ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৮ এপ্রিল ২০২৫, ১৫ বৈশাখ ১৪৩২

আর্জেন্টিনা, মিসর, ইথিওপিয়া, সৌদি আরব, ইরান ও আমিরাত

ছয় দেশ হলো ব্রিকসের নতুন সদস্য

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৩:১৪, ২৪ আগস্ট ২০২৩

ছয় দেশ হলো ব্রিকসের নতুন সদস্য

ব্রিকস বৃহস্পতিবার ৬টি দেশকে সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছে

উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর জোট ব্রিকস বৃহস্পতিবার ৬টি দেশকে সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমন্ত্রিত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নাম নেই। নতুন সদস্য হতে যাওয়া দেশগুলোর মধ্যে ইরান ও সৌদি আরব রয়েছে। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাত, আর্জেন্টিনা, মিসর ও ইথিওপিয়া ২০২৪ সাল থেকে এই জোটে যোগ দেবে। বাংলাদেশও এই জোটে যোগ দেওয়ার জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু চূড়ান্ত আমন্ত্রণ পায়নি। সেই কারণে ব্রিকসের সদস্য পদ পেতে বাংলাদেশকে আরও অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে দেশটির প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা নতুন সদস্য দেশের ঘোষণা দেন। জোটটির বর্তমান সভাপতি দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা। ব্রিকস বর্তমানে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার উদীয়মান অর্থনীতির দেশের সমন্বয়ে গঠিত। নতুন সদস্যদের অন্তর্ভুক্তির ব্যাপারে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট বলেছেন, আমরা ব্রিকস জোটের সম্প্রসারণের প্রথম ধাপ নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছি। আমরা আর্জেন্টিনা, মিসর, ইথিওপিয়া, ইরান এবং সৌদি আরবকে ব্রিকসের পূর্ণ সদস্য হওয়ার আমন্ত্রণ জানাতে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। 

আমন্ত্রণের ভিত্তিতে ২০২৪ সালের ১ জানুয়ারি এ দেশগুলো ব্রিকসে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগদান করবে। এর মাধ্যমে পাঁচ দেশের জোট থেকে নতুন বছরে ১১ দেশের জোটে পরিণত হবে ব্রিকস। ব্রিকসে বাংলাদেশসহ ২০টি দেশ যোগ দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। এর মধ্যে প্রথম ধাপে ছয়টি দেশকে সদস্যপদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।  
কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবারে জোট সম্প্রসারণে নতুন ছয়টি দেশকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে মূলত অর্থনৈতিক দিক বিবেচনা নিয়ে। কারণ নতুন আমন্ত্রণ পাওয়া দেশগুলোর অর্থনীতির আকার বেশ বড় এবং অর্থনৈতিকভাবে দেশগুলো এখন শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে। নতুন মুদ্রা চালুর ক্ষেত্রে অথবা মূলধন জোগানোর জন্য নতুন দেশগুলো বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। একইসঙ্গে মহাদেশীয় অর্থনৈতিক দিকটি বিবেচনায় আনা হয়েছে। তবে অপেক্ষা বাড়লেও বাংলাদেশ এলডিসি থেকে উত্তরণের পর আগামী সম্মেলনে অবশ্যই ব্রিকসের সদস্য পদ পাবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান বলেন, ব্রিকস মূলত অর্থনৈতিক জোট। এবারের সম্মেলনে সদস্য পদ দেওয়ার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক দিককে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। নতুন দেশগুলো ব্রিকসের তহবিলে বড় অঙ্কের মুদ্রা জমা করতে পারে। যা জোটটিকে আরও বেশি শক্তিশালী করবে। নতুন দেশগুলো অর্থনীতির আকার বেশ বড় এবং অর্থনৈতিক দিক দিয়ে অনেক শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে।
ওয়ালিউর রহমান আরও বলেন, আগামীতে ব্রিকসকে বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের মতো শক্তিশালী দেখতে চায় সদস্য দেশগুলো। সেটি মাথায় রেখেই ব্রিকস নেতারা নতুন সদস্য দেশকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। সৌদি আরব, ইরান, আরব আমিরাত ছাড়াও অন্য দেশগুলোর তহবিলের আকার বাড়ানোর মতো শক্তি রয়েছে। সেই কারণে বাংলাদেশের আগে দেশগুলো সদস্যপদ পেতে যাচ্ছে। তবে বাংলাদেশ যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর আগামী সম্মেলনেই ব্রিকসের সদস্যপদ পাবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।       
এবার নিয়ে মোট দুইবার ব্রিকস সম্প্রসারণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। গত ২০০৯ সালে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত ও চীনের সমন্বয়ে জোটটি গঠিত হয়। ২০১০ সালে যুক্ত হয় দক্ষিণ আফ্রিকা। ব্রিকস বিশ্বের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশকে প্রতিনিধিত্ব করে এবং বৈশ্বিক জিডিপিতে এক চতুর্থাংশেরও বেশি অবদান রাখে।  
ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দ্য সিলভা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংসহ রামাফোসার পাশাপাশি এই শীর্ষ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন জোটের আরও তিন নেতা। ইউক্রেন থেকে শিশু অপহরণের অভিযোগে গত মার্চে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করায় তিনি সম্মেলনে সশরীরে যোগ দেননি। তিনি সম্মেলনে ভার্চুয়াল মাধ্যমে যোগ দেন। তবে, সম্মেলনে নতুন সদস্য ঘোষণার সময় রাশিয়ার হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেন দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ।  
এদিকে রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবারের ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনের শুরু থেকেই মূল আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে জোটের সম্প্রসারণ। ব্রিকসের সব সদস্যই প্রকাশ্যে এই জোটে সদস্যসংখ্যা বাড়ানোর পক্ষে মত দেয়। তবে কীভাবে, কতটা, কত দ্রুত জোটের সম্প্রসারণ হবে। এসব বিষয় নিয়ে ব্রিকস নেতাদের মধ্যে বিভক্তি লক্ষ্য করা যায়। 

বিশেষ করে চীন ও রাশিয়ার চাওয়া ছিল, যত দ্রুত সম্ভব এই জোটে সদস্যদেশের সংখ্যা বাড়ানো হোক। তারা ব্রিকসকে পশ্চিমা আধিপত্যের বিপরীতে একটি কার্যকর বিকল্প জোট হিসেবে গড়ে তোলার পক্ষে। এবারের শীর্ষ সম্মেলনের আয়োজক দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী নালেদি প্যান্ডর গত বুধবার বলেন, নতুন সদস্য নেওয়ার জন্য একটি পদ্ধতির বিষয়ে ব্রিকস নেতারা একমত হয়েছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পরিচালিত রেডিও স্টেশনকে নালেদি বলেন, আমরা (ব্রিকসের) সম্প্রসারণের বিষয়ে একমত হয়েছি। নালেদি আরও বলেন, আমাদের কাছে একটি নথি রয়েছে, যা আমরা গ্রহণ করেছি। এতে ব্রিকসের সদস্য হতে চায়, এমন দেশগুলোকে বিবেচনায় নেওয়ার জন্য নির্দেশিকা, নীতিমালা ও প্রক্রিয়া নির্ধারণ করা আছে।...বিষয়টি খুবই ইতিবাচক।
ব্রিকসের সম্প্রসারণের বিষয়ে গতকালই একটি পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনের পর একটি চুক্তি গৃহীত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু চুক্তি গৃহীত হওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্ব হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। জোটের সম্প্রসারণ-সংক্রান্ত আলোচনা সম্পর্কে অবগত এক ভারতীয় কর্মকর্তা চুক্তি গৃহীত হওয়ার ক্ষেত্রে বিলম্বের বিষয়টি স্বীকার করেন। তিনি গত রাতে রয়টার্সকে বলেছিলেন, আলোচনা অব্যাহত রয়েছে।
সূত্র জানায়, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই জোটে সদস্য নেওয়ার বিষয়ে নতুন মানদ- সামনে আনলে চুক্তি গৃহীত হওয়ার বিষয়টি পিছিয়ে যায়। ফলে বৈশ্বিক বিষয়ে কথিত তৃতীয় বিশ্ব তথা গ্লোবাল সাউথকে আরও শক্তিশালী করতে ব্রিকসের উচ্চাকাঙক্ষা পূরণ হওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তার খবর দেয় রয়টার্স।
ব্রিকস দেশগুলোর অর্থনীতির মাত্রা-প্রকৃতি অনেকটাই ভিন্ন। জোটের সদস্য সরকারগুলোর বিদেশনীতির লক্ষ্যও পরস্পর থেকে ভিন্ন। কোনো ইস্যুতে ঐকমত্যের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো জোটের জন্য জটিল কারণ হিসেবে কাজ করে বলে রয়টার্সের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। 
জোটের প্রভাবশালী সদস্য চীন। তারা পশ্চিমা আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য একটি বহুমুখী বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার উপায় হিসেবে ব্রিকস সম্প্রসারণের বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে আহ্বান জানিয়ে আসছে। বুধবার চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং বলেছিলেন, অস্থিরতা ও রূপান্তরের একটি নতুন যুগে প্রবেশ করেছে বিশ্ব। ঐক্যের মাধ্যমে নিজেদের শক্তিশালী করার বিষয়ে জোটের প্রতিষ্ঠাকালীন উদ্দেশ্যের কথা ব্রিকস দেশগুলোর সব সময় মনে রাখা দরকার।
ইউক্রেনে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গ্রেপ্তারি পরোয়ানা রয়েছে। এ কারণে তিনি এই শীর্ষ সম্মেলনে ভার্চুয়ালি অংশ নিচ্ছেন। তিনি পশ্চিমা শক্তিগুলোকে এই বিষয়টি দেখাতে আগ্রহী যে এখনো বিশ্বে তার বন্ধু রয়েছে।
অন্যদিকে ব্রাজিল ও ভারত উভয়ই পশ্চিমাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছে। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দ্য সিলভা গত মঙ্গলবার বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ধনী অর্থনীতির দেশগুলোর জোট জি-৭-এর প্রতিদ্বন্দ্বী হতে চায় না ব্রিকস। 
হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান গত মঙ্গলবার বলেন, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্রিকস দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গির ভিন্নতা রয়েছে। এ কারণে জোটটি যুক্তরাষ্ট্রের ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীতে পরিণত হতে যাচ্ছে বলে মনে করেন না তিনি। তবে জোটের সম্প্রসারণসহ বিশ্বের প্রতিষ্ঠিত বহুপক্ষীয় ঋণদাতাদের বিকল্প হিসেবে নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংককে (ব্রিকস ব্যাংক) এগিয়ে নেওয়ার পদক্ষেপ পশ্চিমের কিছু লোকজনের মধ্যে উদ্বেগ বাড়াচ্ছে।
এদিকে ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা নিজেদের একটি প্রতিবেদনে দাবি করেছে, পঞ্চদশ শীর্ষ সম্মেলনে ব্রিকস (ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চিন, দক্ষিণ আফ্রিকা) রাষ্ট্রগোষ্ঠীর সম্প্রসারণের ব্যবস্থা পাকা করে ফেললেন চিনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং।  
কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মতে, চিনের উদ্দেশ্য হলো আমেরিকার নেতৃত্বাধীন জি৭-এর সমকক্ষ একটি আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী তৈরি করা, যার রাশ থাকবে চিনের হাতে। অর্থাৎ, পুরনো ব্লক রাজনীতির ধাঁচে আমেরিকার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী অক্ষ তৈরি করা। আমেরিকাসহ পশ্চিমী দুনিয়ার মোকাবিলার জন্য সেই উদ্যোগকে সমর্থন জানিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। যদিও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করায় গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় দক্ষিণ আফ্রিকায় যাননি পুতিন। মস্কোর প্রতিনিধি হিসেবে হাজির ছিলেন রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ।
ব্রিকসের পঞ্চদশ শীর্ষ সম্মেলনে ভারতসহ পাঁচ সদস্যরাষ্ট্রের পাশাপাশি যোগ দিয়েছেন প্রায় ৩০টি পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা। তাঁদের সকলেই ব্রিকসের সদস্য হতে ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণভাবে চীনের তরফে ব্রিকসের সম্প্রসারণের প্রস্তাব দেওয়া হলেও ভারত তাতে সায় দেয়নি। কারণ বিদেশ মন্ত্রকের আশঙ্কা ছিল, জিনপিং সরকার চেষ্টা করছে যে সব দেশে তাদের অর্থনৈতিক প্রভাব এবং আধিপত্য বেশি তাদের ব্রিকস গোষ্ঠীতে অন্তর্ভুক্ত করতে। কার্যক্ষেত্রে তা-ই হয়েছে বলে মনে করছেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।

আরো পড়ুন  

×