ই-ভিসা
বাংলাদেশে ই-ভিসা প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সংযুক্ত আরব আমিরাতভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কাজ পেতে যাচ্ছে এসআইটিএ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। বিদেশি এই প্রতিষ্ঠাটির মাধ্যমে বিগত সময়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাধারণ যাত্রীদের তথ্য একাধিকবার হ্যাক হয়েছে। তারপরও সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক কোনো শর্ত ছাড়াই এই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়া হচ্ছে। আর এই প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে গিয়ে রাষ্ট্রের ৪৯৫ কোটি টাকা বেশি ব্যয় করা হচ্ছে। অর্থনীতিবিষয়ক মন্ত্রিসভার কমিটির বৈঠকে তোলার জন্য এ-সংক্রান্ত বিল প্রস্তুত করা হয়েছে।
নথি থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে ই-ভিসা কার্যক্রমকে প্রবর্তন করতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠান এমিরেটস টেকনোলজি (ইটিএসি)-কে কাজ দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ, যার সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে রয়েছে এসআইটিএ, ফ্রান্স। ইটিএসির কোনো ভিসা কার্যক্রম পরিচালনার অভিজ্ঞতা নেই।
সেই সঙ্গে ই-ভিসা ব্যবস্থাপনার জন্য যেই সফটওয়্যার ব্যবহৃত হয়, তার কোনো মেধাস্বত্ব (ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি-আইপি) রেজিস্ট্রেশনও করা নেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের এই প্রতিষ্ঠানের। ফলে এটি স্পষ্ট যে ইটিএস তার কার্যক্রমের জন্য এসআইটিএর ওপর নির্ভর করছে।
ই-ভিসা প্রকল্প বাস্তবায়নে যৌথ উদ্যোগের এ কোম্পানি ১৬ কোটি ৫০ লাখ ডলারের প্রস্তাব দিয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ হাজার ৮১৫ কোটি টাকা। এই প্রকল্পের অধীনে ৫ কোটি ই-ভিসা ও ২ কোটি ভিসা স্টিকার থাকবে। এ ক্ষেত্রে সিস্টেমের মূল্য ধরা হয়েছে সাড়ে ৭ কোটি ডলার ও ১০ বছরের এএমসি মূল্য সাড়ে ৪ কোটি ডলার। অথচ ই-ভিসা প্রকল্পে অভিজ্ঞ জার্মানির ভেরিডোস জিএমবিএইচ নামক প্রতিষ্ঠানটি ৫ কোটি ই-ভিসাসহ ২ কোটি ভিসা স্টিকারের জন্য ১২ কোটি ডলারের প্রস্তাব দিয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। জার্মানির এই কোম্পানির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে রয়েছে বাংলাদেশের ফ্লোরা টেলিকম লিমিটেড।
ই-ভিসা সফটওয়্যার ও সমাধানে ভেরিডোস জিএমবিএইচের নিজস্ব মেধাস্বত্ব রয়েছে। সৌদি আরব, বাহরাইনসহ ১০টি দেশে ভিসা প্রকল্পে কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। পাসপোর্ট নথি অনুযায়ী ফেস ভেরিফিকেশনের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি রয়েছে ভেরিডোসের, যারা বাংলাদেশে প্রযুক্তি স্থানান্তর করতে সক্ষম। প্রকল্পটির বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কেউ বক্তব্য দিতে রাজি হননি।
প্রকল্প বাস্তবায়নে কোম্পানিটি সাড়ে ৪ কোটি ডলার বেশি দরের প্রস্তাব দিলেও তাদেরই কাজটি দিতে আগ্রহী কিছু কর্মকর্তা। যদিও এসআইটিএ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে তাদের ই-ভিসা কার্যক্রম পরিচালনা করে সমালোচনার মুখে পড়েছে। যার মূল কারণ গ্রাহকদের তথ্য চুরির জন্য তারা পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে। সেই সঙ্গে আন্তর্জাতিক আইন মেনে কাজ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে একাধিকবার জরিমানার মুখেও পড়তে হয়েছে এ প্রতিষ্ঠানটিকে।
জেনেভাভিত্তিক আইটি প্রতিষ্ঠান সোসাইটি ইন্টারন্যাশনাল ডে টেলিকমিউনিকেশন (ইএনটি! এসআইটিএ) প্রায় ৭৮ লাখ ২৯ হাজার ৬৪০ মার্কিন ডলার জরিমানা গুনতে হয়েছে ৯ হাজার ২৫৬টি ‘স্পষ্ট’ দায়িত্ব অবহেলার কারণে। এই জরিমানা করে মার্কিন ট্রেজারারি বিভাগের ফরেন এসেট কন্ট্রোল অফিস (ওএফএসি)। এসআইটিএর বিরুদ্ধে বিশেষ যেই অভিযোগগুলোর অন্যতম হলো ২০১৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ‘গ্লোবাল টেররিজম স্যাংশন রেগুলেশন ৫৯৪.২০৪’ ভঙ্গ করা। এ সময় প্রতিষ্ঠানটি কমার্শিয়াল সার্ভিস এবং সফটওয়্যার সেবা প্রদান করে, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধীনস্থ ছিল। ২০২১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে থাই এয়ারওয়েজ পৃথক একটি তথ্য চুরির অভিযোগ জানায়, যেখানে এসআইটিএ প্যাসেঞ্জার সার্ভিস তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছিল। এই সার্ভিসের মাধ্যমে বিশ্ব জুড়ে উড়োজাহাজের যাত্রীরা কোথায় যাচ্ছে, তার তথ্য প্রক্রিয়া করা হতো। ২০২১ সালের মার্চে ভারতীয় জাতীয় এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ জানায়, সংস্থাটির যাত্রী পরিষেবা ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা এসআইটিএর কাছ থেকে ২০১১ সালের ২৬ আগস্ট থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৪৫ লাখ যাত্রীর ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে হ্যাকাররা। এ সময় ক্রেডিট কার্ড, পাসপোর্টের তথ্য, ফ্লাইট ডেটাসহ অনেক কিছু হ্যাক হয়ে যায়।
একাধিকবার তথ্য চুরি ও হ্যাকিংয়ের শিকার হওয়ার পরও এমন প্রতিষ্ঠানকে সুপারিশ করার আগে সেই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তথ্যের নিরাপত্তা বা সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে কোনো আলোচনা না করা বাংলাদেশের ই-ভিসা ব্যবস্থাপনাকে আরও বড় ঝুঁকিতে ফেলে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন একজন পর্যবেক্ষক।
ইটিএসির খসড়া প্রকল্প প্রস্তাবনা অনুযায়ী, বাংলাদেশে এই ই-ভিসা ব্যবস্থাপনা স্থাপনের পর কোনো ত্রুটি বা সমস্যা হলে এর জন্য ইটিএসিকে দায়ী করা যাবে না। ‘ই-ভিসা এবং এপিআই-পিএনআর’ নামক এই প্রকল্পটি পরিচালিত হচ্ছে বাংলাদেশের ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদপ্তরের অধীনে, যার মাধ্যমে পাসপোর্ট ও ভিসা ব্যবস্থাপনা প্রক্রিয়াকে আধুনিক রূপে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ইটিএসির তুলনায় অন্য যেসব প্রতিষ্ঠান এই প্রকল্পের দায়িত্ব পাওয়ার বিষয়ে আবেদন করেছে, তাদের অধিকাংশের খরচ কম ছিল।
আরএস