ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৪ মার্চ ২০২৫, ৩০ ফাল্গুন ১৪৩১

ফ্লাইওভার  ও দুর্ভোগ

খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচের সড়কও অবৈধ দখলে

​​​​​​​ফজলুর রহমান

প্রকাশিত: ০০:০৪, ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩

খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচের সড়কও অবৈধ দখলে

রাজধানীর খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচে এভাবে দখল নিয়েছে ফার্নিচার ব্যবসায়ী ও ছিন্নমূল লোকজন

খিলগাঁও ফ্লাইওভারটি উত্তরে নেমেছে খিলগাঁওয়ে, দক্ষিণে বাসাবো আর পশ্চিমে নেমেছে শাহজাহানপুরে। ফ্লাইওভারটির নিচে ফাঁকা জায়গা। কিন্তু এই ফাঁকা জায়গার কোনো অংশই আর ফাঁকা নেই অবৈধ দখলদারদের কারণে। কেউ বসিয়েছেন দোকান, কেউ বোঝাই করে রেখেছেন ফার্নিচার, মুরগি পরিবহনের খাঁচা, লেপ-তোশক, স্টিলের দোকানের মালামাল। প্রভাবশালী মহল ব্যবহার করছে লেগুনা-সিএনজির স্ট্যান্ড হিসেবে। এমনকি লালন-পালন করা হয় ছাগলও। রেললাইনের ওপরেও ঝুঁকি নিয়ে বসছে দোকানিরা। এসবের প্রভাব পড়ছে মূল সড়কে। ফলে মূল সড়কে যানজট আর জনজটে চরম ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সড়কে চলাচল করা সাধারণ মানুষকে। এমন অব্যবস্থাপনা দেখেও যেন দেখছেন না সংশ্লিষ্টরা। সরেজমিনে এই এলাকা ঘুরে এমন চিত্রই দেখা গেছে। 

শুধু খিলগাঁও ফ্লাইওভার নয়; রাজধানীর সব ফ্লাইওভারের নিচে একই অবস্থা। অথচ ফ্লাইওভারের নিচে উঁচু বিভাজকে সৌন্দর্যবর্ধনের পরিকল্পনা ছিল মূল নকশায়। সেখানে ফুলের গাছ লাগানোর কথা ছিল। সেই পরিকল্পনা আর বাস্তবায়িত হয়নি। ফ্লাইওভারের নিচে ফাঁকা জায়গায় বাগান, বসার জায়গার ব্যবস্থা ছাড়াও নানা রকম নান্দনিক স্থাপনা তৈরির পরিকল্পনা ছিল। কর্তৃপক্ষের অবহেলায় সেই ফাঁকা জায়গাগুলো গিলে খাচ্ছে অবৈধ দখলদাররা।

তেমনি পরিবেশ দেখা গেছে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচের জায়গায়। মুগদা থেকে সোজাসুজি খিলগাঁও তালতলা মার্কেটের দিকে আসতে ফ্লাইওভারটির নিচের সড়কে চায়ের দোকান, ফলের দোকান, জুতা, গেঞ্জির দোকান দেখা গেছে। নিচের প্রতিটি ইউটার্নের মুখেও বসেছে ভাসমান দোকানিরা। পার্কিং করে রাখা হয় ব্যক্তিগত গাড়ি, কাভার্ডভ্যান, রিক্সা, বাইক।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মুগদা থেকে খিলগাঁও রেলগেট পর্যন্ত এভাবে দোকান বসিয়ে দৈনিক চাঁদা নিচ্ছে থানা পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশ লাইনম্যানরা। এখানকার লাইনম্যান মোল্লা। তিনি দোকান থেকে বিভিন্ন হারে চাঁদা নিয়ে ভাগ-বাটোয়ারা করে দিচ্ছেন ওখানকার পুলিশ বক্সের টিআই, সার্জেন্ট এবং খিলগাঁও থানা পুলিশকে। রেলগেটের পরে বাঁয়ের চার রাস্তার মোড় লেগুনা সিএনজিস্ট্যান্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এখান থেকে দক্ষিণ বনশ্রী, সিপাহিবাগ, গুলিস্তানসহ বিভিন্ন রুটে শতাধিক লেগুনা সিএনজি যাতায়াত করে। সড়কের ওপর লেগুনাস্ট্যান্ড বানানোর ফলে অন্যান্য পরিবহন যাতায়াতে চরম বিঘ্ন সৃষ্টি হয় এই সড়কে।

জানতে চাইলে খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনির হোসেন মোল্লা জনকণ্ঠকে বলেন, এখানে কিছু সিএনজি-রিক্সা থামে দেখেছি। কিন্তু লেগুনাস্ট্যান্ড হিসেবে জায়গা দখল করেছে সেটি নজরে আসেনি। কারা এটি করেছে, সেটি খোঁজ নেওয়া হচ্ছে। ফ্লাইওভারের নিচে দোকান বসিয়ে লাইনম্যান মোল্লার টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি লাইনম্যানের নাম জানতে চান এবং বলেন, এই মোল্লা কে? কার কার নামে সে টাকা তোলে সেটিও খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।

দেখা যায়, মালিবাগ থেকে মুগদাগামী যাত্রীবাহী চলন্ত বাস দাঁড় করিয়ে লেগুনা ঘোরাচ্ছেন, সাইট করছেন দুজন। যেন এই দুজনই ওই সড়কের সব। মূলত তারা অবৈধ লেগুনাস্ট্যান্ডের লেগুনার সিরিয়াল ঠিক করেন। একাধিক লেগুনা চালক জানান, এখানকার লেগুনা খিলগাঁও থানা শ্রমিক লীগের নেতারা দেখাশোনা করেন। তারাই সিরিয়াল করে দেন, কে  আগে আর কে পরে যাবে। এতে লেগুনাপ্রতি শ্রমিক লীগের নেতাদের দৈনিক ৭০০ টাকা করে দিতে হয়। সিরিয়ালম্যানকে দিতে হয় ৩০ টাকা করে। ৭০০ টাকা শ্রমিক লীগ নেতা, থানা ট্রাফিক পুলিশ ভাগ করে নেয়। সুবিধা হলো পথিমধ্যে সার্জেন্ট গাড়ি ধরলে কিংবা কোনো ঝামেলা হলে নেতারা বিষয়টি দেখেন।

ফ্লাইওভারের নিচের বিভাজকে চেয়ার পেতে বসে এসব লেগুনা-সিএনজি চলাচল তদারকি করতে দেখা যায় কয়েকজনকে। পরিচয় জানতে চাইলে চেয়ারে বসা ব্যক্তি নিজেকে খিলগাঁও থানা শ্রমিক লীগের আহ্বায়ক পরিচয় দেন, নাম মিজি ইকবাল। লেগুনাস্ট্যান্ড করা এবং টাকা নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ওখান থেকে ৬০টি লেগুনা এবং ৪০টি সিএনজি বিভিন্ন রুটে চলাচল করে। তারা এসব পরিবহনের সিরিয়াল মেইনটেন করেন। এখানে লেগুনা চালাতে হলে তাদের কাছ থেকে একটি অনুমতিপত্র নিতে হয় চালক মালিককে। সিপাহিবাগ থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত সিরিয়াল দেখার জন্য তাদের ২২ জন ডিউটিম্যান রয়েছে। ডিউটিম্যানদের জন্য ১০ টাকা করে নেওয়া হয়। ছাড়া আর কোনো খরচ নেওয়া হয় না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সড়ক পরিবহন সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে এই জায়গাটি লেগুনাস্ট্যান্ড করার অনুমতি পেয়েছেন তারা।

তবে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে থানা পুলিশের। পুলিশের যেসব টহল গাড়ি ওই রুট দিয়ে যায়, সবাই দাঁড়িয়ে কম-বেশি কথা বলে যান তাদের সঙ্গে।

রেলগেটের পর ৮নং রোডে যেতে চার রাস্তার মোড়ের সড়কে ছাগল লালন-পালন করতে দেখা গেছে। রেলগেট এলাকার রেললাইনের ওপরেই দুই পাশে বসানো হয়েছে ভাসমান দোকান। সকাল বেলায় কাঁচাবাজারও বসে সেখানে। এতে প্রধান সড়ক সংকীর্ণ হয়ে গেছে। ছাড়া সিপাহীবাগ, সবুজবাগ, মুগদা যাওয়ার এই প্রধান সড়কটিতে সব সময় যানজট লেগেই থাকে। রেলগেট সিগন্যাল পার হতেই সামনে পড়ে গুলিস্তান যাওয়া-আসার আরেকটি লেগুনাস্ট্যান্ড। এতে রেলগেট পার হয়ে সাধারণ মানুষ যানবাহন নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে না। এই স্ট্যান্ডটিও বসিয়েছে খিলগাঁও শ্রমিক লীগ। এই লেগুনাস্ট্যান্ড থেকে এবং ফ্লাইওভারের নিচে বসা দোকানিদের কাছ থেকে দৈনিক উৎকোচ নিচ্ছেন এই রুটের টিআই (ট্রাফিক ইন্সপেক্টর) নুরুজ্জামান। তবে তাকে একাধিকবার কল করলেও তিনি কল ধরেননি।

ফ্লাইওভারের নিচের সড়কসহ ওই এলাকার সড়কের এমন অব্যবস্থাপনার বিষয়টি কখনো নজরে এসেছে কিনা- এমনটি জানতে প্রশ্ন করা হয় ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ট্রাফিক) মতিঝিল বিভাগের ডিসি মোহাম্মদ মইনুল হাসানের কাছে। উত্তরে তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, লেগুনা-সিএনজি শুধু ওখানেই নয়; আরও অনেক জায়গায় রাখে। এর মধ্যে যেসব এলাকা গুরুত্বপূর্ণ সেখানে অভিযান চালানো হয়। লোকবলের অভাবে সব সময় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। সড়কে বিভিন্ন মালামাল রেখে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করার বিষয়ে তিনি বলেন, এক্ষেত্রে প্যাট্রল ইন্সপেক্টর থানা পুলিশেরও দায়িত্ব রয়েছে। টিআই যদি ব্যবস্থা না নিয়ে উৎকোচ নেয়, সেটিও তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

রেলগেট বাজার সংলগ্ন থেকে শাহজাহানপুর পর্যন্ত ফ্লাইওভারের নিচের জায়গায় ভাসমান দোকান বসানোর পাশাপাশি মুরগি পরিবহনের খাঁচা, লেপ-তোশক, ফার্নিচার, পাশের স্টিলের দোকানের বিভিন্ন মালামাল, শোকেস রাখা হয়েছে। এসব যে যার মতো রাখলেও দোকান বসিয়ে টাকা নিচ্ছেন লাইনম্যান মফিজ উদ্দিন। দোকানপ্রতি দৈনিক ২০০, সপ্তাহে ৫০০ টাকা করে নিচ্ছেন তিনি। দোকানিরা এমনটি জানানোর পর রেলগেট এলাকায় দেখা হয় মফিজের সঙ্গে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ২০ বছর ধরে তিনি ওখানে দোকান করছেন। সে কারণে সবাই তাকে চেনে। পুরনো লোক হওয়ায় হয়তো কেউ তার বিরুদ্ধে বানিয়ে কথা বলতে পারে। তবে তিনি টাকা নেন না, টাকা তুলে শাহজাহানপুর থানার টহল গাড়িতে থাকা পুলিশকে দেন। কত টাকা করে দেওয়া হয়-জানতে চাইলে বলেন, ১০০-১৫০ টাকা করে। সপ্তাহে টিআই নুরুজ্জামান ওসির জন্য ৫০০ করে আলাদা তোলা হয়। এতে তার লাভ পুলিশের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। বিপদে-আপদে পুলিশ তাকে সাপোর্ট দেয়।

শাহজাহানপুর থানার ওসি হাফিজুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, লাইনম্যান মফিজ উদ্দিন নামে তিনি কাউকে চেনেন না। তার নাম ভাঙিয়ে টাকা নেওয়ার বিষয়টি তিনি খতিয়ে দেখবেন। তিনি জানান, প্রায়ই কাউন্সিলর সিটি করপোরেশনের প্রতিনিধিরা এসব উচ্ছেদ করতে পুলিশি সহায়তা চান। আমরা তাদের উচ্ছেদ অভিযানে সহায়তা করি থাকি। এসব অভিযোগ খতিয়ে দেখা হবে।

জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান বলেন, ফ্লাইওভারের নিচের জায়গা দখলমুক্ত করতে প্রায়ই অভিযান চালানো হয়। তারপরও এরা বসে যায় কিংবা মালামাল রাখে। তিনি নতুন যোগদান করেছেন, ওখানকার বিষয়ে জেনে ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান।

×