ঢিলেঢালাভাবে হরতাল পালিত হয়েছে
হরতাল ডেকেও মাঠে নামেনি বিএনপি। রবিবার দিনভর দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ছিল তালাবন্ধ। গ্রেপ্তারের ভয়ে রাস্তায় নামেনি দলের নেতারা। তবে রাজপথে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি ছিল। বিএনপি নেতারা রাস্তায় না নামায় কর্মী-সমর্থকরাও ঘর থেকে বের হননি। মেট্রোরেলসহ যানবাহন চলাচল ছিল স্বাভাবিক। সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালত ছিল খোলা তবে উপস্থিতি ছিল কিছুটা কম।
এ কারণে বিএনপি ও তাদের সমনা দলগুলোর ডাকা দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কার্যত ফ্লপ হয়েছে। তবে বিক্ষিপ্তভাবে কোনো কোনো এলাকায় হরতালকারীরা চোরাগোপ্তা হামলা করে যানবাহন ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে। রাজধানীতে ৫টি গাড়ি জ্বালিয়ে দেয় তারা। হরতাল চলাকালে সারাদেশে নিহত হয়েছে ৩ জন। পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে শতাধিক হরতালকারীকে।
হরতাল চলাকালে নিহত ৩ জনের মধ্যে ঢাকায় ২ জন এবং লালমনিরহাটে ১ জন। এর মধ্যে ডেমরায় হরতাল সমর্থকদের দেওয়া আগুনে একটি বাস সম্পূর্ণ পুড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলে পুড়ে মারা যান বাসের সহকারী চালক নাঈম (২০)। এ ছাড়া মোহাম্মদপুর এলাকায় ককটেল ফাটিয়ে একটি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ সময় পালাতে গিয়ে হরতালকারী আব্দুর রশিদ (৩৬) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়েছে।
আর লালমনিরহাটে আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর হোসেনকে (৫০) কুপিয়ে হত্যা করে হরতালকারীরা। এর বাইরে কুমিল্লা ও শেরপুরে হরতালবিরোধী মিছিলে হৃদরোগে দুই আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যু হয়। আর ফরিদপুরে পুলিশি তল্লাশির সময় বিএনপি নেতার স্ত্রী হৃদরোগে মারা যান।
হরতাল চলাকালে হরতালকারীরা রাস্তায় নেমে যাতে নাশকতা করতে না পারে সে জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ছিল তৎপর। নয়াপল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে ছিল বিপুল সংখ্যক পুলিশ। এ অফিসের অনতিদূরে রাখা হয় প্রিজন ভ্যান, জলকামান ও সাঁজোয়া যান। রাজধানীর প্রতিটি মোড়ে পুলিশ ছিল সতর্ক পাহারায়। এ ছাড়া প্রতিটি অলি-গলির মাথায়ও ছিল পুলিশ পাহারা। তাই এই নিরাপত্তা ব্যুহ ভেদ করে বিএনপি নেতাকর্মীরা বাসা থেকে বের হয়ে হরতাল করতে রাজপথে নামার সাহস পায়নি বলে পর্যবেক্ষক মহলের ধারণা।
এদিকে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল চলাকালে রাজপথে বিএনপি ও তাদের সমমনা দলের নেতাকর্মীদের না দেখা গেলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তারা দিনভর থেমে হরতাল বিরোধী স্লোগান দিয়ে রাজপথে মহড়া দেয়।
উল্লেখ্য, সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন ও খালেদা জিয়ার মুক্তিসহ এক দফা দাবিতে ১৮ অক্টোবরের সমাবেশ থেকে ২৮ অক্টোবর মহাসমাবেশ করার ঘোষণা দেয় বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো। পুলিশ বিএনপির সংঘর্ষের ঘটনায় ২৮ অক্টোবর নয়াপল্টনে মাত্র এক ঘণ্টা চলার পর পন্ড হয়ে যায় বিএনপির মহাসমাবেশ। তাৎক্ষণিকভাবে সকাল-সন্ধ্যা হরতালের ঘোষণা দেয় বিএনপি। পরে জামায়াতসহ তাদের সমমানা ক’টি দলও অনুরূপ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়।
রাজধানীতে ৫ বাসে আগুন, মারা যায় ২ জন ॥ হরতাল চলাকালে রাজধানীর বায়তুল মোকাররম, মোহাম্মদপুর ও তাঁতিবাজার এলাকায় ৪টি বাসে অগ্নিসংযোগ করা হয়। এদিকে ভোরে ডেমরায় একটি বাসে আগুন দিলে একজন পুড়ে মারা যান এবং একজন দগ্ধ হন। ফায়ার সার্ভিস সদরদপ্তরের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান সিকদার বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, সকাল থেকে গাড়িতে লাগানো আগুন নেভানোর কাজ করেছে ফায়ার সার্ভিস।
সকাল ৯টার দিকে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে শিকড় পরিবহনের একটি বাসের আগুন নেভায় সিদ্দিকবাজার ফায়ার স্টেশনের ২টি ইউনিট। শিকড় বাসের চালক মোহাম্মদ হালিম বলেন, ‘পল্টন থেকে কয়েকজন যাত্রী তুলছিলাম। গুলিস্তানে আসার পরেই হঠাৎ দেখি গাড়িতে ধোঁয়া। তখন বাস থামিয়ে নাইমা যাই।’ বাসের যাত্রী ইসলামী ব্যাংক হাসপাতালের কর্মী মনোয়ার হোসেন বলেন, আমি পল্টন থেকে উঠেছি। ডিউটি শেষ করে টিকাটুলিতে বাসায় যাচ্ছিলাম।
গুলিস্তানের এইখানে আসার পরেই বাসে ধোঁয়া দেখতে পাই। বাসে ছয়-সাতজন যাত্রী ছিল। গুলিস্তানের আহাদ পুলিশ বক্সের দায়িত্বরত পুলিশের এসআই ওবায়দুল বলেন, আমরা আশপাশেই ছিলাম। এক মিনিটেই চলে এসেছি। যাত্রীবেশে কেউ এ কাজ করে থাকতে পারে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, শনিবার দিবাগত রাত ৩টার দিকে ডেমরা পশ্চিম দেইল্লায় পাকা রাস্তার ওপর অছিম পরিবহন বাসের দুই হেল্পার ঘুমিয়ে ছিলেন। তখন দুর্বৃত্তরা বাসে আগুন দেয়। এর মধ্যে ঢাকা মেট্রো-ব ১৫-৩৭৯০ নাম্বারের বাসে আগুন দেওয়ায় গাড়িটি সম্পূর্ণ পুড়ে যায়।
এতে ঘটনাস্থলে পুড়ে মারা যান বাসের সহকারী ড্রাউভার নাঈম (২০)। আর অগ্নিদগ্ধ হেলপার রবিউলকে উদ্ধার করে শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি করা হয়। ১০টা ২২ মিনিটে মোহাম্মদপুরের টাউন হল বাজার পরিস্থান পরিবহন নামের একটি যাত্রীবাহী বাসে মোহাম্মদপুর ফায়ার স্টেশনের দুটি ইউনিট আগুন নেভায়।
এছাড়া মোহাম্মদপুর এলাকায় ককটেল ফাটিয়ে একটি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় পালাতে গিয়ে হরতালকারী আব্দুর রশিদ (৩৬) নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। রবিবার ভোররাতে মোহাম্মদপুরের ময়ূর ভিলার বিপরীত পাশে ও সকাল সাড়ে ১০টার দিকে টাউন হল এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। বাসচালক মনিরুল ইসলাম জানান, সকাল ১০টার পর পরিস্থান পরিবহন গাড়িটি নিয়ে টাউন হল পার্কের সামনে এলে গলি থেকে মোটরসাইকেলে করে চারজন যুবক এসে রাস্তায় ৪টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটায়। এরপর যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে বাসে আগুন ধরিয়ে দেয়।
মোহাম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাহফুজুল হক ভুঞা বলেন, ভোর রাতের দিকে ময়ূর ভিলার বিপরীত পাশে বাসস্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে থাকা স্বাধীন পরিবহনের একটি বাসে পিকেটাররা আগুন দেয়। এ সময় হাতেনাতে একজনকে আটক করা হয়। আরেকজন দৌড়ে পালিয়ে সড়কের পাশে থাকা ৬ তলা ভবনে উঠে যায়। পুলিশের হাত থেকে রক্ষা পেতে ৬ তলার ওপর থেকে সে পাশের এক ছোট বিল্ডিংয়ের ছাদে লাফ দেয়। এতে ঘটনাস্থলে তার মৃত্যু হয়। নিহতের মরদেহ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের মর্গে পাঠানো হয়।
পুরান ঢাকায় বিহঙ্গ বাসে আগুন ॥ জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে মিরপুর, গাজীপুর, সাভারসহ বিভিন্ন রুটে বাসগুলো ছেড়ে গেছে। আবার একই রুটে ফিরে আসতে রাজধানীর পুরান ঢাকার তাঁতিবাজার মোড়ে যাত্রী সেজে মিরপুরগামী বিহঙ্গ পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় পিকেটাররা। এ সময় যুবদলের এক কর্মীকে গণধোলাই দিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেয় স্থানীয়রা।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এ অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় কেউ হতাহত হয়নি। বাসে আগুন দিয়ে পালানোর সময় একজনকে হাতেনাতে আটক করেছে পুলিশ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বেলা সাড়ে ১০টা নাগাদ গুলিস্তান থেকে বাসটি সদরঘাটের দিকে যাচ্ছিল। বিহঙ্গ পরিবহনের বাসটিতে যাত্রীবেশে ওঠা কয়েকজন আগুন দেয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। বংশাল থানা পুলিশ পরিদর্শক (ওসি) মো. মজিবুর রহমান আটকের বিষয়টি জনকণ্ঠকে নিশ্চিত করেছেন।
যাত্রীদের মধ্যে আতংক বিরাজ করায় তাঁতিবাজার মোড় ও রায়সাহেব বাজার মোড়ে পুলিশকে টহল দিতে দেখা গেছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ জোনের (ডিসি) উপ-পুলিশ কমিশনার জাফর আহমেদ জানান, গুলিস্তান থেকে যাত্রীবেশে চারজন বাসে ওঠে। তারা ভাড়াও দেয়। তাঁতিবাজার মোড়ে এসে তারা বাসে আগুন ধরিয়ে দিয়ে বাসের চালক ও হেলপারকে কিল-ঘুষি মেরে পালাতে চেষ্টা করে।
চালক, হেলপার ও স্থানীয়দের সহযোগিতায় আমরা একজনকে আটক করি। আটক ব্যক্তির নাম রাজু এবং সে ৩৭নং ওয়ার্ড যুবদলের সক্রিয় সদস্য। সে পেশায় একজন ভাঙারি ব্যবসায়ী। এদিকে হরতালের সমর্থনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদল হরতালের সমর্থনে পুরান ঢাকায় মিছিল করে। আর হরতালের প্রতিবাদসহ সকল নৈরাজ্যের দাঁত ভাঙা জবাব দিতে সকাল থেকে ক্যাম্পাসে অবস্থান করে জবি ছাত্রলীগ।
উত্তরা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ॥ হরতালের প্রথম প্রহর থেকে শেষ পর্যন্ত উত্তরা থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত মূল সড়কটি ছিল বেশ শান্তিপূর্ণ। এ রুটে অপ্রীতিকর কিছুই ঘটেনি। ভোর থেকে যানবাহন ধীরগতির হলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অফিসগামী যানবাহনের সংখ্যা বাড়তে থাকে। দুপুরের দিকে বাস ও রিক্সার যাতায়াত আরও বাড়ে। বিএনপি জামায়াত হরতালের ডাক দিলে ও এ এলাকায় তাদের কোনো নেতাকর্মীর উপস্থিতি চোখে পড়েনি। যে কারণে সড়কে তেমন কোনো প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়েনি পথচারী ও যানবাহনের যাত্রীরা।
যাত্রবাড়ী থেকে পল্টন ॥ বিএনপি ও জামায়াতের ডাকা হরতাল চলাকালে রাজধানীর ডেমরা ও গুলিস্তানসহ বিভিন্ন স্থানে যাত্রীবাহী বাসে আগুন দিয়েছে হরতালকারীরা। সরেজমিনে রাজধানীর ডেমরা, যাত্রাবাড়ী, শ্যামপুর, গুলিস্তান ও তাঁতীবাজার এলাকা ঘুরে হরতালকারীদের তেমন কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। সকাল থেকে যাত্রাবাড়ী এলাকায় গণপরিবহন চলাচল করতে দেখা গেছে। তবে অন্যদিনের তুলনা বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ছিল কম। কিন্তু রিক্সা, ভ্যান, সিএনজি, অটোরিক্সা ও মোটরসাইকেলসহ ছোট যানবাহন ছিল বেশি। যাত্রাবাড়ীতে হরতাল সমর্থনে বিএনপি-জামায়াতের কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। তবে সকাল থেকে যাত্রাবাড়ী মোড়ে অবস্থান নিয়ে শান্তি ও উন্নয়ন সমাবেশ করে যাত্রাবাড়ী থানা আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ।
সকাল সাড়ে ৯টার দিকে গুলিস্তানে বায়তুল মোকাররমের দক্ষিণ গেটে ঢাকা মেট্রো-ব ১৩-০১৫২ নম্বরের শিকড় পরিবহনের একটি বাসে আগুন দেয় পিকেটাররা। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। বাসটি মিরপুর থেকে যাত্রাবাড়ীতে যাচ্ছিল। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে রাজধানীর বংশাল থানার পাশে তাঁতীবাজার মোড়ে একটি বাসে আগুন দেয় হরতালকারীরা। এ সময় রাজু খান নামের এক যুবদলকর্মীকে হাতেনাতে আটক করে পুলিশ। পরে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের লালবাগ জোনের (ডিসি) উপপুলিশ কমিশনার জাফর আহমেদ বলেন, চালক, হেলপার ও জনগণের সহযোগিতায় আমরা একজনকে আটক করতে সক্ষম হই।
নিউ মার্কেট থেকে আসাদগেট ॥ অন্যান্য স্থানের মতো নিউ মার্কেট, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর, আসাদগেট রুটে চলাচলকারী পরিবহনের সংখ্যা ছিল কম। এসব এলাকায় যাত্রীদের সংখ্যাও ছিল হাতেগোনা। কতিপয় ব্যক্তিগত গাড়ি ও রিক্সা ছিল বাইরে বের হওয়া মানুষের প্রধান বাহন। সকালের দিকে অফিসগামী মানুষের কিছুটা চাপ থাকলেও দুপুরের দিকে মানুষজনের সংখ্যাও কমে যায়। সকালের দিকে এসব এলাকার রাস্তার পাশের অধিকাংশ দোকানপাটও ছিল বন্ধ। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে মোহাম্মদপুরের টাউন হল এলাকায় পরিস্থান নামে একটি পরিবহনের বাসে অগ্নিসংযোগ করে পিকেটাররা। পরে ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে আগুন নেভালে বাসটি পুলিশ হেফাজতে নেওয়া হয়। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এসব এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে।
নিউ মার্কেট এলাকার ভেতরের দোকানপাট খুললেও রাস্তার অংশের অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ছিল। ভাসমান হকারদের দখলে থাকা ফুটপাতও ছিল ফাঁকা। হরতালকে কেন্দ্র করে অগ্নিসংযোগের আশঙ্কায় আগ থেকেই অধিকাংশ ভাসমান দোকানিরা তাদের রুটি-রুজির শেষ সম্বল টেবিল, চৌকিসহ বিভিন্ন পণ্য মুড়ে নিয়ে গেছেন। হাতেগোনা কয়েকটি দোকান থাকলেও সেগুলো কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে রশি দিয়ে বেঁধে রাখতে দেখা গেছে।
গাবতলী থেকে কাওরানবাজার ॥ রবিবার সকালের গাবতলী বাসটার্মিনালের চিত্র ঠিক অন্যদিনের মতো ছিল না। গণপরিবহন থাকলেও দূরপাল্লার কোনো বাস ছেড়ে যায়নি। তাই দূরপাল্লার অনেক যাত্রীই টার্মিনালে অপেক্ষা করেছেন। বন্ধ ছিল প্রায় সব বাস কাউন্টার। যা দুই-একটি বাস কাউন্টার খোলা ছিল, তারাও অপেক্ষমান ছিল বিকেলের বাসের যাত্রীর জন্য। তবে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের যাত্রীদের জন্য বিআরটিসির কিছু বাস পাটুরিয়া ফেরিঘাট পর্যন্ত যাত্রী নিয়ে গেছে। গণপরিবহনসংশ্লিষ্ট কয়েকজন জানান, পরিবহন থাকলেও যাত্রী না থাকায় বাস ছাড়া সম্ভব হচ্ছে না। রয়েল পরিবহন বাস কাউন্টারের কয়েকজন কর্মচারী নিরাপত্তা বিবেচনায় বাস ছাড়া হচ্ছে না বলেও জনকণ্ঠকে জানিয়েছেন। তবে বিকেল থেকে সব বাস-মিনিবাস ছাড়া হয়।
সকাল থেকে মিরপুর, ফার্মগেট, কাওরানবাজার, বিজয় সরণী, মহাখালীর সড়কে ব্যক্তিগত যানবহন ছিল না বললেই চলে। সড়কে সিএনজি, মোটরবাইক ও রিক্সার আধিক্য ছিল চোখেপড়ার মতো। বাস চলতে দেখা গেলেও যাত্রী ছিল কম। আগারগাঁও এলাকায় একাধিক বিআরটিসি বাস ও গণপরিবহন চলেছে। মিরপুর, কাজীপাড়া ও অরজিনাল ১০ এলাকার অধিকাংশ শপিংমল ও দোকান বন্ধ ছিল। খোলা ছিল শুধু হোটেল, ফার্মেসি ও মিষ্টির দোকান। কিন্তু বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দোকানপাট খুলতে শুরু করে। দুপুরে মিরপুর ও আশপাশের এলাকার প্রায় সব দোকন খুলে যায়। বিপণি বিতানের বিক্রেতারা জানান, দিনভর ক্রেতাদের আনাগোনা কম ছিল। তবে সন্ধ্যার পর বেচাকেনা বাড়ে।
হরতাল চলাকালে সব সড়কে পুলিশ ও র্যাবের ব্যাপক উপস্থিতি ছিল। মিরপুর এক নম্বর এলাকায় র্যাবের বিশেষ চেকপোস্ট ও টহল দেয়। ১০ নম্বর গোলচত্বরে পুলিশের সতর্ক অবস্থান ছিল।
দেশের জেলা-উপজেলা থেকে স্টাফ রিপোর্টার ও সংবাদদাতারা জানান, বিএনপির হরতালে বাধা দেওয়ায় আওয়ামী লীগ নেতাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। লালমনিরহাটের মহেন্দ্রনগরে এ ঘটনা ঘটে। নিহত ব্যক্তির নাম জাহাঙ্গীর হোসেন (৫০)। লালমনিরহাট সংবাদদাতা জানান, হরতাল সমর্থনে মিছিল করে দলীয় কার্যালয়ের সামনে অবস্থান নেয় বিএনপি। একই সময় হরতালবিরোধী শান্তি মিছিল বের করে মহেন্দ্রনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ। এ সময় জাহাঙ্গীর হোসেনসহ বেশ কয়েকজনকে লাঠি ও ধারালো অস্ত্র দিয়ে জখম করে বিএনপির নেতাকর্মীরা। পরে আহত অবস্থায় রংপুর মেডিক্যালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
কুমিল্লায় হরতালবিরোধী মিছিলে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বিল্লাল হোসেন নামে এক আওয়ামী লীগ নেতা মারা গেছেন। তিনি নগরীর ৪ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। শেরপুরের নালিতাবাড়ীতে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে স্ট্রোক করে আজিজুল হক (৫৫) মারা গেছেন। তিনি যোগানিয়া আওয়ামী লীগের ৮ নম্বর ওয়ার্ড সাধারণ সম্পাদক। ফরিদপুরের নগরকান্দা উপজেলায় বিএনপি নেতার বাড়িতে পুলিশের তল্লাশির সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে রেঞ্জুয়ারা নামের এক নারীর মৃত্যু হয়েছে। তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক ও বিএনপি নেতা ইকরাম হোসেনের স্ত্রী।
প্রকাশ্যে পুলিশ পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় ঘৃণা জানিয়ে বিএনপির ১১ নেতা আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলায়। নারায়ণগঞ্জে হরতালের সময় পুলিশ ও বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। টিয়ারশেল ও পুলিশের গুলিতে ১৮ জন আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় গাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর ও নাসিক কাউন্সিলরসহ আটজনকে গ্রেপ্তার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
সিটেলে বিএনপি ও পুলিশের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এতে পাঁচ পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। এই ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতের সাত নেতাকর্মীকে আটক করেছে কোতোয়ালি থানা পুলিশ। রাজশাহীতে ঢিলেঢালাভাবে হরতাল পালিত হয়েছে। তবে দুপুরে এক পুলিশ সদস্যের প্রাইভেটকারে আগুন দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। নগরীর বিভিন্ন এলাকা থেকে বিএনপি-জামায়াতের ৭০ নেতাকর্মীকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আটক করে। ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় বিএনপির ৭০ নেতাকর্মীকে আটক করে পুলিশ। বগুড়ায় বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় ১৫ জন আহত হয়েছেন। পিকেটারদের হামলায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি ও রোগীবাহী গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে।
সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর থানা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। এতে থানা সাধারণ সম্পাদকের কক্ষ পুড়ে গেছে। নাটোরে জেলা বিএনপির সদস্য সাইফুল ইসলামকে লক্ষ্য করে গুলি করার ঘটনা ঘটেছে। এ সময় দুটি গুলি তার শরীরে বিদ্ধ হয়।
চুয়াডাঙ্গায় চার উপজেলায় বিএনপি-জামায়াতের ৩৮ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। মাগুরায় যাত্রীবাহী বাসে আগুন ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। নোয়াখালীর সেনবাগে হরতাল সমর্থক ও পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। হরতাল সমর্থকরা ট্রাকে আগুন ও মোটরসাইকেল ও সিএনজি ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছেন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ৪০ রাউন্ড ফাঁকা গুলি ছোড়ে। মানিকগঞ্জে হরতালে যাত্রীবাহী বাস, সিএনজি ও চার মোটরসাইকেলে আগুন দিয়েছে দুর্বৃত্তরা।
কিশোরগঞ্জে ইটনা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার গাড়ি আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে হরতাল সমর্থকরা। পরে পুলিশ আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ঝালকাঠিতে বিএনপির ১৮ নেতাকর্মী ও ঝিনাইদহে নাশকতার অভিযোগে ২৬ জনকে আটক করেছে পুলিশ। চাঁপাইনবাবগঞ্জে ককটেল, গানপাউডারসহ ঢিলেঢালা হরতালে বিএনপি-জামায়াতের ৩৫ নেতাকর্মীকে আটক করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।