ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৯ জুন ২০২৪, ১৫ আষাঢ় ১৪৩১

প্রস্তাবিত বাজেটে কর-ভ্যাটে পরিবর্তন আনা হচ্ছে

বাজারে স্বস্তি আনার চিন্তা

এম শাহজাহান

প্রকাশিত: ০০:০৫, ২৭ জুন ২০২৪

বাজারে স্বস্তি আনার চিন্তা

বাজারে স্বস্তি আনার চিন্তা

প্রস্তাবিত ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ‘সুখী সমৃদ্ধ উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকারের’ বাজেট পাস হচ্ছে আগামী ৩০ জুন রবিবার। বাজেট পাসের আগে কর, ভ্যাট ও শুল্কজনিত বিষয়ে বেশকিছু সংশোধনী বা পরিবর্তন আনা হতে পারে। এই বাজেটে সংসদ সদস্যদের (এমপি) আমদানি করা গাড়ির ওপর শুল্ক আরোপের আহ্বান জানিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তবে শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর নাও হতে পারে। অর্থাৎ এমপিদের বিনাশুল্কে গাড়ি আমদানির সুযোগ বহাল থাকতে পারে।

কর অবকাশ সুবিধার পাশাপাশি কিছু শর্ত সাপেক্ষে ইকোনমিক জোন ও হাই-টেক পার্কের বিনিয়োগকারীদের ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানিতে আগের মতোই জিরো ডিউটি সুবিধা বহাল রাখতে পারে এনবিআর। বিদেশে টিউশন ফি ও ব্যবসা উন্নয়নে অর্থ পাঠাতে আর উৎসে কর দিতে হবে না। এ ছাড়া বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর জন্য কর অবকাশের সুবিধা বহাল থাকতে পারে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট সূত্র।

জানা গেছে, প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে বিদেশে টিউশন ফি, ব্যবসায়িক প্রচারের ব্যয় এবং আরও কিছু ক্ষেত্রে টাকা পাঠাতে উৎসে কর দিতে হবে না। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত ছাঁটাই প্রস্তাব উত্থাপনের মাধ্যমে এই বাজেট পাসের পর আগামী ১ জুলাই সোমবার থেকে শুরু হবে নতুন অর্থবছর। অর্থ বিল পাসের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রস্তাবিত বাজেটের ওপর বক্তব্য রাখবেন।

প্রস্তাবিত বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার বিষয়ে ইতোমধ্যে দেশে ব্যাপক বিতর্ক শুরু হওয়ায় এ বিষয়ে কিছুটা সংশোধনী আনা হতে পারে। ঢালাওভাবে সুযোগ না দিয়ে কিছু শর্তজুড়ে দিতে পারে এনবিআর। বিশেষ করে দুর্নীতি ও বা অনিয়ম করে যারা বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ অর্জন করে বিতর্কিত সমালোচিত হয়েছেন তাদের এই সুযোগ দেওয়া হবে কি না- সেই বিষয়ে নতুন করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হতে পারে।

এ ছাড়া নিত্যপণ্যের দাম স্বাভাবিক রাখতে আমদানিতে উৎসে কর পুরোপুরি প্রত্যাহারে বিষয়টি চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে। কর্মসংস্থান ও বিনিয়োগ উৎসাহিত করতে কর ও ভ্যাটে আরও কিছু ছাড় দেওয়া হতে পারে। এ ছাড়া  নতুন অর্থবছরে নিত্যপণ্যের দাম কমানোর ওপর সর্বোচ্চ জোর দেওয়া হয়েছে। 
বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যমতে, বর্তমান খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১০ শতাংশের ওপরে। এতে করে সমাজের পিছিয়ে পড়া ও সাধারণ মানুষের কষ্ট হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এ কারণে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, চিনি, মুরগি-মাছ-মাংসের উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিশেষ নজর দেওয়া হয়েছে। এসব পণ্যের আমদানিতে উৎসে কর অর্ধেক কমানো হয়েছে। চলতি বাজেটে নিত্যপণ্য আমদানিতে ১ শতাংশ উৎসে কর দিতে হয় ব্যবসায়ীদের।

প্রস্তাবিত বাজেটে এটি কমিয়ে অর্ধেক বা .৫০ শতাংশ করা হয়েছে। কিন্তু ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই থেকে ইতোমধ্যে নিত্যপণ্য আমদানিতে উৎসে কর পুরোপুরি প্রত্যাহার করার দাবি করা হয়েছে। সংগঠনটির পক্ষ থেকে চাল, ডাল, ভোজ্যতেল, গম, মসলাপাতি ও চিনিসহ ১৭টি অত্যাবশ্যকীয় নিত্যপণ্য আমদানিতে উৎসে কর পুরোপুরি প্রত্যাহারের দাবি করা হয়। এফবিসিসিআই মনে করে বাজারে নিত্যপণ্যের দাম কমাতে হলে এসব পণ্যের ওপর কোনো কর বা ভ্যাট থাকা উচিত নয়।

প্রস্তাবিত বাজেট পাসের আগে এ সংক্রান্ত ব্যবসায়ীদের দাবির বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও দ্রব্যমূল্য কমানোর বিষয়ে সর্বোচ্চ জোর দিয়েছেন। আশা করা হচ্ছে, খাদ্য ও নিত্যপণ্য আমদানিতে উৎসে কর পুরোপুরি প্রত্যাহার করা হতে পারে। এতে করে বাজারে স্বস্তি ফিরে আসবে। এ ছাড়া প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে ব্যবসায়ী-অব্যবসায়ী এমনকি জাতীয় সংসদে সরকার এবং বিরোধীদলীয় এমপিরাও এ বিষয়টি নিয়ে বির্তক করছেন।

যারা নিয়মিত কর দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য করেন তারা বলছেন, এই সুবিধা তাদের প্রতি এক ধরনের অবিচার। এটা হতে পারে না। তাই এই সুবিধা বাদ দেওয়া উচিত। এমনকি এ নিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ব্যাপক আলোচনা রয়েছে। বিশেষ করে অনেক সংসদ সদস্য কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। সম্প্রতি বেশকিছু উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তার অবৈধভাবে অর্জিত বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি অর্জনের অভিযোগ উঠেছে। এ নিয়ে কাজ করছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। 
এ অবস্থায় ঢালাওভাবে সুযোগ দেওয়া হলে যারা অবৈধভাবে বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন করেছেন তারা সুযোগ নিয়ে বেরিয়ে যাবেন। ফলে এ বিষয়টি নিয়ে নতুন করছে ভাবছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং অর্থ মন্ত্রণালয়। সরকারের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে অবশ্য স্পষ্ট করা হয়েছে, আয়কর সংক্রান্ত আইনের কিছু ধারা এমনভাবে সন্নিবেশিত করা হয়েছে, যাতে অনেক সময় বৈধভাবে অর্জিত সাদা অর্থ এবং সম্পদ অপ্রদর্শিত বা কালো হয়ে যাচ্ছে। এটা যাতে না হয়, সে জন্য ১৫ শতাংশ কর দিয়ে সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

কিন্তু কারও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়ে গেছে কিংবা আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে ফৌজদারি মামলা হয়েছে কিংবা দুদক বা অন্য কোনো সরকারি সংস্থা তদন্ত করছে সে ব্যক্তি এই সুযোগ নিতে পারবে না। সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সভাপতিত্বে প্রস্তাবিত বাজেট সংক্রান্ত প্রেস ব্রিফিংয়ে এনবিআর চেয়ারম্যান এ বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন। এদিকে, আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার সাত লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকা।

২০২৩-২৪ অর্থবছরের চেয়ে এবারের বাজেটের আকার বাড়ছে চার দশমিক ছয় শতাংশ। এটি দেশের ৫৩তম, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২৫তম ও অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর প্রথম বাজেট। বাজেটে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকছে পাঁচ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা। 
কর ভ্যাট ও শুল্কজনিত যেসব বিষয়ে পরিবর্তন আনা হবে ॥ প্রস্তাবিত বাজেট পাসের আগে কর, ভ্যাট ও শুল্কজনিত বেশকিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনা হতে পারে। এবারের সংসদে অনেক নতুন এমপি নির্বাচিত হয়ে এসেছেন। এদের কথা চিন্তা করে এমপিদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুবিধা বহাল রাখা হতে পারে। কেননা সংসদ সদস্যদের গাড়ি আমদানিতে বিদ্যমান আদেশ সংশোধনের কোনো উদ্যোগ এখনো পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। ফলে আগের মতো এবারও এমপিরা শুল্কমুক্ত কর সুবিধা ভোগ করতে পারেন।

এ ছাড়া এনবিআর কর্মকর্তাদের তথ্যমতে, কর অবকাশ সুবিধার পাশাপাশি কিছু শর্ত সাপেক্ষে ইকোনমিক জোন ও হাই-টেক পার্কের বিনিয়োগকারীদের ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানিতে আগের মতই জিরো ডিউটি সুবিধা বহাল থাকতে পারে। এছাড়াও শেয়ারবাজারে ক্যাপিটাল গেইনের ওপর নতুন করে আরোপ করা ট্যাক্স অব্যাহত থাকতে পারে। এনবিআর সূত্র জানায়, ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এসব বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন প্রতিষ্ঠানটির  চেয়ারম্যান আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম।

এই সময় প্রধানমন্ত্রী কিছু দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। ইকোনমিক জোন ও হাইটেক পার্কের এসব পরিবর্তনসহ অর্থবিল পাস হতে পারে। এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান,  এমপিদের গাড়ি ট্যাক্স ইমপোজের প্রস্তাব এবার থাকার সম্ভাবনা কম। এ বিষয়ে পরে আইনি দিকগুলো যাচাই করা হবে। এ ছাড়া আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাবে বিদেশে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী এবং কিছু ব্যবসায়ীর জন্য সুখবর আছে। প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, আসন্ন ২০২৪-২৫ অর্থবছর থেকে বিদেশে টিউশন ফি, ব্যবসায়িক প্রচারের ব্যয় এবং আরও কিছু ক্ষেত্রে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে উৎসে কর দিতে হবে না।

বাংলাদেশ  থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে লেখাপড়া করতে যান। বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজে পড়াশোনা করেন বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী। এ ছাড়া চীন, মালয়েশিয়া, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করছেন। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে এসব ক্ষেত্রে উৎসে কর প্রত্যাহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। এই প্রস্তাব পাস হলে এসব  ক্ষেত্রে উৎসে কর দিতে হবে না।

এ ছাড়া ইজেড এবং হাইটেক পার্কগুলোর জন্য মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানিতে আরোপিত নতুন শুল্ক বাতিল হওয়ার সম্ভাবনা কম। বেসরকারি অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগকারীদের জন্য কর অবকাশ সুবিধা বাতিলের আগের সিদ্ধান্ত থেকে পিছিয়ে আসতে পারে সরকার। ইজেডগুলোয় স্থানীয় ও বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতেই এমনটা করার সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানিয়েছেন এনবিআরের কর্মকর্তারা।

×