ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ৩০ জুন ২০২৪, ১৬ আষাঢ় ১৪৩১

মাদক, খুনাখুনি, সংঘর্ষ, মোবাইল, সমকামিতা সবই চলে

কারা নিরাপত্তা ভঙ্গুর

আজাদ সুলায়মান

প্রকাশিত: ০০:০১, ২৮ জুন ২০২৪

কারা নিরাপত্তা ভঙ্গুর

ছাদ ফুটো করে কাপড় দিয়ে বানানো রশি বেয়ে এভাবে নিচে নেমে পালায় ৪ আসামি

দেশের কারাগারগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা ভঙ্গুর। বাইরে থেকে দেখতে খুব দুর্ভেদ্য মনে হলেও ভেতরে সব নড়বড়ে। এ যেন বজ্র আঁটুনি ফস্কা গেরো। কারাগার থেকে বন্দি পালানোর ঘটনা ঘটলেই সামনে আসে দুর্বল নিরাপত্তার কথা। টাকার বিনিময়ে এখানে মাদক, নারী, মোবাইল ও সমকামিতার সুবিধাসহ সব ধরনের আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করে সুযোগ নেয় অনেকে। পদে পদে অনিয়মে ভরা কারাগারগুলোতে পুরনো কয়েদিরা নতুন কয়েদিদের ওপর নির্যাতন চালায়।

দাগি আসামি ও ভিআইপিসহ শীর্ষ সন্ত্রাসীদের রাজত্ব চলে সেখানে। দিনের পর দিন অসুস্থ সেজে হাসপাতালে থেকে স্বাভাবিক জীবন যাপনেরও রয়েছে ঢের অভিযোগ। সবচেয়ে বড় অভিযোগ- কারাগারগুলোর ত্রুটিপূর্ণ নিরাপত্তায় মাদকের রমরমা বাণিজ্যের কারণেই বগুড়ার মতো ঘটনা ঘটছে। 
জানা গেছে, বছর দুয়েক আগে কাশিমপুর কারাগার থেকে দুই কারাবন্দি পালানোর ঘটনায় কারা অধিদপ্তর থেকে ৮টি বিশেষ নির্দেশনা ছিল। একই ইস্যুতে হাইকোর্টেরও আটদফা দিক নির্দেশনা ছিল। কিন্তু কোনো নির্দেশনাই আমলে নেওয়া হয়নি। কেন্দ্রীয় কারা প্রশাসন ও হাইকোর্টের রায় থাকার পরও দেশের কারাগারগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় কর্তৃপক্ষ এখনো উদাসীন ও গাফিলতির পরিচয় দিচ্ছে। তার সর্বশেষ উদাহরণ বগুড়া কারাগারের ছাদে ছিদ্র তৈরি করে বন্দি পালানোর ঘটনা।

দেশে তোলপাড় সৃষ্টি করা এ ঘটনার তদন্ত চলছে বেশ জোরেশোরেই। যদিও এরই মধ্যে বগুড়া জেলা প্রশাসন ও কারা প্রশাসন এর দায় চাপাচ্ছেন ব্রিটিশ আমলের তৈরি পুরানোর জরাজীর্ণ ভবনের ওপর। বন্দি পালানোর ঘটনায় এখন নতুন করে আবারও চিহ্নিত করা হচ্ছে ঝুঁকিপূর্ণ ও অতিঝুঁকিপূর্ণ কারাগারগুলো। কারা অধিদপ্তর জানিয়েছে, বগুড়ার মতোই আরও পুরনো ও ঝুঁকিপূর্ণ হচ্ছে কুমিল্লা কারাগার। এ বিষয়ে কারা অধিদপ্তর সূত্র জানিয়েছে, ব্রিটিশ আমলের তৈরি সবগুলো কারাগারই বেশ ঝুঁকিপূর্ণ।

বিশেষ করে এগুলোর ছাদ তৈরি করা হয়েছে, রডবিহীন। যেটা ফুটো করে, ছিদ্র করে একজন প্রাপ্তবয়স্ক কারাবন্দি বেরিয়ে যেতে সক্ষম। কারাকর্তৃপক্ষও এখন যুক্তি দেখাচ্ছে- ব্রিটিশ আমলের দুর্বল ও সংস্কারহীন ভবনের কারণেই এমন সুযোগ পাচ্ছেন আসামিরা। বগুড়ার ঘটনার পরপরই সারা দেশের পুরোনো ভবন থাকা কারাগারগুলোতে সতর্কবার্তা দিয়েছে কারা অধিদপ্তর।
সর্বশেষ বগুড়ায় কনডেম সেলের ভবনের ছাদ ফুটো করে চার বন্দির পালানোর পর কারাগারের নিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতাই স্পষ্ট হয়েছে। অথচ কারাগার হলো সংশোধনাগারের পাশাপাশি সর্বোচ্চ নিরাপত্তার জায়গা। কারাগার থেকে আসামি পালানো নতুন কিছু নয়। আগেও এমন ঘটনা অনেকবার ঘটেছে। কিন্তু কারাগারের নিরাপত্তা নিñিদ্র হয়নি। নিরাপত্তাঝুঁকির বিষয়ে আদালতের নির্দেশনাও কাজে আসছে না। শুধু দুর্নীতি অনিয়ম অরাজকতার দরুন বগুড়ার মতো কা- ঘটেছে। অভিযোগ উঠেছে- প্রতি রাতে যেভাবে কারাবন্দিদের গতিবিধি নজরদারি ও তদারকরি করার কথা- সেভাবে দায়িত্ব পালন করেননি বগুড়া কারাগারের জেল সুপার ও জেলার।

কনডেমের চারজন এটা দীর্ঘদিন খেয়াল করার পরই সুযোগটা নিয়েছে। এ বিষয়ে অবসরপ্রাপ্ত এক কারা মহাপরিদর্শক জানিয়েছেন, এক সময় জ্যৈষ্ঠ, দক্ষ ও অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের কেন্দ্রীয় কারাগারগুলোর দায়িত্ব দেওয়া হতো। যাতে অন্যত্র কিছু ঘটলে তারা রেসকিউ করতে পারেন। কিন্তু এখন এ রেওয়াজ নেই। অযোগ্য দুর্নীতিবাজ ও অনভিজ্ঞরাও কেন্দ্রীয় কারাগারের পদায়ন পাচ্ছে। বগুড়া কারাগারের জেলার ফরিদুর রহমান রুবেল ও জেল সুপার আনোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনে নানা অনিয়ম ও অনৈতিকতার অভিযোগ রয়েছে। দায়িত্ব পালনে তাদের চরম উদাসীনতা ও অবহেলায় ছাদ ছিদ্র করে বন্দি পালানোর মতো ঘটনা ঘটে।
এ সম্পর্কে সাবেক এক কারা কর্মকর্তা জানান, বগুড়ার ঘটনা এখন ব্রিটিশ আমলের তৈরি পুরনো অবকাঠামোগত ত্রুটির ওপর চাপানোর চেষ্টা চলছে। অথচ অত্যাধুনিক মানের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগার থেকেও বছর দুয়েক আগে বন্দি পালানোর মতো ঘটনা ঘটেছে। এক মাসের ব্যবধানে তখন নিরাপত্তা হেফাজত থেকে পালিয়েছেন দুই বন্দি। কাশিমপুর-২ কারাগার থেকে মই বেয়ে যাবজ্জীবন দ-প্রাপ্ত কয়েদি আবু বক্কর ছিদ্দিক পালিয়ে যান।

এ ঘটনায় সিনিয়র  জেল সুপার জাহানারা বেগমসহ ২০ জন কারা সদস্যের দায়িত্ব অবহেলার প্রমাণ পায় তদন্ত কমিটি। এ ঘটনার এক মাসের মধ্যেই রাজধানীর মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মিন্টু মিয়া নামের এক বন্দি পালিয়ে যান। তবে পরদিনই তাকে পুনরায় আটক করা হয়েছে। এ ঘটনায় তিন কারারক্ষীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
কারাগার থেকে পালানোর মতো এমন ঘটনায় তখন তোলপাড় দেখা দেয় কারাপ্রশাসনে। এতে তৎকালীন আইজি প্রিজনস বিগ্রেডিয়ার জেনারেল এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশা স্বাক্ষরিত একটি চিঠিতে দেশের ৬৮টি কারাগারের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও কারা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়। চিঠিতে ৮টি করণীয় বিষয় উল্লেখ করে বলা হয়-কারা বিধি যথাযথভাবে অনুসরণপূর্বক নিয়মিত কেস টেবিল কার্যক্রম পরিচালনা করা, ফাইলে নিয়মিত অংশগ্রহণ, নৈশ পরিক্রমা, বন্দি দরবার সম্পন্ন করা, কারাগারে নিষিদ্ধ দ্রব্যের অনুপ্রবেশ বন্ধ করা, কারা অভ্যন্তরে গমনকারী পিআইইউয়ের সদস্য এবং সিভিল কর্মচারীসহ সবাইকে যথানিয়মে তল্লাশিকরণ এবং সিসিটিভি মনিটরিং ও অন্যান্য নিরাপত্তা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় সব কার্যক্রম যথাযথভাবে সম্পন্ন করে কারাগারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার জন্য সবাইকে নির্দেশ দেওয়া হলো।

কোনো কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীর দায়িত্ব পালনে ন্যূনতম ব্যত্যয় বা শৈথিল্যতার প্রমাণ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও হুঁশিয়ার করা হয় ওই চিঠিতে। চিঠিতে বলা হয়েছে-ইদানীং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, কোনো কোনো কারাগারে অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা, এমনকি বন্দি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে চরম প্রশাসনিক দুর্বলতার নামান্তর এবং মোটেই তা গ্রহণযোগ্য নয়। কারাগার একটি স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠান। বন্দি পলায়নসহ যে কোনো দুর্ঘটনা রোধকল্পে কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য যথাযথভাবে পালন করা আবশ্যক।

কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালনে সক্রিয় না হওয়ায় বন্দি পলায়নসহ বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটছে যা সুষ্ঠু কারা প্রশাসনের অন্তরায় এবং কারা বিভাগের ভাবমূর্তি ব্যাপকভাবে ক্ষুণœ হয়েছে। অতএব বন্দি পলায়নসহ যে  কোনো দুর্ঘটনা রোধপূর্বক কারা নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য সব কারা কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সর্বোচ্চ অধিক সতর্কতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করার জন্য নির্দেশ প্রদান করা হলো।
এ ছাড়া কারাগারের নিরাপত্তা নিয়ে বিচারপতি নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি আহমেদ সোহেলের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ দুই বছর আগে আট দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এর মধ্যে রয়েছে কারাগারের ভেতরে নিরাপত্তা, শান্তি ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা, বাইরে থেকে যাতে কারাগারে মাদকদ্রব্য ঢুকতে না পারে সে বিষয়েও কঠোরতা অবলম্বন।
কারাসূত্র জানিয়েছে, কাশিমপুর কারাগার থেকে বন্দি পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি দোষীদের দায়-দায়িত্ব ও বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনার পাশাপাশি কয়েকটি সুপারিশ করে। এর মধ্যে একই কারাগারে দীর্ঘদিন ধরে একই কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনের বিষয়টি জোর দিয়ে উল্লেখ করা হয়। একই কর্মকর্তা একই কারাগারে দীর্ঘদিন ধরে দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকলে তার ভেতরে দায়িত্ব পালনের প্রতি এক ধরনের  শৈথিল্যতা আসে। এ ছাড়া কর্মকর্তারা নানা অনিয়মে জড়িয়ে পড়েন।

এ কারণে জেলা কারাগারগুলোতে খুব দ্রুতই রদবল করার সিদ্বান্ত নেওয়া হয়। কিন্তু এ সব সিদ্বান্ত কখনোই বাস্তবায়ন হয়নি। কারা প্রশাসন ও হাইকোর্টের কঠোর নির্দেশনা থাকার পরও দেশের কারাগারগুলোর নিরাপত্তায় এখনো নড়বড়ে। কর্তৃপক্ষ এ সব নির্দেশনা আমলেই নেয়নি। কোনো পদক্ষেপই নেয়নি নিরাপত্তা নিশ্চিতে। আগের মতোই টাকার বিনিময়ে কারাগারে রমরমা মাদক বাণিজ্য, কারাগারের ভেতরে নারী পুরুষের মেলা মেশা, কারা রক্ষীর ওপর হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা অহরহই ঘটছে। কাশিমপুর কারাগারে থাকা যুবলীগ নেত্রী পাপিয়া কারারক্ষীদের সহায়তায় রাত গভীরে মাদকের আসর জমাত। এ নিয়ে তিনি বন্দিদের ওপর হামলা চালালে তাকে বদলি করা হয় কুমিল্লায়। গত সপ্তাহে তিনি জামিনে ছাড়া পান। 
এ সম্পর্কে কাশিমপুর কারাগারের একজন কর্মকর্তা বলেন, দেশের কারাগারগুলোর অভ্যন্তরের নিরাপত্তা কতো ভঙ্গুর- তার বড় উদাহরণ ডা. সাবরিনা। করোনার সময় প্রতারণার দায়ে তিনি স্বামীর সঙ্গে কারান্তরীণ হন। পরে তিনি সাজাপ্রাপ্তও হন। বছর খানেক আগে মুক্তি পেয়েই তিনি কারাভ্যন্তরের রাতের অন্ধকারে কিভাবে মাদক সেবন, যৌন হয়রানি ও অসামাজিক কার্যকলাপ চলে তার ভয়াবহ বর্ণনা দিলে সেগুলো ভাইরাল হয়। তিনি নিজেও সমকামিতার শিকার হওয়ার মতো ভয়াবহ ও দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে লিখে ফেলেন বই। তার এ সব অভিযোগ কারা কর্তৃপক্ষ অস্বীকারও করেনি।

কোনো প্রতিক্রিয়াও দেখায়নি। ডা. সাবরিনার মতো উচ্চশিক্ষিত ও সচেতন বন্দির যদি এই অবস্থা হয়- তা হলে সাধারণ কারাবন্দিদের অবস্থা তো আরও শোচনীয় ও নিরাপত্তাহীন। 
দেশের কারাগারগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা কতটা শোচনীয় তার সর্বশেষ প্রমাণ বগুড়া কারাগারের ছাদ ছিদ্র করে চার বন্দি পালানো। জানা গেছে, ওই চারজন দীর্ঘদিন ধরে রেকি করে আসছিল কারারক্ষীদের দায়িত্ব পালনে উদাসীনতা ও ফাঁকিবাজির। রাতে যারা পালাক্রমে ডিউটিতে থাকত, তারা প্রায়ই ঘুমাত। তাদের কজন আবার মাদকাসক্ত ছিল। পালিয়ে যাওয়া বন্দিদের কাছ থেকে তারা নিয়মিত সিগারেট ও মাদক নিত।

এভাবে সখ্যতা গড়ে ওঠায় এক পর্যায়ে ছাদ ছিদ্র করার মতো সুযোগ পায় তারা। বগুড়া কারাগারে অবাধে ফেনসিডিল ইয়াবা ও গাঁজার মতো মাদকের সহজলভ্যতার কথাও স্বীকার করেছে পালিয়ে যাওয়া বন্দিরা। তাদের কাছ থেকে উদ্ধার করা বিপুল পরিমাণ সিগারেটও কারাভ্যন্তরে অবাধে অবৈধ ব্যবসা বাণিজ্য করার দীর্ঘদিনের অভিযোগ প্রমাণ হয়। 
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে সারাদেশে ৬৮টি কারাগারের মধ্যে ১৩টি কেন্দ্রীয় কারাগার ও ৫৫টি জেলা কারাগার। এগুলের মধ্যে বগুড়ার মতো আরও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে- কুমিল্লা, ভোলা, খুলনা, রাজশাহী, খাগড়াছড়ি, গাইবান্ধা, বগুড়া, বরিশালসহ কমপক্ষে ২৩টি কারাগারকে। সম্প্রতি সারাদেশের জেলা প্রশাসকেরা কারাগারের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথা বলেন। তাদের উত্থাপিত বিষয়গুলো বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগে পাঠানো হয়। সেখানে সংস্কারহীন দুর্বল কারাগার ভবন ও এগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে আলোচনা হয়। 
এর আগে কাশিমপুর কারাগারে আলোচিত ইয়াবা সম্রাজ্ঞী পাপিয়া কিভাবে মাদক বাণিজ্য, বন্দি নির্যাতন করে চাঁদা আদায়সহ নানা ধরনের অনিয়ম অরাজকতা করেছেন সেটা এখনো জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে আছে। কারাগারের ভেতরেই মাদকের আস্তানা গড়ে তোলার পাশাপাশি বন্দি নির্যাতনেও তিনি নতুন রেকর্ড গড়ে তোলেন। রুনা নামের এক বন্দিকে মেরে গুরুতর জখম করায় তোলপাড় চলে। এ অপরাধে তাকে কাশিমপুর কারাগার থেকে কুমিল্লা কারাগারে পাঠানো হয। সেখানেও গিয়ে তিনি একই অপকর্মে লিপ্ত হন।
কাশিমপুর-১ কারাগারে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে বাইরের এক নারীর সঙ্গে এক বন্দির অন্তরঙ্গ সময় কাটানোর সুযোগ হয়। এ নিয়েও আলোচনার ঘূর্ণি ওঠে। হলমার্ক কেলেঙ্কারির হোতা তানভীর মাহমুদের ভায়রা ও হলমার্কের মহাব্যবস্থাপক তুষার আহমেদ কারাগারের ওয়ার্ডে রাজকীয় জীবন যাপন করেন। তার রুমে ল্যাপটপ, আইফোনসহ বিভিন্ন ধরনের বিনোদন উপকরণ রয়েছে। তিনি কারাগারে বসে ভিডিও কলে ব্যবসা পরিচালনা করেন। জেল সুপারের সঙ্গে সমঝোতা করে প্রায়ই তিনি দ্বিতীয় স্ত্রী আসমা শেখের সঙ্গে সময় কাটান।
একই অবস্থা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারেও। মুক্তি পাওয়া বেশ কজন বন্দি দৈনিক জনকণ্ঠকে জানান, কারারক্ষী আব্দুর রহমান পিঞ্জু ও আব্দুস সালাম রাব্বী নিয়মিত মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। তারা উভয়েই কারা অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় প্রশাসন দ্বারা বদলি ও নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় তারা খুবই বেপরোয়া এবং বন্দিদের জন্য আতংক। তারা কারাগারের চেইন অব কমান্ড অমান্য করে নিজের রাজত্ব গড়ে তুলেছেন। এত কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাঝেও কারাগারে মাদক ব্যবসার সিন্ডিকেট গড়ে তোলার অভিযোগে পিঞ্জুকে কারাগারের হাসপাতাল শাখায় বদলি করা হয়েছিল। কিন্তু কদিনের মাথায় তিনি কারা অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন মহলের আশীর্বাদে ফের আগের জায়গায় ফিরে আসতে সক্ষম হন। 
এখানকার নিরাপত্তা সম্পর্কে জানতে চাইলে জেল সুপার সুভাষ ঘোষ বলেন, আমরা সর্বোচ্চ সতর্কতায় আছি। এখানে এ ধরনের কিছু ঘটার সুযোগ নেই।
বরিশাল কারাগারের অবস্থা আরও ভয়াবহ। এখানে বন্দির হাতে বন্দি খুন হয়। গত ১৪ এপ্রিলে বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের (শেবাচিম) প্রিজন সেলে এক আসামিকে হত্যার ঘটনায় দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে তিন কারারক্ষীকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্ত কারারক্ষীরা হলেন- সহকারী প্রধান কারারক্ষী সুমন চন্দ্র দে, কারারক্ষী কামরুল আহসান ও আব্দুর রব। 
কারাগারগুলোর নিরাপত্তা ত্রুটি সম্পর্কে জানতে চাইলে অতিরিক্ত কারা মহাপরিদর্শক কর্নেল শেখ সুজাউর রহমান বগুড়ার উদাহরণ টেনে বলেন, ঢাকা থেকে এসে কারাগার পরিদর্শন করেছি। এটি ১৮৩৩ সালে নির্মিত কারাগার। এই সেলগুলোতে ১৪০ বছর ধরে বন্দিরা থাকেন। আসামিরা রাত ২টা থেকে সাড়ে ৩টার মধ্যে ঘটনাটি ঘটায়। তারা বিছানার চাদর ব্যবহার করে জেলখানার প্রাচীর টপকাতে সক্ষম হয়। বিষয়টি জানতে পারার পর কারাগার থেকে সব কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়। পরবর্তীতে বগুড়ার পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করে। আমাদের জানালে তাদের শনাক্ত করা হয়। প্রাথমিকভাবে কারাগারে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে।
উল্লেখ্য গত মঙ্গলবার গভীর রাতে বগুড়া কারাগারের ছাদ ছিদ্র করে পালিয়ে যায়-সাজাপ্রাপ্ত হলেন, কুড়িগ্রাম জেলার ভুরঙ্গামারী থানার দিয়াডাঙ্গা গ্রামের আজিজুল হকের ছেলে নজরুল ইসলাম ওরফে মজনু ওরফে মঞ্জু (৬০), নরসিংদী জেলার মাধবদী থানার ফজরকান্দি গ্রামের মৃত ইসরাফিলের ছেলে আমির হামজা ওরফে আমির হোসেন (৪১), বগুড়া কাহালু উপজেলার উলট্ট গ্রামের আব্দুল মান্নানের ছেলে জাকারিয়া (৩৪) এবং বগুড়া সদরের কুটিরবাড়ি গ্রামের ইসরাইল শেখের ছেলে ফরিদ শেখ (৩০)। আসামিরা নিজেদের বিছানার চাদর ছিঁড়ে দড়ি বানায়।

এরপর গামছার ভেতর শক্ত কিছু ভরে কৌশলে কারাগারের ছাদ ফুটো করে সেলের বাইরে বের হয়। আগে থেকে বানানো বিছানার চাদরের দড়ি দিয়ে কারাগার ভবন থেকে নিচে নামেন। এরপর ওই চারজন কারাগারের পূর্ব পাশে করতোয়া নদীর ওপর ছোট ব্রিজের নিচ দিয়ে পালিয়ে যান। ভোর ৪টা ১০ মিনিটের দিকে সদরবাড়ীর দারগা খোরশেদ আলম শহরের চেলোপাড়ায় করতোয়া নদীর পাড়ে চাষি বাজার থেকে চার জনকে গ্রেপ্তার করেন।

×