সবচেয়ে প্রাচীন দুই জাতের ধান জাপোনিকা ও ইন্ডিকা নিয়ে পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক গবেষণা
সবচেয়ে প্রাচীন দুই জাতের ধান জাপোনিকা ও ইন্ডিকা নিয়ে পৃথিবীজুড়ে ব্যাপক গবেষণা হলেও তৃতীয় জাত আউশ নিয়ে অস্পষ্টতা রয়ে গেছে এখনো। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে এর চাষ হয় বটে, আদি জাতের সন্ধান মেলেনি। তবে কি বাংলাদেশেই প্রথম উৎপত্তি লাভ করেছিল মৌলিক এই ধান? সাম্প্রতিককালের আধুনিক জেনেটিক গবেষণা সে সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তুলছে। এর প্রেক্ষিতে দেশের বিভিন্ন প্রত্নস্থল থেকে মাটির নমুনা সংগ্রহ করে তা নিয়ে বর্তমানে অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ে চলছে আউশ গবেষণা।
দেশে আদিম শস্য গবেষণার প্রাথমিক সাফল্য অক্সফোর্ডের মতো বিশ^খ্যাত বিশ^বিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগ করে দিয়েছে বলে জানা গেছে। যুক্তরাজ্যের নামকরা এই বিশ^বিদ্যালয়ে ‘ইভলুশনারি মরফোমেট্রিক’ পরীক্ষার মাধ্যমে আউশের জন্ম, বায়োলজিক্যাল বিবর্তন এবং বিস্তৃতি সংক্রান্ত বিষয়ে গবেষণা করছেন প্রতœউদ্ভিদ বিজ্ঞানী মিজানুর রহমান। জানা যায়, বাংলাদেশী গবেষক ২০১৯ সালে অক্সফোর্ডে পাড়ি জমান। সেখানে তার গবেষণার বিষয় ‘আর্কিওবোটানিক্যাল পারসúেকটিভ অব বাংলাদেশ ॥ আর্লি হিস্টোরি টু আর্লি মেডিয়িভ্যাল পিরিয়ড (৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ-১২শ শতক)।’ তবে বর্তমানে আউশ গবেষণাকে সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন তিনি।
আন্তর্জাতিক বিভিন্ন জার্নাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দেখা যায়, এর আগেও অনেকে পৃথিবীর নানা প্রান্তে বসে আউশ নিয়ে গবেষণা করেছেন। একাধিক দেশ, ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান একযোগে কাজ করলেও ধানটির অনেক রহস্যই উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। তবে আউশ নিয়ে গবেষণা করতে নেমে প্রতœউদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা প্রতিবারই কিছু না কিছু তথ্য বা মতামত দিয়েছেন। ধানের জেনেটিক গবেষণা শেষে যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল বিজ্ঞানী বলেছেন, জাপোনিকা ও ইন্ডিকা ধানের মতোই মাদার রাইস আউশ। তবে আউশের জন্ম ঠিক কোথায়, কীভাবে হয়েছিল তা নিয়ে তারা কোনো নিশ্চিত তথ্য দিতে পারেননি।
একই বিষয়ে সুইজারল্যান্ডের বার্নস বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জর্জ ভ্যানড্রামরের একটি বক্তব্য পাওয়া যায়। সে বক্তব্য অনুযায়ী, আউশ ধান ভারতের অসমের পাললিক ভূমিতে প্রথম উৎপন্ন হয়ে থাকতে পারে। এর উৎপত্তির নিদর্শন হয়ত নদীবাহিত পলিমাটির অনেক গভীরে চাপা পড়েছে। তবে সাম্প্রতিককালে আধুনিক জেনেটিক গবেষণার ভিত্তিতে ধারণা করা হচ্ছে, ধানের এই জাতটি বাংলাদেশ কিংবা অসমের কোনো একটি এলাকাতে প্রথম উৎপত্তি লাভ করেছিল। বাংলাদেশে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি দেখা যাচ্ছে। এ কারণে আউশ গবেষণায় বাংলাদেশের ভালো সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গবেষণাটিতে সর্বোচ্চ জোর দিয়েছেন মিজানুর রহমান। অক্সফোর্ডের দুর্লভ প্রশিক্ষণ, সুযোগ-সুবিধা, গবেষণায় বিশ^বিদ্যালয়টির সাফল্যের ইতিহাস এ ক্ষেত্রে তাকে বিশেষভাবে উৎসাহিত করছে বলে জানা যায়।
এদিকে, দেশে আউশ চাষের বর্তমান অবস্থা খুব ভালো নয়। চাষ এবং ফলন দুই-ই কমেছে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কৃষি বিজ্ঞানী ড. জীবন কৃষ্ণ বিশ^াস জনকণ্ঠকে বলেন, ‘এক সময় বাংলাদেশের প্রধানতম ধান ছিল আউশ। বহু এলাকায় এর চাষ হতো। ষাটের দশকে সেচনির্ভর ইরি-বোরো প্রবর্তনের আগ পর্যন্ত আমন এবং আউশের উৎপাদনই ছিল বেশি। তবে যতদিন গেছে আউশের উৎপাদন ততই কমেছে। দেশে আউশের অনেক জাত থাকলেও উন্নত জাত আবিষ্কৃত হয়েছে কম। তাই ফলনও কমেছে।’
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের তথ্য মতে, এক সময় ধানটির উৎপাদন কমে ২০ লাখ টনের নিচে নেমে গিয়েছিল। বর্তমানে মাত্র ১৩ থেকে ১৪ লাখ হেক্টর জমিতে আউশ চাষ হয়। এ অবস্থায় মিজানুরের আউশ গবেষণা কী ধরনের পরিবর্তন আনতে পারে?
জানতে জুম সংযোগে গবেষকের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। জবাবে যুক্তরাষ্ট্র থেকে মিজান বলেন, ‘আউশকে বলা হয় দক্ষিণ এশিয়ার নিজের ধান। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এর চাষ হয়ে আসছে। বাংলাদেশের কৃষকরাও বহু আগে থেকে আউশের সঙ্গে পরিচিত। তবে এখন চাষ হওয়া ধানের সঙ্গে আমার গবেষণার সরাসরি সম্পর্ক নেই। আদি আউশের সন্ধান করছি আমি। সেটি পাওয়া গেলে বহু তথ্য জানা যাবে। সেসব তথ্য ইতিহাস পুনর্গঠনে সহায়তা করবে।’ পাশাপাশি মৌলিক গবেষণা তথ্য কৃষির উন্নতিতে কাজে আসবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
মিজান বলেন, ‘আউশের পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস উদঘাটনের জন্য হাজার হাজার বছর আগে জন্ম নেওয়া আদিম জাতের সন্ধান করতে হবে। এ কাজে নেমেই আজকের বাংলাদেশ অঞ্চলে ধানটি প্রথম জন্মেছিল বলে ধারণা হয় আমার। আউশের উপাদান ঠিকই হয়ত মাটির অনেক গভীরে চাপা পড়েছে। তবে হারিয়ে গেছে এটা নিশ্চিত করে বলা যাবে না। কারণ হারিয়ে গেছে তথ্যটির পক্ষেও কোনো প্রতœতাত্ত্বিক প্রমাণ নেই।’
এখন পর্যন্ত চালানো গবেষণার আলোকে তিনি মনে করেন, বগুড়ার মহাস্থানগড়ে আউশের জন্ম ইতিহাস পাওয়া যেতে পারে। উয়ারী-বটেশ^রে থাকতে পারে। আবার অন্য কোনো স্থান থেকেও পাওয়া যেতে পারে। ‘পাওয়া যেতে পারে’ এই প্রাথমিক অনুমানের ওপর ভিত্তি করে প্রয়োজনীয় গবেষণা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এর অংশ হিসেবে নরসিংদীর দুর্গনগরী উয়ারী-বটেশ^র থেকে মিজান পুনরায় সংগ্রহ করেছেন মাটির সুনির্দিষ্ট নমুনা। ল্যাবরেটরিতে ফ্লোটেশন পদ্ধতি ব্যবহার করে নমুনা থেকে আদিম ধান আলাদা করেছেন। প্রতœধান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আগুনে পোড়া অবস্থায় পাওয়া যায় বলে বর্তমানে দেশ থেকে সংগ্রহ করা সব ধান নিজে পুড়িয়ে প্রতœধানের সঙ্গে মিলিয়ে দেখার চেষ্টা করছেন তিনি।
ভিডিও কলে কথা বলার এক পর্যায়ে আদিম শস্যের একটি দুর্লভ সংগ্রহ প্রতিবেদককে দেখান গবেষক। বলেন, ‘এখানে নানা ধরনের উদ্ভিজ্জ উপাদান আছে। হয়ত আছে আউশও। আউশ এখান থেকে আলাদা করতে হবে। কোন প্রক্রিয়ায় আউশ আলাদা করা যাবে, সেই মেথড নিয়েই মূল গবেষণাটা চলছে অক্সফোর্ডে।’
তবে প্রতœকৃষি গবেষণার বিভিন্ন তথ্য ঘেটে দেখা যায়, এ ক্ষেত্রে সফল হওয়ার জন্য নমুনা সংগ্রহের বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। নমুনার সন্ধানে সম্ভাব্য সকল স্থানে ছুটতে হয়। লেগে থাকতে হয়। তার চেয়ে বড় কথা, নমুনা সংগ্রহে দক্ষতার পরিচয় দিতে হয়। সব মিলিয়ে কাজটি অনেক চ্যালেঞ্জিং। মিজান কতটা প্রস্তুত? জানতে চাইলে তরুণ প্রতœউদ্ভিদ বিজ্ঞানীর উত্তর, ‘অনেকেই মনে করেন আমি হয়ত রণে ভঙ্গ দেব। হয়ত দীর্ঘ সময় ধরে আদি আউশের অবশেষ খুঁজতে যাব না। বাস্তবতা হলো, আমি এ কাজটিকে দেশের প্রয়োজনেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই।’ পেছনে ফেরার কোনো সুযোগ নেই বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে মিজানের গবেষণার গুরুত্ব তুলে ধরে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষণা বিভাগের পরিচালক মোহাম্মদ খালেকুজ্জামান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আউশ খুব অল্প সময়ে পরিপক্ব হয়। এটি খরা সহিষ্ণু। পানির ভালো ব্যবস্থা না করা গেলেও টিকে থাকে। ফলে এ নিয়ে গবেষণা যত বেশি হবে ততই ভালো। তবে মিজানুর রহমানের গবেষণায় একটা নতুন ডাইমেনশন আছে। আউশের ঐতিহ্য কী ছিল, কীভাবে, কোথা থেকে কোথায় গেছে ইত্যাদি তার কাছ থেকে জানতে পারব আমরা। কিছু তথ্য সরাসরি আমাদের ধান গবেষণায়ও সহযোগিতা করবে।’ তবে এ জন্য আরও দেখার আছে বলেও মনে করেন তিনি।
এদিকে, আউশের রহস্য জানতে বর্তমানে বিশ্বের খ্যাতিমান প্রতœউদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা বাংলাদেশ ও ভারতের দিকে তাকিয়ে আছেন বলে জানা যায়। তবে ভারতে কেউ এ নিয়ে কাজ করছেন এমন তথ্য কোথাও পাওয়া যায়নি। জার্মানির ‘ইনস্টিটিউট অব হিউম্যান হিস্ট্রি’ ধান নিয়ে ব্যাপক গবেষণা করে থাকে। বিখ্যাত এই ইনস্টিটিউটও আউশ গবেষণায় নেই। এ অবস্থায় পৃথিবীতে আউশ গবেষণায় এককভাবে নেতৃত্বের আসনে রয়েছে বাংলাদেশ।
মিজানের আউশ গবেষণা সম্পর্কে অবগত আছেন বাইরের অনেক প্রত্নকৃষি গবেষক। তাদের একজন ভারতের ডেকান কলেজ পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট অ্যান্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণাগার ইনচার্জ ড. সতীশ নায়েক।
মিজানের আউশ গবেষণা কাছ থেকে তিনি দেখেছেন। কতটা আশাবাদী হওয়ার মতো? জানতে ই-মেইলে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেন এই প্রতিবেদক। একটি ভিডিও বক্তব্যে সতীশ নায়েক বলেন, ‘মিজানুর রহমান যে আউশ নিয়ে গবেষণা করছেন তা খুবই আশা জাগানিয়া। ওয়ান্ডারফুল! আমি তাকে অভিনন্দন জানাই। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই খুব ভালো খবর আমরা তার কাছ থেকে পাব।’ এটা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয়, ওয়ার্ল্ড আর্কিওবোটানির অর্জনের খাতায় সাফল্যের নতুন অধ্যায় যুক্ত হবে বলে মনে করেন ভারতীয় এই গবেষক।