ঘ লাইন লেগে আছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে গ্যাস পাচ্ছে না যানবাহনগুলো।

শুক্রবার সরেজমিন  দেখা যায়, রাজধানীর মগবাজারে আনুদীপ ফিলিং স্টেশনের সামনে থেকে গাড়ির দীর্ঘ লাইন হলি ফ্যামিলি হাসপাতাল ছাড়িয়ে নৌ বাহিনীর গলি পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছেছে। বগুড়া থেকে ঢাকায় রোগী নিয়ে আসা অ্যাম্বুলেন্স চালক জামাল উদ্দিন বলেন, ‘সকাল ৮টার দিকে ঢাকা মেডিক্যালে রোগী নামাইয়া দিছি। তার পর থেকেই এখানে এসে গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। এত বড় লাইন কখন গ্যাস পাব আর কখন বগুড়ার উদ্দেশে রওনা দিতে পারব আল্লাহ জানেন।একই লাইনে গ্যাসের জন্য দাঁড়ানো সিএনজি অটোরিক্সা চালক রানা মিয়া বলেন, সিরিয়াল দিয়েছি তিন ঘণ্টা আগে। এখনো গ্যাস পাইনি। গ্যাস থাকলেও প্রেসার নেই। ৬০০ টাকার গ্যাস নিয়ে গাড়ি চালাচ্ছি মাত্র ৩০ কিলোমিটার। এভাবে কিভাবে পোষাবে? একটু গ্যাস কোথায় পাই তার জন্য এক স্টেশন থেকে অন্য স্টেশনে ঘুরতাছি? গাড়িচালক মালিকরা জানান, চলতি মাসের শুরু থেকেই গ্যাস না পেয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তাদের অপেক্ষা করতে হচ্ছে রিফুয়েলিং স্টেশনগুলোতে।

গ্যাস সংকটের কারণে রাজধানীর সড়কগুলোতে কমে গেছে সিএনজিচালিত অটোরিক্সার চলাচলও। সিএনজি  স্টেশন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশেনের সাধারণ সম্পাদক ফারহান নূর সাংবাদিকদের বলেন, ‘যেখানে একটি সিএনজি স্টেশনের গ্যাস চাপ লাগে ১৫ থেকে ১৭ পিএসআই সেখানে এখন চাপ থাকছে মাত্র থেকে পিএসআই। যার কারণে যানবাহনে ৫০-৬০ টাকার বেশি গ্যাস ঢুকছে না। তাতেও দীর্ঘ সময় লাগছে। এই অবস্থায় বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে সিএনজি স্টেশনগুলো।

একই অবস্থা দেশের শিল্প কারখানাগুলোতেও। সংশ্লিষ্টরা জানান, গ্যাস সঞ্চালন লাইন থেকে দূরবর্তী শিল্পকারখানাগুলোতে গ্যাসের চাপ থাকে না। বিশেষ করে গাজীপুর, কোনাবাড়ি, কাশিমপুরসহ এসব এলাকায় গ্যাসের চাপ অনেক কমে গেছে। একইভাবে পাইপলাইন থেকে রাজধানীর সিএনজি স্টেশনগুলো অনেক দূরে অবস্থিত হওয়ায় সেখানে গ্যাস আসতে আসতে চাপ থাকে না। তবে সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে পোশাক শিল্প-কারখানার মালিকদের। বিজিএমইএ এর সাবেক সভাপতি সাবেক সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমাদের বেশিরভাগ কারখানাতেই চাহিদামাফিক গ্যাসের চাপ পাওয়া যাচ্ছে না। আগের বছরগুলোতে যেমনটি দেখা যেতো শীত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পাইপলাইনে গ্যাসের চাপ কমতো। কিন্তু এবার এফএসআরইউ বন্ধ থাকার কারণে এখনই সংকট তৈরি হয়ে গেছে। যদি রকমটি চলতে থাকে তা হলে তো গার্মেন্টস মালিকদের পথে বসে যেতে হবে। এমনিতেই করোনা, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, সম্প্রতি আবার যোগ হওয়া ফিলিস্তিনি-ইসরাইল সংকটের কারণে বিশ্ব অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা। এখন টিকে থাকতে হলে বায়ারদের অর্ডার নিয়মিত সরবরাহ করতে না পারলে বিরাট অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়তে হবে।

গত বছরের অক্টোবর থেকেই নিজের কারখানায় গ্যাসের প্রেসার প্রায় দিনই জিরো থাকে জানিয়ে বিকেএমইএ এর সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমার কারখানাটা পুরনো হওয়ায় মেশিনগুলোতে ফার্নেস অয়েলের ব্যবহার করার সুযোগ রয়েছে। জরুরি কাজ করি ফার্নেস অয়েল কিনে। কিন্তু এভাবে কতদিন চলবে?’ তিনি বলেন, ‘আমাদের বয়লারগুলো চালানোর জন্য প্রতি ঘনফুটে ১৫ পিএসআই গ্যাসের চাপ থাকা দরকার। কিন্তু অনেক কারখানায় চাপ কমে প্রতি ঘনফুটে থেকে পিএসআইতে দাঁড়িয়েছে। কোথাও কোথাও শূন্যে নেমেছে। একদিকে ডলার ক্রাইসিস অপরদিকে গ্যাস সংকট চলতে থাকলে সেক্টরে বড় ধরনের বিপর্যয়  নেমে আসবে।

সামিটের টার্মিনালটি বন্ধ হওয়ায় কিছুটা গ্যাস সংকট হচ্ছে স্বীকার করে বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। প্রকৃতির ওপর তো আমাদের কারও হাত নেই। আর এফএসআরইউ ঠিক করতে এই সময়টার প্রয়োজন। তাই এখন আমাদের ধৈর্য ধরার বদলে অন্য কোনো বিকল্প নেই।

এদিকে গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়া বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতেও বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। যার কারণে ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ উৎপান। এতে করে দেশের বিভিন্ন স্থানে দেখা দিয়েছে তীব্র লোডশেডিং। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দিনে দুই একবার স্বল্প সময়ের লোডশেডিং হলেও পল্লী অঞ্চলে অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে লোডশেডিংয়ের মাত্রা। সিলেট, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, বগুড়া, রাজশাহীসহ বড় বড় শহরগুলোর মানুষকেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকতে হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে ১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে জানিয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার জনকণ্ঠকে বলেন, ‘সামিটের টার্মিনালটি কবে উৎপাদনে আসতে পারবে ঠিক করে বলা যাচ্ছে না। এর কারণে আমাদের গ্যাস সরবরাহ অনেক কমে গেছে।  বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোতে ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাকি গ্যাস সিস্টেমে দেওয়া হচ্ছে। সেখান থেকে যারা নিতে পারছে তাদের সংকট নেই। আর যারা নিতে পারছে না তাদের সংকট চলছে।

টার্মিনাল নির্মাণ চুক্তি অনুযায়ী, প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর টার্মিনালের কারিগরি ত্রুটি মেরামত করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর কারণে এর আগে গত বছরের অক্টোবরে এক্সিলারেটের টার্মিনালটিও রক্ষণাবেক্ষণে যায়। তখনও দেশজুড়ে তৈরি হয় তীব্র গ্যাস সংকট।

এমন সংকট থেকে বাঁচতে আমদানি নির্ভরতা কমানোর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের। জ্বালানি বিশেষজ্ঞ . তামিম জনকণ্ঠকে বলেন, এখন কাতারের এলএনজির দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ চীন নিয়ে যাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য সংকটের কারণে কাতার থেকে এলএনজি পাওয়াটা বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। তাই বর্তমান সংকট থেকে শিক্ষা নিয়ে এসবের বাইরে আমদানির দিকে না তাকিয়ে পেট্রোবাংলাকে দেশীয় গ্যাস উৎপাদানের সক্ষমতা বাড়াতে হবে।

তবে এলএনজি আমদানির পাশাপাশি সরকার দেশীয় উৎস থেকে গ্যাস উত্তোলনের নানা পরিকল্পনা চূড়ান্ত করেছে সরকার। পেট্রোবাংলা বলছে, ২০২৫ সালের মধ্যে মোট ৪৬টি কূপ খনন, উন্নয়ন ওয়ার্কওভার সম্পন্ন করা হবে। ৪৬টি কূপের মধ্যে রাশিয়ান কোম্পানি গ্যাজপ্রম ২টি, বাপেক্স ১টি কূপ খনন এবং বিজিএফসিএল ১টি ওয়ার্কওভার সম্পন্ন করেছে। ২০২৪ সালের মধ্যে বাপেক্সের রিগগুলোর শতভাগ ব্যবহার নিশ্চিত করা হবে। এর মধ্যে ৩টি অনুসন্ধান, ৫টি উন্নয়ন ১০টি ওয়ার্কওভার কূপ রয়েছে। বাকি কূপগুলোর মধ্যে ১৬-১৮টি বিদেশি সংস্থা, যাদের বাংলাদেশে খননের অভিজ্ঞতা রিগ আছে, তাদের দিয়ে খনন করা হবে।

×