ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

সনদ ছাড়া বেইলি রোডের ভবনটিতে ব্যবসা! অভিযান চালিয়েছিল রাজউক

প্রকাশিত: ১৭:৫৬, ৪ মার্চ ২০২৪

সনদ ছাড়া বেইলি রোডের ভবনটিতে ব্যবসা! অভিযান চালিয়েছিল রাজউক

আগুনে পুরে যাওয়া বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবন।

রাজধানীর বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জন নিহতের ঘটনা নাড়া দিয়েছে পুরো বাংলাদেশকে। আর এই ভবনটিতে অকুপেন্সি সনদ ছাড়া ব্যবসা পরিচালনা করায় ২০১৯ সালেই একবার নোটিশ পাঠিয়েছিল রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। তবে সেই নোটিশ পেয়েও ভবনমালিক অবৈধ অংশ ভেঙে না ফেলায় মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করা হয়।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড (বিএনবিসি)-২০০৬ ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৮ অনুযায়ী, ভবন ব্যবহারের পূর্বে অকুপেন্সি সার্টিফিকেট (বসবাস বা ব্যবহার সনদ) নেওয়ার বাধ্যবাধকতা আছে। ভবন মালিক ভবন ব্যবহারের জন্য রাজউক বা ফায়ার সার্ভিসের অকুপেন্সি সার্টিফিকেট ব্যতিত গ্যাস, বিদ্যুত, পানি সংযোগ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য সিটি কর্পোরেশন হতে ট্রেড লাইসেন্স পেয়ে যাওয়ায় রাজউক, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরিকল্পিত এলাকা ব্যতীত রেস্টুরেন্ট সহ কোন ভবন ব্যবহারের জন্যই অকুপেন্সি সার্টিফিকেট নেওয়া হয় না। 

রাজউক সূত্রে জানা গেছে, ২০০৮-এর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা অনুসারে রাজউক আওতাধীন এলাকার ভবনগুলো নির্মাণের পর ভবন ব্যবহারের পর্বে  অকুপেন্সি সার্টিফিকেট (ভবন ব্যবহার ছাড়পত্র) গ্রহণ বাধ্যতামূলক। কিন্তু গ্রিন কোজি কটেজ ভবনের মালিকরা এ সনদ নেননি।

রাজউকের এক নথিতে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ১৭ জানুয়ারি রাজউকের জোন-৬/১-এর অথরাইজড অফিসার মো. নুরুজ্জামান হোসেন জাহির সাক্ষরিত এক রশিদে ভবনমালিকের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা আদায় করেছে রাজউক। সেই রশিদে বলা হয়েছে, ২নং রোডের নিউ বেইলি রোড, সিদ্বেশ্বরীর রমনা থানার বিদ্যমান অনুমোদিত/অননুমোদিত ইমারতের অবৈধ অংশ ভাঙা অপসারণ কাজে ব্যবহৃত পে-লোডার ভাড়া ও জ্বালানিবাবদ ৩০ হাজার জরিমানা আদায় করা হয়।

বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ ভবনটি বেইজমেন্টসহ ৮তলা আবাসিক কাম বাণিজ্যিক হিসেবে ২০১১ সালে রাজউক থেকে অনুমোদন লাভ করে। ভবনটির নিচ তলাসহ পঞ্চম তলা পর্যন্ত বাণিজ্যিক হিসেবে এবং বাকি তিন তলা আবাসিক হিসেবে অনুমোদিত হয়, যা রাজউকের ভাষায় মিশ্র ব্যবহারের জন্য ভবনটি অনুমোদন দেওয়া হয়। ভবনটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ২০১৩ সালে। ভবনটি ব্যবহারের জন্য রাজউক থেকে কোনো অকুপেন্সি সনদ নেয়নি কর্তৃপক্ষ।

এছাড়াও রাজউক বসবাস বা ব্যবহার সনদপত্র গ্রহণের জন্য বাধ্যবাধকতা বিষয়ে অবহিত করেন জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা ওয়াসা, ডিপিডিসি, ডেসকো, অর্থ মন্ত্রণালয়, ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ অর্থ মন্ত্রণালয়, ভবন ব্যবহার সনদপত্র নিয়ে বসবাস বা ব্যবসা করার বিভিন্ন সংস্থার কাছে সহযোগিতার জন্য বার বার চিঠি দিয়ে অনুরোধ করা হয়।

তথ্য মতে, রেস্তোরাঁ করার অনুমতি দেয় জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের বাণিজ্য অধিশাখা। কিচেন করার অনুমতি দেয় কলকারখানা ও পরিদর্শক অধিদপ্তর থেকে অনুমতি নেওয়া হয়। ব্যবসা করার জন্য সিটি কর্পোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স নিতে হয়। সিটি কর্পোরেশনের ট্রেড লাইসেন্স নিতে হলে ফায়ার সার্ভিসসহ বিভিন্ন সংস্থার কাগজপত্র দিতে হয়। ব্যবসায়িত ট্রেড লাইসেন্সসহ অন্যান্য সংস্থার কাগজ থাকলেও রাজউকের কাছ থেকে ব্যবহার সনদ (অকুপেন্সি সার্টিফিকেট) নেয়নি কর্তৃপক্ষ। এতগুলো সংস্থার কিভাবে এই দায়ভার এড়াবেন। সকল সংস্থার নিজ নিজ জায়গায় থেকে অবহেলা ছিল চরমে।

বিএনবিসি ২০২০ এর পার্ট ফোর এ বলা রয়েছে, ভবনের মালিক ফায়ার সেফটি এবং ইভাকুয়েশন প্ল্যানের জন্য একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিয়োগ করবেন যে এই ব্যাপারে বিশেষ কারিগরি দক্ষতার অধিকারী। উক্ত নিয়োজিত ব্যক্তির দায়িত্ব হবে ভবনটি ফায়ার সেফটি এবং ইমারজেন্সি অ্যাকশন এবং প্ল্যানস মেনে চলছে কিনা সেই ব্যাপারে সার্বক্ষণিক সজাগ থাকা এবং সরকারের অন্যান্য অধিদপ্তরকে সেই ব্যাপারে রিপোর্ট বা প্রতিবেদন উপস্থাপন করা। ভবনের দুর্ঘটনা জনিত কোন কারণের উদ্ভব হলে তারা সবার প্রথমে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরকে জানাবেন। উক্ত ভবনের মালিক এই ব্যাপারটি নিশ্চিত করবেন যে, ফায়ার সেফটি এবং ইভাকুয়েশন প্ল্যান স্টাফ সর্বদা উক্ত ভবনে অবস্থান করে তার দায়িত্ব ও কর্তব্য সঠিকভাবে পালন করছেন।

বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০, এ স্পষ্ট ভাবে ফায়ার সেফটি ও ইভাকুয়েশন প্ল্যান সম্পর্কে বিস্তারিত পরিকল্পনা ও কার্য পদ্ধতি বর্ণনা করা থাকলেও ভবন মালিক ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো তা না মেনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে অগ্নি নিরাপত্তা আইন ২০০৩ এর বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর তাদের উপর অর্পিত ক্ষমতা বলে উক্ত প্রতিষ্ঠান সমূহ কে অব্যবহারযোগ্য হিসেবে ঘোষণা করার ক্ষমতা থাকলেও তারা তা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হচ্ছে না।

গ্রীন কজি কটেজের ফায়ার সেফটি ও ইভাকুয়েশন প্ল্যান না থাকা সত্ত্বেও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর তাদেরকে অব্যবহারযোগ্য ঘোষণা করেননি। বিভিন্ন প্রাপ্ত তথ্য হতে দেখা যায়, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর ২০২৩ সালে গ্রিন কোজি কটেজ পরিদর্শন করে। তাদের পরিদর্শনে প্রতীয়মান হয় যে, গ্রীনকোজি কটেজের কোন ফায়ার সেফটি প্ল্যান বা ইভাকুয়েশন প্ল্যান ছিল না। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর থেকে তাদেরকে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে নোটিশ প্রদান করা হয়। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর তাদের ওপর অর্পিত ক্ষমতা বলে উক্ত ভবনকে অব্যবহারযোগ্য ঘোষণা করতে পারলেও ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। এছাড়া ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের নোটিশের পরও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন প্রতিবছর তাদের ব্যবসার জন্য ব্যবহৃত ট্রেড লাইসেন্স টি নবায়ন করে গিয়েছেন।

২০২২ সালে বিভিন্ন সংস্থা যেমন ডিপিডিসি, তিতাস, বাংলাদেশ ব্যাংক, জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, ঢাকা এবং অন্যান্য সংস্থাকে অকুপেন্সি সার্টিফিকেট ছাড়া ভবন সমূহে গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং অন্যান্য সেবা ও সংযোগ না দেওয়ার চিঠি দিলেও অন্যান্য সংস্থাগুলো তা আমলে নেয়নি। এই সমন্বয় হীনতার কারণে অগ্নি নিরাপত্তা আইন ২০০৩ ও বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোড ২০২০ অনুযায়ী, অগ্নি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের দায়বদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের ভবনসমূহের এবং মানুষের নিরাপত্তা বিধান না করেই বছরের পর বছর তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে এক্ষেত্রে অকুপেন্সি সার্টিফিকেট ছাড়া প্রয়োজনীয় সেবাগুলো বন্ধ রাখা হলে ভবনসমূহের নির্মাণ ব্যত্যয় ও ব্যবহার ব্যত্যয় রোধ করা যেত।

রাজউক কর্তৃপক্ষের দাবি, শুধু গ্রিন কোজি কটেজ নয়, কোনো অবৈধ ভবনের জন্য সংস্থাটি কারও কাছে ম্যানেজ হয় না। রাজউকের কর্মপরিধি অনুযায়ী তারা নোটিশ জারি ও সতর্ক করেছে। যেহেতু ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুটি অন্য সংস্থার, তাই রাজউক এককভাবে কোনো দায় নিতে নারাজ।

 

এম হাসান

সম্পর্কিত বিষয়:

×