ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

ঈদ উপলক্ষে প্রচারে নতুন মাত্রা

উপজেলা নির্বাচনে কৌশলী অবস্থানে বিএনপি-জামায়াত

​​​​​​​শরীফুল ইসলাম

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ৭ এপ্রিল ২০২৪

উপজেলা নির্বাচনে  কৌশলী অবস্থানে  বিএনপি-জামায়াত

.

আসন্ন উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারাদেশ উৎসবমুখর। প্রার্থী তাদের স্বজনদের জোরদার গণসংযোগের কারণে ভোটের প্রচার এখন তুঙ্গে। বেশ দিনের ছুটি পেয়ে শহরের মানুষগুলো এখন গ্রামে অবস্থান করে পছন্দের প্রার্থীর পক্ষে গণসংযোগ করছেন। তাই ঈদ উপলক্ষে নির্বাচনী প্রচারে নতুন মাত্রা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। ইফতার পার্টি উপহার বিতরণ ছাড়াও ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়সহ প্রার্থী তাদের সমর্থকরা বিভিন্ন সামাজিক কর্মকান্ড নিয়ে ভোটারদের মন জয় করার চেষ্টা চালাচ্ছে জোরেশোরে। তবে এক্ষেত্রে কৌশলী বিএনপি-জামায়াত। দুই দলের স্থানীয় নেতারা নির্বাচনে অংশ নিলেও এখনো প্রকাশ্যে প্রচার শুরু করেনি। তবে গোপনে নিজস্ব বলয়ে ভোট প্রার্থনা করে যাচ্ছে তারা। নির্বাচন নিয়ে যাতে কোনো ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি না হয় সে জন্য সতর্ক অবস্থানে রয়েছে নির্বাচন কমিমন (ইসি)

ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবার উপজেলা নির্বাচনে দলীয়ভাবে কাউকে প্রার্থী করছে না। প্রার্থিতা উন্মুক্ত থাকা এবং কাউকে নৌকা প্রতীক না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়ায় দলের স্থানীয় নেতারা যে যার মতো করে নির্বাচন করছেন। এর ফলে একই উপজেলায় আওয়ামী লীগের বেশ জন করে চেয়ারম্যান ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থী হচ্ছেন। ইতোমধ্যেই তারা নিজ নিজ অবস্থানে থেকে ভোট প্রার্থনাও জোরদার করেছেন। পরিস্থিতিতে অন্যান্য দল এবং দল না করা অনেক যোগ্য প্রার্থীও নির্বাচন করছেন। জন্য প্রতিটি উপজেলায়ই এবার প্রার্থীর ছড়াছড়ি। বিএনপি তাদের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সঙ্গী জামায়াত প্রকাশ্যে নির্বাচনী প্রচার না করলেও  প্রতিটি এলাকায় গোপনে নিজেদের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছে। বিশেষ করে বর্তমানে যেসব উপজেলায় তাদের দলের চেয়ারম্যান বা উপজেলা চেয়ারম্যান রয়েছে সে সব উপজেলার প্রতি তারা বেশি জোর দিচ্ছে।

সূত্র জানায়, আগে থেকেই প্রতিটি উপজেলায় সম্ভাব্য প্রার্থীরা প্রচার শুরু করলেও ঈদকে সামনে রেখে তা নতুন মাত্রা পেয়েছে। জীবিকার প্রয়োজনে সারাদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা এলাকাবাসী ঈদকে কেন্দ্র করে শহর থেকে গ্রামে ছুটে গেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকেও অনেকে ঈদ করতে গ্রামে এসেছেন। সুযোগে তারা নিজেদের পছন্দের চেয়ারম্যান ভাইস চেয়ারম্যান প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে মাঠে নেমেছেন। 

দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর উপজেলা পরিষদ নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই প্রতিটি এলাকায় সরাসরি স্থানীয় পর্যায়ে উন্নয়ন বিভিন্ন জনসম্পৃক্ত কাজ করে থাকে। কারণে সবাই চায় তাদের পছন্দের প্রার্থী উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান ভাইস চেয়ারম্যান পদে নির্বাচিত হোক। তাই নির্বাচন সব সময়ই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়। এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীর আধিক্য থাকায় অন্যবারের চেয়ে নির্বাচন বেশি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে।

সরাসরি রাজনীতি করে না বা করলেও দলে ভালো পোস্ট-পজিশন নেই এমন যোগ্য লোকরাও যাতে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিতে পারে সে জন্য নির্বাচন কমিশনও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। এই ব্যবস্থার আলোকে এবার স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য নির্বাচন সহজ করে দেওয়া হয়েছে। আগে উপজেলা পরিষদে কোনো স্বতন্ত্র প্রার্থীর পক্ষে ২৫০ জন ভোটারের স্বাক্ষরযুক্ত সমর্থন প্রয়োজন হতো। সম্প্রতি ইসি নির্বাচন বিধি সংশোধন করে স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য ২৫০ জন ভোটারের সমর্থনযুক্ত স্বাক্ষর রাখার প্রয়োজন নেই বলে জানিয়ে দিয়েছে। কারণে প্রতিটি উপজেলায় প্রার্থীর সংখ্যা এবার বেশি হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়।  

বর্তমানে দেশে উপজেলা রয়েছে ৪৯৫টি। এবার সারাদেশে চার ধাপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। ৪৯৫ উপজেলার মধ্যে ইতোমধ্যেই দুই ধাপে ৩১৩টি উপজেলা নির্বাচনের পূর্ণাঙ্গ তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। ঈদের পর বাকি দুই ধাপে অন্য উপজেলাগুলোর পূর্ণাঙ্গ তফসিল ঘোষণা করবে নির্বাচন কমিশন (ইসি)

এদিকে প্রতিটি উপজেলায় আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাদের মধ্যে বেশ জন প্রার্থী হওয়ায় এবং মন্ত্রী-এমপি তাদের স্বজনরা পক্ষ নেওয়ায় ভোটের মাঠে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন উপজেলায় শুরু হয়েছে বিশৃঙ্খলা। তবে সংঘাত এড়াতে নানামুখী কৌশল গ্রহণ করেছে আওয়ামী লীগ। নির্বাচন কমিশনও সদা তৎপর থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।

বিএনপি কেন্দ্র থেকে উপজেলা নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কথা বললেও দলের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। তারা চুপে চুপে বিভিন্ন এলাকায় নির্বাচনী প্রচারও শুরু করে দিয়েছে। ছাড়া বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা রাজনৈতিক সঙ্গী জামায়াতসহ আরও টি দল রাজনৈতিক কৌশলের অংশ হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে বলে জানা যায়। কারণ এই স্থানীয় সরকার  নির্বাচনে অংশ না নিলে তৃণমূল পর্যায়ে দলের নেতাকর্মীরা নিষ্ক্রিয় হতাশ হয়ে যাবে। আবার অনেক উপজেলায় বর্তমানেও বিএনপির চেয়ারম্যান থাকায় এবার নির্বাচনে অংশ না নিলে আধিপত্য খর্ব হবে। তৃণমূল পর্যায়ের বিএনপি নেতাকর্মীরা মনে করছেন দল যে সিদ্ধান্তই নিক উপজেলা নির্বাচনে তারা অংশ নেবে। আর জামায়াত তাদের জনপ্রিয়তা আছে এমন কিছু এলাকায় নির্বাচন করতে দলগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে এখনো প্রকাশ্যে প্রচার না করে তারা নানা কৌশলে কাজ করছে।

বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, দেশের নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অধিকাংশই উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। জাতীয় সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি সব উপজেলা পরিষদের নির্বাচনে অংশ নেবে। জন্য ব্যাপক প্রস্তুতিও নিচ্ছে দলটি। তবে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের মতো উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও জাতীয় পার্টির প্রার্থীরা লাঙ্গল প্রতীকে নির্বাচন করবেন বলে দলীয় সূত্রে জানা যায়। ছাড়া জাসদ (ইনু) ওয়ার্কার্স পার্টিসহ আরও বেশ টি রাজনৈতিক দল উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিতে তৎপর রয়েছে। এর বাইরে বেশ টি বাম ইসলামী দলও নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।

এবার প্রথম ধাপে মে অনুষ্ঠিত হবে ১৫২ উপজেলা পরিষদ নির্বাচন। আর দ্বিতীয় ধাপে ২১ মে অনুষ্ঠিত হবে ১৬১টি উপজেলায় নির্বাচন। এর পর আরও দুই ধাপে অর্থাৎ তৃতীয় ধাপে ২৯ মে চতুর্থ ধাপে জুন অন্যান্য উপজেলার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম ধাপের  ১৫২ উপজেলার মধ্যে ২২টিতে ভোটগ্রহণ হবে ইভিএমে। বাকি ১৩২ উপজেলায় ভোট হবে ব্যালট পেপারে। আর দ্বিতীয় ধাপের ১৬১টির মধ্যে ৮টি উপজেলায় ইভিএমে আর বাকি ১৫৩টি উপজেলায় ভোট হবে ব্যালট পেপারে।

প্রথম ধাপের ১৫২ উপজেলার নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীদের রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে মনোনয়নপত্র জমার শেষ সময় ১৫ এপ্রিল, বাছাই ১৭ এপ্রিল এবং প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ সময় ২২ এপ্রিল। নির্বাচন কমিশন ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী দ্বিতীয় ধাপে যে ১৬১ উপজেলায় নির্বাচন হবে সেখানে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২১ এপ্রিল। মনোনয়ন বাছাই হবে ২৩ এপ্রিল। মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময় ৩০ এপ্রিল। ভোট গ্রহণ ২১ মে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে উপজেলা নির্বাচনকে অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে আগে থেকেই প্রচার শুরু করেছে। দিন যত যাচ্ছে প্রার্থী তাদের স্বজনদের নির্বাচনী প্রচার ততই জোরদার হচ্ছে। নির্বাচনে তৃণমূল পর্যায়ে দলীয় অবস্থান শক্তিশালী করতে রাজনৈতিক দলগুলোও অধিকতর তৎপর। তবে সবচেয়ে বেশি তৎপর আওয়ামী লীগ। আর রাজপথের বিরোধী দল প্রকাশ্যে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার কথা বললেও ভেতরে ভেতরে স্থানীয় পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নিজেদের দলের প্রার্থীর পক্ষে কাজ করছে। জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোও নিজ নিজ কৌশলে দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করছে। আর জামায়াত তাদের দলের প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করছে অতি গোপনে।

নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়আসন্ন উপজেলা নির্বাচন নিয়ে যাতে কোনো ধরনের বিতর্ক সৃষ্টি না হয় সে জন্য সতর্ক অবস্থানে রয়েছে সর্বস্তরের কর্মকর্তারা। ভালো নির্বাচন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রশাসনের সহযোগিতা নিচ্ছে ইসি। এখন থেকেই প্রতিটি উপজেলার নির্বাচনী পরিবেশ পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে জানা যায়। 

দেশে প্রথমবারের মতো উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালে। এর পর ১৯৯০ সালে দ্বিতীয়বার ২০০৯ সালে তৃতীয়বার, ২০১৪ সালে চতুর্থবার এবং ২০১৯ সালে পঞ্চমবার উপজেলা পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৯ সালে দেশে পঞ্চম উপজেলা পরিষদ নির্বাচন পাঁচ ধাপে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সে সময় ৪৮৮টি উপজেলা পরিষদের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়। এর মধ্যে ৪৫৫টির নির্বাচন যথা সময়ে অনুষ্ঠিত হয়। বাকি উপজেলাগুলোর নির্বাচন পরে অনুষ্ঠিত হয়।

সর্বশেষ ২০১৯ সালের ১০ মার্চ প্রথম ধাপে ৮২টি উপজেলার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর পর ১৮ মার্চ দ্বিতীয় ধাপে ১২৩টি, ২৪ মার্চ তৃতীয় ধাপে ১২২টি, ৩১ মার্চ চতুর্থ ধাপে ১০৬টি এবং ১৮ জুন পঞ্চম ধাপে ২২টি উপজেলায় ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৪ সালে জুন-জুলাই মাসে সাত ধাপে অনুষ্ঠিত হয় ৪৮৬ উপজেলার নির্বাচন।

×