
মাত্র ১৩ ডলার দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে মাসে লাখ টাকা আয়ের সুযোগ
মাত্র ১৩ ডলার দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুলে মাসে লাখ টাকা আয়ের সুযোগ! আবার কাজ করলেও আয়, না করলেও আয়! বিষয়টা আরও সহজ করে বলা যাক, অ্যাকাউন্ট খুলে সদস্য হওয়ার পর আয়ের জন্য অন্য ব্যক্তিকে দিয়ে আইডি খোলাতে হবে। এভাবেই যত অ্যাকাউন্ট তত ডলার। সেই সঙ্গে রয়েছে অর্থের শতভাগ নিশ্চয়তাও। সেই নিশ্চয়তা আবার সারাজীবনের জন্য। এমনি অদ্ভুত এবং চটকদার বিজ্ঞাপন দিয়ে ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দিচ্ছে ‘ফরসেজ আইও’ নামের একটি অনলাইন এমএলএম (মাল্টি লেভেল মার্কেটিং) প্রতিষ্ঠান। এ যেন আরেক এমটিএফই বা মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ গ্রুপ। এমটিএফইয়ের সদস্যরাই এখন দলে দলে অ্যাকাউন্ট খুলছে ফরসেজে। যে কোম্পানির দেশে কিংবা বিদেশে কোথাও কোনো অফিস নেই। এই অ্যাপ কারা বানিয়েছে, তারও কোনো হদিস নেই।
অথচ বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ফরসেজের অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে প্রায় ১২ লাখ ৩০ হাজার ৩৮৪টি। লেনদেনের কথা শুনলে চোখ কপালে উঠবে। এ পর্যন্ত শুধু বাংলাদেশ থেকে এই অ্যাপে লেনদেন হয়েছে ৫৯ কোটি ৮৪ লাখ ২১ হাজার ২২৬ ডলার। বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৬ হাজার ৫৮২ কোটি ৬৩ লাখ ৩৪ হাজার ৮৬০ টাকা। অর্থাৎ এই লেনদেনের কত শতাংশ কোন দেশে কিভাবে পাচার হয়ে যাচ্ছে, তা অজানাই থাকছে। এই অ্যাপের বিষয়ে সরকারের কোনো দপ্তরের কাছেও কোনো তথ্য নেই।
ফরসেজের ওয়েবসাইট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত সারা বিশ্বের ৩০ লাখ ৪৭ হাজার ৭৬৮ জন সদস্য ফরসেজে যুক্ত আছে। এরমধ্যে বেশিরভাগ মানুষই বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের। মোট অ্যাকাউন্টধারীর ৪০ দশমিক ৩৭ শতাংশ বাংলাদেশী। এর মধ্যে ২৮ শতাংশের বয়স ২৫ থেকে ৩৪ বছরের মধ্যে। বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে ১২ লাখ ৩০ হাজার ৩৮৪টি। প্রতিদিন দুই হাজার থেকে দুই হাজার ২০০ মেম্বার ফরসেজে যুক্ত হচ্ছে। ফরসেজের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, বুধবার পর্যন্ত ১৪৮ কোটি ২৩ লাখ ৩১ হাজার ৪০৫ ডলার টার্নওভার হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে টার্নওভার হয়েছে ৫৯ কোটি ৮৪ লাখ ২১ হাজার ২২৬ ডলার।
যা বাংলাদেশী মুদ্রায় ৬ হাজার ৫৮২ কোটি ৬৩ লাখ ৩৪ হাজার ৮৬০ টাকা। এত বড় অংকের লেনদেন বাংলাদেশ থেকে আদৌ হয়েছে কিনা সে বিষয়ে অনুসন্ধান করেছে জনকণ্ঠ। ‘ফরসেজ টিম বাংলাদেশ’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে বলা হয়েছে, এখানে কোনো ঝুঁকি নেই, দায়ও নেই, এটি কোনো কোম্পানি নয়। এমডি বা চেয়ারম্যান নেই, অফিস নেই, বসও নেই। শুধু ব্লক চেইন টেকনোলজি ও শতভাগ রোবটিক সিস্টেমে টাকা শতভাগ বিতরণ করা হয়। অ্যাকাউন্টের নিশ্চয়তা দিয়ে বলা হয়েছে, এটা যেহেতু ব্লকচেইন আওতাভুক্ত ডি সেন্ট্রালাইজড প্ল্যাটফর্ম তাই বলা চলে লাইফটাইম শতভাগ থাকবে। টাকা পাওয়ার উপায় হিসেবে বলা হয়েছে, এটার আয় সরাসরি ওয়ালেটে যোগ হবে।
একজন গ্রাহক ওয়ালেট থেকে দুই মিনিটের মধ্যে এক্সচেঞ্জ করে বিকাশ, নগদে বাইন্যান্সে নিতে পারেন। একটি অ্যাকাউন্ট খুলতে পাঁচটি স্লট মিলে সর্বমোট চার হাজার ৫৭০ টাকা লাগবে। তবে দুটি সুট নিয়ে কাজ করা যায় এক হাজার ৫৫০ টাকা দিয়ে। মাত্র ১৩, ২১, ৩২, ৩৮ বা ৪৫ ডলার দিয়ে আজীবন ইনকাম। গ্রুপটিতে আহমেদ সামি নামের একজন লিখেছেন, ‘ছোট্ট ইনভেস্টের মাধ্যমে ইনকাম করতে পারবেন মাসে ২০ হাজার থেকে লাখ টাকা।’ আরবি আহমেদ নামে একজন লিখেছেন, ‘এক দিনে ইনকাম ১০ ডলার, তাও কাজ না করেই পেলাম। ১০ গুণ ১১৫=১১৫০ টাকা ইনকাম। আমাদের টিমের সবাই অনেক ভালো ইনকাম করতেছে আলহামদুলিল্লাহ সবাই পারবেন, যারা ক্লাস ৮ম শ্রেণিতে পড়েন তাদের থেকে শুরু। কোনো উইথড্র করা লাগে না। টাকা অটোমেটিক আপনার বিকাশ ও নগদে পাবেন। সারা জীবন ইনকাম করতে পারবেন। যতদিন পৃথিবীতে নেটওয়ার্ক আছে।’
এ বিষয়ে ‘ফরসেজ টিম বাংলাদেশ’ গ্রুপের অ্যাডমিন মাসুদ হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, ফরসেজ একটি নেটওয়ার্ক মার্কেটিং বিজনেস। এটার কোনো মালিক নেই। এটা সম্পূর্ণ ডি সেন্ট্রালাইজড ও ব্লকচেইন টেকনোলজি দ্বারা পরিচালিত। এখানে একটা আইডি করতে হবে। এরপর রেফার করলে আর্নিং আসবে। এখানে কোনো থার্ড পার্টি নেই। যেমন ১৩ ডলার দিয়ে একটা অ্যাকাউন্ট করলে কোম্পানি ৯০ সেন্ট কেটে নিয়ে যাবে। থাকল ১২ ডলার। অ্যাপসের জন্য ও ট্রানজেকশন ফি বাবদ কাটবে ৪০ থেকে ৪৫ সেন্ট। থাকল সাড়ে ১১ ডলার। এখান থেকে দেড় ডলার অ্যাকাউন্টে থেকে যাচ্ছে। বাকি ১০ ডলারের ৫ ডলার যে করাবে সে পাবে, বাকি ৫ ডলার আপলাইনে চলে যাবে।
মাসুদ হাসানের দেওয়া হিসাব অনুযায়ী, সদস্যের বিপরীতে ফরসেজ নিয়ে যাচ্ছে তিন ডলারের মতো। অর্থাৎ বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ৬০ কোটি টাকার মতো বাংলাদেশ থেকে নিয়ে গেছে ফরসেজ। জনকণ্ঠ এরপর কথা বলেছে রাকিব আহমেদ নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে, যিনি সদস্য হওয়ার পর গত চার মাসে এক টাকাও মুনাফা তুলতে পারেননি। রাকিব জানান, ‘আমি আমার এক কাজিনের মাধ্যমে চার মাস আগে আইডি খুলেছি। অ্যাকাউন্ট খোলার সময় আমাকে বলা হয়েছিল কাজ না করলেও আয় আসবে। রেফার না করেও আপডেট করে ইনকাম পাওয়া যাবে। যে খুলে দিছে সে বলল, অ্যাকাউন্ট আপডেট দেন তা হলে আরও ডলার আসবে। তারপর আমি আরও কিছু ডলার কিনে আপডেট দিয়েছি।’
রাকিব বলেন, প্রথমে ১৩ ডলার (১ হাজার ৪৩০ টাকা) দিয়ে খুলেছিলাম। খোলার পর আমি কোনো ডলার পাইনি। বলা হয়েছে, রেফার করলে ১০ ডলার করে পাবেন। এরপর কাছের বন্ধু-বান্ধবদের দিয়ে ছয়টি অ্যাকাউন্ট খুলেছি। প্রথমটা থেকে পাঁচ ডলার পেয়েছি। ছয়টা থেকে মোট ৩০ ডলার অ্যাকাউন্টে জমা হয়েছে। আমি উইথড্র করিনি, ওই ডলার দিয়েই আপডেট দিয়েছি। ফলে ডিপোজিট শূন্য হয়ে গেছে। রাকিবের দেওয়া তথ্য যাচাই করতে জনকণ্ঠ কথা বলেছে অন্তত ত্রিশ জন বিনিয়োগকারীর সঙ্গে। যাদের সবাই বলেছেন তারা এই অ্যাপ থেকে কোন মুনাফা তুলতে পারেননি। অর্থাৎ কৌশলে বিনিয়োগের একটি বড় অংশই চলে যাচ্ছে দেশের বাইরে। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে এই অর্থ কোন দেশে যাচ্ছে?
যারা এই অ্যাপে বিনিয়োগ করছেন তারাও বলতে পারছেন না এই অর্থের গন্তব্য কোথায়। তবে বিদেশী কিছু ওয়েবসাইটে ট্রাফিক চেকারের মাধ্যমে ফরসেজের ঠিকানা খুঁজতে চেষ্টা করেছে জনকণ্ঠ। এতে দেখা যায়, ফরসেজের ডোমেইন কেনা হয়েছে ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারিতে। ডোমেইন রেজিস্ট্রেশনের মেয়াদ ২০২৮ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। ডোমেইন রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে এলটিডি রেজিস্টার সল্যুশন লিমিটেড নামে। এই নামে যুক্তরাজ্যে একটি প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেলেও ই-মেলে প্রতিষ্ঠানটি জানিয়েছে, ফরসেজ নামে তাদের কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। তবে ফরসেজ রেজিস্টারে +৪৪.২০৩৪৩৫৭৩০৪ নম্বরটি পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এটি আদৌ কোনো ফোন নম্বরই নয়।
গুগলে এই নম্বরে খোঁজ দিলে বলা হচ্ছে, ‘বিগ স্ক্যাম কামিং’ অর্থাৎ বড় প্রতারণামূলক কার্যক্রম আসছে। এ বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর হাসান জোহা জনকণ্ঠকে বলেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে টাকা পাঠানো হলে আমাদের মানি লন্ডারিং সফটওয়্যারে ফ্ল্যাগ করার কথা। আসলে এ ধরনের সফটওয়্যার বিএফআইইউতে আছে কিনা, কিংবা সচল আছে কিনা, তা দেখতে হবে। ‘দুর্ঘটনা ঘটার পর আমাদের টনক নড়ে’ উল্লেখ করে এ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ বলেন, সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আমাদের কোনো উদ্যোগ থাকে না। বিষয়টিতে বিএফআইইউর দায় আছে- উল্লেখ করে তানভীর হাসান জোহা বলেন, এখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনো দায় নেই।
কারণ, তাদের এসব বিষয়ে যদি বিএফআইইউ না জানায়, তারা তো কিছুই জানবে না। যদি টাকা পাচার হয় তাহলে অবশ্যই এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জানার কথা। জানতে চাইলে সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান জানান, দেশে অনিবন্ধনকৃত মোবাইল অ্যাপ্লিকেশনভিত্তিক প্রতারক চক্রের এমএলএম ব্যবসা এবং ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন অবৈধ ও নিষিদ্ধ। তিনি বলেন, সিআইডির সাইবার টিম এ বিষয়ে গভীর নজরদারি চালাচ্ছে।
এই অ্যাপের বিষয়ে সরকারের কোনো দপ্তরের কাছেই কোনো তথ্য নেই। জানতে চাইলে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যামসুন্দর সিকদার জনকণ্ঠকে বলেন, অভিযোগ আসা মাত্রই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। তবে এখন পর্যন্ত অনলাইনে অননুমোদিত আর্থিক লেনদেনের ৬৬৮টি ওয়েবসাইট চিহ্নিত করে ব্লক করার ব্যবস্থা করেছে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময়ে ১৪৮টি অ্যাপ, ৪০১টি সোশ্যাল মিডিয়া পেজ চিহ্নিত করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগে (সিআইডি) পাঠিয়েছে।