ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৯ জুন ২০২৪, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১

এসএসএফের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী

জনগণই আমার শক্তি তাদের থেকে যেন বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ি

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০০:০৯, ২৭ জুন ২০২৪

জনগণই আমার শক্তি তাদের থেকে যেন বিচ্ছিন্ন না হয়ে পড়ি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের ৩৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন

প্রধানমন্ত্রী যেন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে না পড়েন সেদিকে লক্ষ্য রাখতে স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হলে আর গুলি-বোমা লাগবে না, এমনিতেই শেষ হয়ে যাব। এরাই (জনগণ) আমার প্রাণ, শক্তি। এটুকু মনে রাখতে হবে। তিনি বলেন, একটি বিষয় আমি নিশ্চয়ই বলব, আমি রাজনীতি করি, আমার আর কোনো শক্তি নেই। শক্তি একমাত্র জনগণ। সেই জনগণের শক্তি নিয়েই আমি চলি। কাজেই জনবিচ্ছিন্ন যাতে না হয়ে যাই।

আমি জানি এটা কঠিন দায়িত্ব। তারপরও এদিকেও নজর রাখতে হবে যে, এই মানুষগুলোর জন্যই তো রাজনীতি করি। মানুষদের নিয়েই তো পথ চলা। আর যাদের নিয়েই দেশের মানুষের কাজ করি তাদের থেকে যেন কোনোমতে বিচ্ছিন্ন হয়ে না যাই।
বুধবার এসএসএফের ৩৮তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে তার কার্যালয়ের (পিএমও) শাপলা হলে আয়োজিত দরবারে প্রদত্ত ভাষণে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা মেজর জেনারেল (অব) তারিক আহমেদ সিদ্দিকী এবং প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এ সময় মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন। এসএসএফের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল এ কে এম নাজমুল হাসান অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন। 
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি সব সময় এসএসএফের সদস্যদের বলি এবং মাঝেমধ্যে রাগও করি। এই বিষয়গুলো একটু সংবেদনশীলতার সঙ্গে দেখা দরকার। কারণ তিনি যখন সরকারে ছিলেন না এই দেশের মানুষ এবং পার্টির লোক, তারাই তার পাশে ছিল।
তিনি এ সময় এক দরিদ্র রিক্সাওয়ালার উপার্জনের জমানো অর্থে তার নামে একখ- জমি কেনার এবং তার কাছে হস্তান্তর করতে চাওয়ার ঘটনা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন,  যেহেতু তাদের দু’বোনের ঢাকায় কোনো বাড়ি নেই এবং ধানমণ্ডির বাড়িটিও তারা দান করেছেন-সেজন্য সেই রিক্সাচালক এই পদক্ষেপ নেন।

তিনি বলেন, অনেকবার তাকে মানা করা হলেও সে শোনেনি। সেই রিক্সাওয়ালার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী সেই দলিলটা তার কাছে হস্তান্তর করতে চাইলে তিনি নিজে সেখানে গিয়ে তাদের বাড়ি  তৈরি করে তার স্ত্রীর হাতে দলিল দিয়ে বলেন- মনে করবেন এটা আমারই বাড়ি। এখন আপনারা থাকবেন। অন্যদিকে জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর খালেদা জিয়ার জন্য দুটি বাড়ি, গাড়ি, ক্যাশ টাকা- অনেক কিছু রেখে যান। 
জাতির পিতার কন্যা বলেন, এই সাধারণ মানুষগুলোর জন্যই আমার রাজনীতি, এদের ভাগ্য পরিবর্তন  ও জীবনমান উন্নত করাটাই আমার লক্ষ্য। কাজেই এই মানুষগুলোর থেকে আমি বিচ্ছিন্ন হতে পারি না। কারণ এরাই আমার চলার সব শক্তি জোগায়। এটা সকলকে মনে রাখার জন্য আমি অনুরোধ করছি।
বাঙালি জাতি যাতে বিশে^ মাথা উঁচু করে চলতে পারে সেদিকে লক্ষ্য রেখেই তার সরকার কাজ করে যাচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এসএসএফের প্রতিটি সদস্য সর্বক্ষণ সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে প্রশংসনীয় কর্মদক্ষতা প্রদর্শন করে আসছে এবং বাংলাদেশে আগত বিদেশীরাও তাদের নিরাপত্তা প্রদানের প্রশংসা করেছেন।
সরকারপ্রধান তার সরকারের বেকারত্বের হার ৩ ভাগে নামিয়ে আনা, সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি, কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে গ্রাম-গঞ্জে হাতের নাগালে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া, সামাজিক নিরাপত্তাবলয়ের কর্মসূচির মাধ্যমে সমাজের নি¤œস্তরের মানুষ ও হতদরিদ্রদের সাহায্য প্রদান, গৃহহীন-ভূমিহীন মানুষকে বিনামূল্যে ঘর-বাড়ি প্রদানসহ নানা কর্মসূচির মাধ্যমে হতদরিদ্র্যের হার ২৫ দশমিক ৫ ভাগ থেকে ৫ দশমিক ৬ ভাগে এবং দারিদ্র্যের হার ৪১ ভাগের বেশি থেকে ১৮ দশমিক ৭ ভাগে নামিয়ে আনার সাফল্য তুলে ধরেন। 
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দারিদ্র্যের হার ভবিষ্যতে আরও কমিয়ে আনার এবং অতিদারিদ্র্য একেবারে শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনার লক্ষ্য রয়েছে। ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ অতিমারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে সৃষ্ট বিশ^ অর্থনৈতিক মন্দা না এলে তার সরকারের প্রচেষ্টায় দারিদ্র্যের হার  আরও কমিয়ে আনা সম্ভব হতে পারত। তার সরকারে আসার পর বেতন-ভাতা বৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন এবং ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, যতক্ষণ আমার নিঃশ্বাস আছে, আমার এটাই চেষ্টা যে, বাংলাদেশের মানুষের জীবনটাকে যেন আরও উন্নত-সমৃদ্ধ করে যেতে পারি। বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে যাচ্ছে আমাদেরকেও সেভাবেই চলতে হবে।
গুলি, বোমা, গ্রেনেড হামলার শিকার হয়ে বারবার বেঁচে যাওয়া প্রধানমন্ত্রী বলেন, যারা তার নিরাপত্তায় নিয়োজিত থাকছেন তাদের জীনটাও ঝুঁকিতে পড়ছে। আল্লাহ আমাকে হয়ত একটা কাজ দিয়ে পাঠিয়েছেন। আমার সঙ্গে যারা কাজ করে এবং যারা আমার নিরাপত্তায় নিয়োজিত তাদের জন্য আমি চিন্তিত থাকি। কেননা যতবার আমার ওপর আক্রমণ হয়েছে, প্রতিবারই আমার কিছু না কিছু নেতাকর্মীকে জীবন দিতে হয়েছে।

তারা ‘মানববর্ম’ রচনা করে আমাকে গ্রেনেড হামলা থেকে রক্ষা করেছেন। কাজেই এসএসএফ যেহেতু আমার সব থেকে কাছে থাকে, আমি সব সময় চিন্তিত থাকি। আমি যখন নামাজ পড়ি তখন পরিবারের সদস্য, দেশবাসী এবং তার আশপাশে যারা থাকেন এবং নিরাপত্তায় এসএসএফসহ যারা নিয়োজিত থাকেন তাদের জন্যও দোয়া করি।

তার সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ঘটিয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ভবিষ্যতে আরও এগিয়ে যাবার জন্য ‘২০২১ থেকে ২০৪১’ প্রেক্ষিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি ভবিষ্যতে এই বদ্বীপকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে রক্ষা করতে ‘ডেল্টা পরিকল্পনা-২১০০’ প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে আজকে যে পরিবর্তনটা হয়েছে সেই পরিবর্তনের ধারা বজায় রেখেই আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। 
এসএসএফের জন্য যা যা করণীয় তার সরকার করবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৯৬ সালে সরকারে আসার পরই তিনি তাদের তেজগাঁওয়ে শূটিং প্র্যাকটিসের জায়গা করে দেন। এখন আধুনিক ও উন্নতমানের শূটিং রেঞ্জ তৈরি হচ্ছে। তাদের অফিসার্স মেস থেকে শুরু করে সবকিছুই কিন্তু ধীরে ধীরে তার হাতে গড়া। লোকবলও তিনিই বৃদ্ধি করেছেন। তিনি বলেন, গাড়ি থেকে শুরু করে আধুনিক সরঞ্জামাদি যা যা দরকার সবই কিন্তু আমরা ব্যবস্থা করে দিয়েছি। শুধু এসএসএফ নয় সকল প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নেই তার সরকার কাজ করেছে এমনকি শান্তিরক্ষায় নিয়োজিত শান্তিরক্ষীদের সুরক্ষায় যা যা দরকার তার ব্যবস্থাও করেছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি এসএসএফের সবাইকে বলব যে, অতিগুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গের নিরাপত্তা প্রদানে সবসময় পেশাগত দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি প্রত্যেকেই দৃঢ়তা, উন্নত শৃঙ্খলা, সততা, দায়িত্বশীলতা এবং মানবিক গুণাবলী নিয়েই নিজেদেরকে তৈরি করে অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে হবে। যেটা তারা করে যাচ্ছেন। তারপরও তিনি সবসময় এই কথাগুলো তাদের মাথায় রাখার আহবান জানান। কেননা নিজের ভেতর যদি দৃঢ়তা না থাকে, সততা না থাকে এবং নিরলসভাবে দায়িত্ব পালনের সেই কর্তব্যনিষ্ঠা না থাকে তাহলে সফলতা পাওয়া যায় না।
প্রধানমন্ত্রী এসএসএফের সকল সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যদের  জন্য দোয়া, আশীর্বাদ জানিয়ে আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে শৃঙ্খলা, আনুগত্য ও পেশাগত মান বিচারে এই বাহিনী হয়ে উঠুক একটি আদর্শ নিরাপত্তা বাহিনী।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, এসএসএফ এমন একটি সংগঠন যেখানে আমাদের সব বাহিনীরই প্রতিনিধি রয়েছে। পুলিশ ও অনসার বাহিনী থেকে শুরু করে নৌ, বিমান ও সেনাÑসব বাহিনীরই এটা সমন্বিত। একই সঙ্গে কাজ করার এটাও একটা অভিজ্ঞতা। যে অভিজ্ঞতা আমি মনে করি আগামী দিনেও আমাদের দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ করে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ এগুলোর বিরুদ্ধে আমাদের যে অভিযানের সাফল্য সেটাও ধরে রাখার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। নতুন যারা কাজ করতে আসেন তাদের মধ্যে এই অভিজ্ঞতাটা সঞ্চারিত হয় এবং আমি দেখেছি অত্যন্ত দায়িত্বশীলতার সঙ্গে প্রত্যেকেই স্ব স্ব দায়িত্ব পালন করে চলেছেন।

×