স্বজনদের উদ্বেগ উৎকণ্ঠা ও আহাজারি
চরম উৎকণ্ঠার মধ্যে রয়েছেন সোমালীয় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিকদের স্বজনরা। মঙ্গলবার নির্ঘুম রাত কাটানোর পর বুধবার সকালে তারা ছুটে যান চট্টগ্রাম নগরীর বারিক বিল্ডিং মোড় এলাকায় অবস্থিত কেএসআরএম (কবির স্টিল রি রোলিং মিলস) গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ে। সকলের চোখে মুখে গভীর চিন্তার ছাপ। তাদের মুখ থেকে একটাই কথা- আমরা যে কোনো মূল্যে তাদের ফেরত চাই। স্বজনরা এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য কামনা করেন।
জাহাজটির মালিক প্রতিষ্ঠান কেএসআরএম গ্রুপের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে যে, তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করছেন। তাদের কাছেও নাবিকদের জীবনের নিরাপত্তা সবার আগে। তবে এ ধরনের প্রক্রিয়ায় কিছুটা সময়ের প্রয়োজন হয়। জলদস্যুরা এখনো যোগাযোগ স্থাপন করেনি। যোগসূত্র স্থাপিত হলে দ্রুতই বোঝাপড়ায় যাওয়ার পথ সুগম হবে।
জাহাজে জিম্মি হয়ে পড়া নাবিক নুর উদ্দিনের স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস কান্নায় ভেঙে পড়েন কেএসআরএম গ্রুপের প্রধান কার্যালয়ে এসে। তিনি বলেন, যেভাবেই হোক, আমি শুধু আমার স্বামীকে চাই। তিনি জানান, তার সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছিল মঙ্গলবার বিকেলে। ফোন দিয়ে বলেছে, ‘জাহাজে জলদস্যু আক্রমণ করেছে। আমাদের অবস্থা অনেক খারাপ। অফিসে কল দিয়ে জানাও।’ আমি সঙ্গে সঙ্গে অফিসকে ফোন দিয়ে জানিয়েছি।
নাবিক নূর উদ্দিন এরপর সন্ধ্যা ৬টা ৪৯ মিনিটে ভিডিও কল দেন। এরপর একটি অডিও কলে দেন ভয়ংকর খবরটি। জানান, তাদের জাহাজটিকে অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। মুক্তিপণ না দিলে একজন একজন করে মেরে ফেলা হবে।
এমভি আবদুল্লাহর চিফ অফিসার আতিকউল্লাহ খানের ছোট ভাই আসিফ জনকণ্ঠকে জানান, ভাইয়ের সঙ্গে সবশেষ যোগাযোগ হয়েছিল মঙ্গলবার সন্ধ্যা ৬টার দিকে। জানিয়েছে, জলদস্যুরা তাদের সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যেখানে নিচ্ছে সেটুকু পথ যেতে আড়াই দিনের মতো সময় লাগবে। জলদস্যুরা জাহাজের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে, তাদের সকলকে জিম্মি করে ফেলেছে। তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন, তবে শারীরিকভাবে ঠিক আছে। তিনি বলেন, আমরা চাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নেগোসিয়েশন। তিনি জানান, তারা ২ ভাই ৫ বোন। আতিকউল্লাহর মা, স্ত্রী ও তিন কন্যা সন্তান রয়েছে। সকলে এখন খুবই উৎকণ্ঠার মধ্যে আছেন।
বুধবার সকালে কেএসআরএম প্রধান কার্যালয়ে আসা সকলেরই একটি চাওয়া- তাদের সন্তান, স্বামী, ভাইরা ফিরে আসুক। নাবিক আইনুল হক অভির মা লুৎফে আরা বেগম সাংবাদিকদের জানান, গতকাল (মঙ্গলবার) বিকেলে ছেলে ফোন করে বলে, জাহাজে ডাকাত উঠে গেছে। তোমরা আমাদের জন্য দোয়া কর। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন দিয়ে কান্না করে জানায়, তাদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ কথা হয়েছে বুধবার সকাল ৭টা ০১ মিনিটে। শেষবারের মতো এ কথা হয় একজনের লুকিয়ে রাখা মোবাইল ফোন থেকে।
কেএসআরএম গ্রুপের মিডিয়া অ্যাডভাইজার মিজানুল ইসলাম জনকণ্ঠকে জানান, নাবিকদের সঙ্গে সর্বশেষ কথা হয়েছে বুধবার সকাল ৭টার দিকে। জানিয়েছে, এখনো তারা সুস্থ ও নিরাপদ আছেন। তবে জাহাজের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি সোমালীয় জলদস্যুদের হাতে। তারা জাহাজটিকে তাদের জন্য সুবিধাজনক হয় এমন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছে।
জলদস্যুদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন সম্ভব হয়েছে কিনা জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, বুধবার বিকেল পর্যন্ত মুক্তিপণ চেয়ে কোনো যোগাযোগ করেনি তারা।
ধারণা করা হয় যে, জলদস্যুরা জাহাজটিকে তাদের জন্য নিরাপদ জায়গা না নেওয়া পর্যন্ত যোগাযোগ করবে না। আমরা সে অপেক্ষায় রয়েছি। তবে নানা কৌশলে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। জিম্মি হয়ে পড়া ২৩ নাবিকের সকলকেই নিরাপদে উদ্ধার করা আমাদের প্রধান লক্ষ্য। আগেও একবার জিম্মি নাবিক উদ্ধারের অভিজ্ঞতা আমাদের রয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবারও সফল হবেন বলে তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
আমার কলিজার টুকরাকে বুকে ফিরিয়ে দাও ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা, নাটোর থেকে জানান, বাগাতিপাড়া উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের সালাইনগর গ্রামের মো. জয় মাহমুদ। জিয়াউর রহমানের ছেলে জয় জাহাজের একজন ক্রু। জয় মাহমুদের মা আহাজারি করছেন আর বলছেন ‘আমার কলিজার টুকরোকে আমার বুকে ফিরিয়ে দাও।’
জয়ের চাচাত ভাই মারুফ হোসেন জানান, মঙ্গলবার বিকেল ৪টায় জয়ের মা-বাবা তার সঙ্গে সর্বশেষ কথা বলেন। পরে আমিও তার সঙ্গে কথা বলি। জয় জলদস্যুর কবলে পড়েছে বলে আমাকে জানায় এবং বিষয়টি কাকা-কাকির কাছে গোপন রাখতে বলে। সন্ধ্যা ৬টা ৩৯ মিনিটে জয় হোয়াটসঅ্যাপে জানায়, তাদের মোবাইল কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এরপর আর কথা বলা যায়নি।
সন্ধ্যার পরে গণমাধ্যমে খবর প্রচার হলে এলাকাবাসী জলদস্যুর হাতে জয়ের জিম্মি হওয়ার বিষয়টি জানতে পারে। খবর প্রচারের পর জয়ের বাড়িতে কান্নার রোল পড়ে। মাংফ হোসেন জানান, ছেলের অমঙ্গলের আশঙ্কায় রাত থেকে একটানা কেঁদেই চলেছেন জয়ের মা আরিফা বেগম।
তিনি বলেন, ‘জয়ের জাহাজ কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছি শেষ খবর জানার জন্য।’
জয় মাহমুদরা দুই ভাই-বোন। জয় বড়। ২০২১ সালে তিনি জাহাজে চাকরি নেন। এরপর প্রশিক্ষণ শেষে চার মাস ছুটি কাটিয়ে জাহাজে ফেরেন।
জয়ের মা আরিফা বেগম বলেন, ‘আমার কলিজার টুকরা যেন সহিসালামতে থাকে। তাকে আমার বুকে ফিরিয়ে দাও মাবুদ।’
জয় মাহমুদের বাবা জিয়াউর রহমান জানান, ‘আমার ছেলেসহ জিম্মি হওয়া সবাইকে দ্রুত উদ্ধার করা হোক, সরকারের কাছে এটাই আমার আবেদন।’
ডেক ক্রু নাজমুলের বাড়ি সিরাজগঞ্জে ॥ স্টাফ রিপোর্টার, সিরাজগঞ্জ থেকে জানান, সোমালিয়ায় জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশী জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’র ডেক ক্রু নাজমুল হক তাঁর মাকে ফোন করে জানান- মা, আমাদের ২৩ জনকে আটকে রেখেছে।’ এর পরই ফোন কেটে যায়। বাংলাদেশী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহতে তার চাকরি জীবনের দ্বিতীয় অভিযাত্রা ।
তার বাড়ি সিরাজগঞ্জ জেলার কামারখন্দ উপজেলার ভদ্রঘাট ইউনিয়নের উচ্চ শিক্ষিত জনপদ হিসেবে পরিচিত মুগবেলাই এলাকার চর নুরনগর গ্রামে। গ্রামের মানুষ তাকে আবু হানিফ নামে চেনে। ডেক ক্রু নাজমুল হক মা বাবার ছোট সন্তান। বড় বোন লিপি বিবাহিত। মোজাম্বিক থেকে দুবাইয়ের দিকে সাগর পথে যেতে ২৩ জন নাবিক-ক্রুর সঙ্গে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি হন তেলবাহী জাহাজের ডেক ক্রু নাজমুল হক। সবার মোবাইল জব্দ করা হলেও নাজমুল কৌশলে একটি মোবাইল সেট গোপনে লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হন। তা দিয়েই কথা হয় মঙ্গলবার রাত এগারটায় মা নার্গিস খাতুন ও বাবা আবু সামার সঙ্গে।
ডেক ক্রু নাজমুলকে ফিরে পেতে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে সরকারের নিকট অনুরোধ জানিয়েছেন নাজমুলের বাবা-মা। বুধবার সকালে কামারখন্দের চরনুরনগর গেলে তার বাবা-মা ও স্বজনরা নানা আর্তি জানান। মঙ্গলবার রাত এগারোটার দিকে গোপনে রাখা মোবাইলে চুপিসারে শেষ কথা হয় ছেলে নাজমুলের সঙ্গে। এরপর আর যোগাযোগ হয়নি। নাজমুলের বাবা আবু সামা শেখ কৃষক।
দু’ভাইবোন ও বাবা-মাকে নিয়ে চারজনের সংসার নাজমুলের। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করার পর এক বছর হলো জাহাজে চাকরি করছেন নাজমুল। গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর তিনি ‘এমভি আবদুল্লাহ’ জাহাজে ডেক ক্রু হিসেবে চাকরিতে যোগদান করেন। সমুদ্রগামী জাহাজে এটি তার দ্বিতীয় অভিযাত্রা। এর আগে আরেকটি জাহাজে ডেক ক্রু হিসেবে চাকরি করেছেন।
নাজমুলের বাবা আবু সামা শেখ ও মা নার্গিস খাতুন বুধবার বলেন, সে আমাদের পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। ওর বড় বোন লিপি বিবাহিত। ছেলের রোজগারের টাকাতেই আমাদের সংসার চলে। সরকারের কাছে অনুরোধ আমাদের ছেলেকে যেন জীবিত ফিরিয়ে পাওয়া যায়।
সিরাজগঞ্জ গোয়েন্দা পুলিশ (ডিএসবি) ইনচার্জ আব্দুর রহিম খান খান বলেন, ‘স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের মাধ্যমে বিষয়টি জেনে পুলিশ সুপারের নির্দেশে নাজমুলের পাসপোর্ট নম্বর ওয়েবসাইটে সার্চ দিয়ে তার পরিবার-স্বজনদের নাম ঠিকানা জানতে পেরেছি।’
সাব্বিরের বাড়িতে স্বজনদের আহাজারি ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল থেকে জানান, একমাত্র ছেলের জিম্মির খবর শুনে বাবা হারুন অর রশিদ হাঁউমাউ করে কাঁদচ্ছেন। মা সালেহা বেগম বুক চাপড়িয়ে কাঁদছেন আর বিলাপ করছেন। একমাত্র বোন মিতু আক্তার ভাইয়ের জন্য সবার কাছে দোয়া প্রার্থনা করছেন। তার ভাই যেন জিম্মি দশা থেকে মুক্ত হয়ে তাদের কাছে আবার ফেরত আসে।
তাদের কান্না থামাতে গ্রামের লোকজন বাড়িতে এসে ভির করছেন। গ্রামের লোকজন ও আত্মীয়স্বজনরা বাড়িতে এসে তাদের সান্ত¦না দিচ্ছেন। জিম্মির খবর পেয়ে স্বজনরা উদ্বিগ্ন রয়েছেন। তাদের একটাই দাবি সরকার যেন দ্রুত সাব্বিরকে মুক্ত করে আনে।
জানা যায়, ভারত মহাসাগরে জলদস্যুদের কবলে এমভি আব্দুল্লাহ নামক পণ্য বহনকারী জাহাজের ২৩ জন নাবিকের মধ্যে রয়েছেন সাব্বির হোসেন। পিতার নাম হারুনুর রশিদ। বাড়ি টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলার সহবতপুর ইউনিয়নের ডাঙা ধলাপাড়া গ্রামে। সে নাগরপুরের সহবতপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিগত ২০১৪ সালে থেকে এসএসসি পাস করে। টাঙ্গাইলের কাগমারি এমএম আলী কলেজ থেকে বিগত ২০১৬ সালে এইচএসএসসি পাস করে ভর্তি হন চট্টগ্রাম মেরিন একাডেমিতে।
সেখান থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে বিগত ২০২২ সালের জুন মাসে এমভি আব্দুল্লাহ নামক পণ্য বহনকারী একটি জাহাজে মার্চেন্ট কর্মকর্তা হিসেবে চাকরি নেন।
সাব্বিরের চাচাত ভাই আহম্মেদ হোসেন রানা বলেন, সাব্বিররা এক ভাই এক বোন। সে অনেক কষ্ট করে লেখাপড়া করেছে। তার বাবা কৃষিকাজ করে সংসার চালাতেন। বোনের বিয়ে হয়েছে। সাব্বিরের বাবা মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত কারণে প্যারাইলাইজড হয়ে শয্যাশায়ী।
সাব্বিরের চাকরি হওয়ার পর তার মা শয্যাশায়ী স্বামীকে নিয়ে সহবপুর তার বাবার বাড়ি বসবাস করেন। সহবতপুরের ডাঙা ধলাপাড়া গ্রামে এখন কেউ আর থাকেন না। একমাত্র উপার্জনক্ষম সাব্বির। তার কিছু হয়ে গেলে তাদের আর চলার উপায় থাকবে না। সরকারের কাছে দাবি জানাই সাব্বিরসহ সবাইকে যেন জিম্মি দশা থেকে দ্রুত মুক্ত করে।
সাব্বিরের একমাত্র বোন মিতু আক্তার বলেন, আমার ভাই গত সোমবার (১১ মার্চ) বিকেলে ফেসবুকে আপলোড দিয়েছে যে বিষুব রেখা অতিক্রম করলাম। মাথা ন্যাড়া করে ছবি আপলোড করেছে। এক মাস আগে সে বাড়ি আসছিল। একদিন থেকেই সে চলে গেছে। মঙ্গলবার (১২ মার্চ) সকাল থেকে তার মোবাইল বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
মঙ্গলবার (১২ মার্চ) দুপুরে এমভি আব্দুল্লাহ জাহাজটি জলদস্যুদের কবলে পড়ার খবর পেয়ে সবাই আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছি। বাবা-মা খাওয়া দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তারা শুধু কেঁদেই চলছে আর বলছে আমার ছেলেকে এনে দাও। আমার একমাত্র ভাইয়ের কিছু হলে বাবা-মাকে বাঁচানো যাবে না। অতি দ্রুত আমার ভাইকে মুক্ত করে আনার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছি।
মায়ের সঙ্গে তৌফিকুলের শেষ কথা ॥ স্টাফ রিপোর্টার খুলনা অফিস থেকে জানান, গেল দুইদিন আগে ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশী পতাকাবাহী জাহাজ ‘এমভি আবদুল্লাহ’র সেকেন্ড ইঞ্জিনিয়ার খুলনার তৌফিকুল ইসলামের পরিবারের সদস্যরা চরম উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার দিন কাটাচ্ছেন। গত মঙ্গলবার বিকেলে জিম্মি হওয়ার ঘটনা জানার পর থেকে কোনো কিছুতেই দুশ্চিন্তা কাটছে না তাদের। বৃদ্ধা মা দিল আফরোজা সারাদিন দোয়া পড়ছেন।
আর স্ত্রী জোবাইদা নোমান মাঝে মধ্যেই চিৎকার করে কেঁদে উঠছেন। এ ছাড়া তৌফিকের সাত বছর বয়সী মেয়ে তাসফিয়া তাহসিনা ও পাঁচ বছর বয়সী ছেলে আহমদ মুসাফি বাবার জিম্মি হওয়ার খবর শোনার পর বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছে। পরিবারের দাবি, তৌফিকুলসহ দ্রুত সবাইকে ভালোভাবে ফিরিয়ে আনার। জলদস্যুদের হাতে জিম্মি তৌফিকুল ইসলাম খুলনা মহানগরীর বয়রা এলাকার ২০/১ করিমনগরের ইকবাল হোসেনের ছেলে। তিন ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট।
বুধবার দুপুরে তৌফিকের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তার বাবা ইকবাল বাড়িতে নেই। বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই কানে আসে কান্নার আওয়াজ। দুই সন্তানকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছিলেন তৌফিকুলের স্ত্রী জোবাইদা নোমান। পাশে বসে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছছেন ৭২ বছরের বৃদ্ধা মা দিল আফরোজা। খবর শুনে আত্মীয়-স্বজনরাও বাড়িতে ভিড় করছেন। ধৈর্য ধরতে অনুনয়-বিনয় করছেন, কিন্তু কিছুতেই স্বস্তি মিলছে না তাদের।
তৌফিকুলের স্ত্রী জোবাইদা বলেন, মঙ্গলবার দুপুর ২টায় প্রথমে ফোন দিয়ে জানায়, আমাদের জাহাজ জলদস্যুদের কবলে পড়েছে। আমাদের ইঞ্জিন বন্ধ করে দিতে হয়েছে। ক্যাপ্টেন স্যারকে ক্যাপচার করে নিছে। দোয়া করো। আমাকে মাফ করে দিও। পরে বিকেল ৫টায় আবার ফোন দিয়ে বলেছে- আমাদের সোমালিয়ায় যেতে বাধ্য করা হচ্ছে। এখন আমরা সোমালিয়ার উদ্দেশ্যে রওনা দিচ্ছি। যেতে তিনদিন লাগবে।
তারপর থেকে আর যোগাযোগ নেই। সে কীভাবে আছে জানি না। ২০০৮ সাল থেকে আমার স্বামী জাহাজে চাকরি করলেও এ ধরনের বিপদে এই প্রথমবার পড়েছে।
তিনি আরও বলেন, এখনো সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। সরকারের কাছে আমাদের দাবি, যে কোনো মূল্যে, যত দ্রুত সম্ভব তাদেরকে সুস্থভাবে আমাদের কাছে ফিরিয়ে আনা হোক। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কোম্পানি যেন তাদের দ্রুত ফিরিয়ে আনে।
তিনি বলেন, গত বছরের ২৫ নভেম্বর থেকে চট্টগ্রামের এস আর শিপিং কোম্পানির এমভি আবদুল্লাহ নামের জাহাজে কাজ করছেন। এর আগে অন্য জাহাজে ছিল। জাহাজটি কয়লা নিয়ে মোজাম্বিক থেকে দুবাই যাচ্ছিল। তৌফিকের মা দিল আফরোজা বলেন, ছেলেকে জিম্মি করার কথা শোনার পর তাকে কয়েকটি দোয়া পড়ার কথা বলি।
তখন সে আমাদের সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নেয়। কথা বলার একপর্যায়ে জলদস্যুরা তার ফোন কেড়ে নেয় বলে বোঝা যায়। কেননা আমি হ্যালো হ্যালো করছি, কিন্তু সে কোনো উত্তর দিচ্ছে না। অন্য মানুষের শব্দ শুনতে পাই। এ ছাড়া কথার একপর্যায়ে সে বলেছিল কিছু সময়ের মধ্যে আমার ফোন কেড়ে নেওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী তো সবার বন্ধু। তিনি সবই পারেন। তিনি চেষ্টা করলে তাড়াতাড়িই তাদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে।
‘আমার সোনার টুকরা ছেলেরে আইন্যা দেও’ ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা নেত্রকোনা থেকে জানান, ‘আমি আমার সোনার টুকরা ছেলেরে ফিরত চাই। তোমরা যেভাবেই পারো, আমার ছেলেরে আইন্যা দেও।’ সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়া নাবিক ইঞ্জিনিয়ার রোকন উদ্দিনকে ফিরে পাওয়ার অপেক্ষায় এভাবেই আহাজারি করছেন তার মা লুৎফুন্নাহার। মাঝে মাঝে আবার মূর্ছাও যাচ্ছেন।
বুধবার বিকেলে নেত্রকোনা সদর উপজেলার ঠাকুরাকোনা ইউনিয়নের বাঘরুয়া গ্রামে রোকন উদ্দিনের বাড়িতে গিয়ে শোনা যায় তার স্বজনদের এমন আহাজারি। ওই গ্রামের মিরাজ আলী ও লুৎফুন্নাহার দম্পতির চার সন্তানের মধ্যে রোকন উদ্দিন তৃতীয়। বাংলাদেশের পতাকাবাহী জাহাজ এমভি আব্দুল্লাহ’র থার্ড ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করেন তিনি। মঙ্গলবার আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে রাসায়নিক পণ্য নিয়ে দুবাই যাওয়ার পথে ভারত মহাসগরে সোমালিয়ার জলদস্যুদের কবলে পড়েন রোকনসহ ২৩ নাবিক।
মিরাজ আলী ও লুৎফুন্নাহার বলেন, সর্বশেষ সোমবার ভোর রাতে রোকন উদ্দিনের সঙ্গে কথা হয় তাদের। তখন রোকন জানিয়েছিলেন, তিনি ভালো আছেন। এরপর মঙ্গলবার রাতে তারা বিভিন্ন গণমাধ্যমে রোকনসহ জাহাজটির সব নাবিককে জিম্মি করার খবর পান। কান্নাজড়িত কণ্ঠে মিরাজ আলী বলেন, ‘আমরা এখন সরকারের দিকে তাকিয়ে আছি। যা করার সরকারকেই করতে হবে।
আমরা এখান থেকে কী করতে পারব?’ তিনি উল্লেখ করেন, ‘শুনেছি এর আগেও একবার সোমালিয়ার জলদস্যুরা আরেকটি জাহাজ নাবিকদেরসহ আটকে রেখেছিল। পরে দীর্ঘ চেষ্টার পর সরকার তাদের মুক্ত করে। তাই সরকারের কাছে আমাদেরও অনুরোধ, সরকার যেন আমাদের সন্তানদেরও দ্রুত সময়ের মধ্যে মুক্ত করে আনে। কারও যাতে ক্ষতি না হয়’।
নাবিক রাজুর নোয়াখালীর বাড়িতে কান্নার রোল ॥ নিজস্ব সংবাদাদাতা, নোয়াখালী থেকে জানান, ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের হাতে জিম্মি বাংলাদেশী জাহাজ এমভি আবদুল্লাহর নাবিক আনোয়ারুল হক রাজুর (২৯) নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বাড়িতে চলছে কান্নার রোল। পরিবারে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। তাকেসহ জিম্মি সবাইকে মুক্তির দাবি জানিয়েছেন স্বজনরা। বুধবার বিকেলে রামপুর ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের আজিজুল হক মাস্টার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, জিম্মি নাবিক রাজুর বাবা-মা, ভাই-বোন সবাই কান্নাকাটি করছেন।
আনোয়ারুল হক রাজু রামপুর গ্রামের আজিজুল হক মাস্টারের ছেলে। এক বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে তিনি সবার ছোট। ২০১৬ সালে চট্টগ্রামের ন্যাশনাল মেরিটাইম ইনস্টিটিউট (এনএমআই) থেকে সিডিসি কোর্চ শেষে নাবিক হিসেবে জাহাজে যোগদান করেন।
নাবিক রাজুর বড় ভাই জিয়াউল হক রনি (৩২) বলেন, ‘গত নভেম্বরের শেষ দিকে রাজু সিঙ্গাপুর থেকে জাহাজে ওঠে। সোমবার সে আমার মোবাইলে মেসেজ করে, ‘সোমালিয়ান পাইরেটস অনবোর্ড। বাঁচি থাকলে দেখা হবে, দোয়া কইরেন...’। এরপর রাত ১০টায় ভয়েজ মেসেজে জানায়, ‘আমাদের সোমালিয়ার দিকে নিয়ে যাচ্ছে, দোয়া করবেন’।
বাবা আজিজুল হক মাস্টার বলেন, ‘অপহরণের খবর শোনার পর থেকে আমাদের পরিবারে হতাশা ও আতঙ্ক বিরাজ করছে। তার মা ক্ষণে ক্ষণে ছেলের জন্য মূর্ছা যাচ্ছেন। আমার ছেলেসহ জিম্মি সবাইকে উদ্ধার করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের সহযোগিতা কামনা করছি।’
নাবিক রাজুর মা দৌলত আরা বেগম (৬০) কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ভাঙা ঘর ছিল। এখন বিল্ডিং দিচ্ছি। কাজ শেষ হলে দুই ছেলেকে একসঙ্গে বিয়ে করাব। অনেক আশা নিয়ে আছি। কিন্তু আমার ছেলেসহ ২৩ মায়ের ছেলে জলদস্যুদের হাতে জিম্মি। আমি আমার ছেলেসহ সবার মুক্তি চাই। সরকারের উচ্চমহলের সহযোগিতা চাই।’
জানা যায়, অপহৃত জাহাজটি চট্টগ্রামের কবির গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান এস আর শিপিং লিমিটেডের মালিকানাধীন। যার নাম ‘এমভি আবদুল্লাহ’।
পণ্যবাহী জাহাজটি কয়লা নিয়ে ভারত মহাসাগর হয়ে মোজাম্বিক থেকে আরব আমিরাতের আল-হামরিয়া বন্দরের দিকে যাচ্ছিল। গন্তব্য ছিল দুবাই। বুধবার জিম্মি ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে গণমাধ্যম কর্মীদের নাবিকদের ছাড়িয়ে আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলে জানান কবির গ্রুপের মিডিয়া উপদেষ্টা মিজানুল ইসলাম। জাহাজটিতে জিম্মি আছেন ২৩ বাংলাদেশী নাবিক ও ক্রু। আফ্রিকার দেশ মোজাম্বিক থেকে কয়লা নিয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতে যাওয়ার পথে জাহাজটি জলদস্যুর কবলে পড়ে।
জলদস্যুদের হাতে জিম্মি ছেলে, মায়ের আর্তনাদ ॥ নিজস্ব সংবাদদাতা, রায়পুর, লক্ষ্মীপুর থেকে জানান, বাবার মৃত্যুর এক মাস পর ছেলে জিম্মি জলদস্যুদের হাতে ভারত মহাসাগরে সোমালিয়ান জলদস্যুদের কবলে পড়া জাহাজে থাকা বাংলাদেশী ২৩ নাবিকদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ার ক্যাডেট আইয়ুব খান (২৪) লক্ষ্মীপুর জেলার রায়পুরের বাসিন্দা। তার বাড়ি উপজেলার রাখালিয়া গ্রামে। প্রায় ১ মাস আগে তার বাবা আজহার মিয়া মারা যান। এখনো গৃহকর্তা হারানোর শোক কাটিয়ে উঠতে পারেনি পরিবারটি।
এরমধ্যেই পরিবারের ছোট ছেলে সাগরে ডাকাতদের কবলে রয়েছে। এ শোকে আইয়ুবের মা হোমায়রা বেগম কান্নায় ভেঙে পড়েছেন। কিছুক্ষণ পর পরই ছেলের ছবির দিকে চেয়ে আর্তনাদ করে ঠুকরিয়ে কেঁদে উঠেন। বুধবার (১৩ মার্চ) দুপুরে রায়পুরের রাখালিয়া গ্রামের বাড়িতে গিয়ে আইয়ুবের মাকে ছেলের জন্য আর্তনাদ করতে দেখা যায়।
আইয়ুব লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের (৬ নম্বর ওয়ার্ড) রাখালিয়া গ্রামের বিরন বেপারী বাড়ির মৃত আজহার মিয়ার ছোট ছেলে।
তিনি রাখালিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও রামগঞ্জের ফরিদ আহমেদ ভূঁইয়া একাডেমি থেকে এইচএসসি পাস করেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি থেকে মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেন। প্রায় ১ বছর ধরে ইন্টার্নি করছে আইয়ুব।
জানতে চাইলে আইয়ুবের মা হোময়রা জানান, সোমবার বিকেলে আইয়ুব তার সঙ্গে শেষবার কথা বলেছে। মঙ্গলবার তার অন্য ছেলেদের সঙ্গেও কথা হয়েছে। কেউ তাকে কিছু জানায়নি। গত রাতে তিনি নাতিনের কাছ থেকে শুনে মেঝো ছেলেকে ফোন দিয়ে বিষয়টি জানতে চান। মেঝো ছেলে তাকে জানিয়েছে, আইয়ুবের জন্য চিন্তা না করতে।
ভারত মহাসাগরে আইয়ুবদের জাহাজ সোমালিয়ান জলদস্যুরা অস্ত্র ঠেকিয়ে কব্জা করেছে। এসব শোনার পর থেকে কান্নাই ওনার (হোমায়রা) সম্বল। সারারাত তিনি ঘুমাতে পারেননি। আইয়ুবের কোনো খবরও পাওয়া যাচ্ছে না। তার ছেলে কিভাবে, কেমন আছে? এসব বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে মা হোমায়রা বেগম বলেন, আমি আমার বাবারে চাই। আমি আর কি চাইতাম। আমি দু’দিন ধরে কুরআন শরীফ জান-প্রাণ দিয়ে পড়ছি। আইয়ুবও পরশু ধরে কুরআন শরীফ পড়া শুরু করেছিল। আল্লাহ আপনি রহমত নাজিল করে দেন। আমার স্বামী মারা যাওয়ার ২০-২৫ দিন আগে সবশেষ আইয়ুব বাড়িতে এসেছিল। একদিন থেকে পরে চলে গেছে।