সংকট নিরসনে একমাত্র ভরসা আলোচনা কিংবা সংলাপ
ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও মার্কিন প্রতিনিধি দলের কেউই তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে কোনো কথা বলেননি। সংবিধানের বাইরে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি, সংলাপের বিষয়েও তাদের কোনো পরামর্শ নেই। এখন নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক সংকট নিরসনে একমাত্র ভরসা আলোচনা কিংবা সংলাপ। সংবিধানের মধ্যে থেকে আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান সৃষ্ট সংকট নিরসনের পথ খোলা থাকলেও বড় দুটি দলের শর্তের বেড়াজালে রাজনৈতিক ভাগ্যাকাশে জমে থাকা কালো মেঘ কাটছেই না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সংলাপের পথ একেবারে বন্ধ, আবার তাও বলছে না। বাস্তবে কোনো পক্ষই নিজের উদ্যোগে সংলাপের দায়িত্ব নিতে রাজি নয়। ফলে এ নিয়ে সন্দেহ-সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
বিদেশী কূটনীতিকদের সাম্প্রতিক সফরগুলোতে বিএনপির জন্য কোনো ভালো বার্তা বা সুখবর আসেনি। বরং বিদেশী প্রতিনিধি দলের সফর আগে নানা আশঙ্কার বার্তা নিয়ে সরকারের ওপর কিছুটা হলেও যে চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, সফর শুরুর পর তা সম্পূর্ণভাবেই কেটে গেছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা থেকে শুরু করে প্রভাবশালী মন্ত্রী, বড় সব রাজনৈতিক দলসহ নানা পর্যায়ে বৈঠক করে বিদেশী প্রতিনিধিরা আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার বিষয়ে মনোভাব জানার পাশাপাশি এ বিষয়ে নিশ্চয়তা চেয়েছেন। এমনকি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথাও বলেনি উন্নয়ন সহযোগীরা। তারা কোনো বৈঠকেই সরকারের ওপর অসাংবিধানিক কোন প্রস্তাব বা চাপ না দিয়ে, অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনেই প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছেন।
সরকারের পক্ষ থেকে সফররত বিদেশী প্রতিনিধিদের অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যাপারে পূর্ণ নিশ্চয়তা ও আশ্বস্ত করা হয়েছে। বিএনপিসহ তাদের সমমনাদের প্রত্যাশা ছিল অসাংবিধানিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার সরকার প্রশ্নে সফরে আসা বিদেশী প্রতিনিধিরা সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করবে। কিন্তু বাস্তবে নির্বাচনকালীন সরকার প্রশ্নে তারা কোনো কথাই বলেননি। এ বিষয়ে তাদের স্পষ্ট বক্তব্য ছিল- নির্বাচন কোনো পদ্ধতিতে হবে এটা এ দেশের অভ্যন্তরীণ ও সাংবিধানিক বিষয়। সে ব্যাপারে তারা কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। তারা শুধু নিশ্চয়তা চেয়েছেন আগামী নির্বাচন যেন অবাধ, নিরপেক্ষ এবং গ্রহণযোগ্য হয়। বিদেশী প্রতিনিধিদের এমন অবস্থান বিএনপিকে হতাশ করলেও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ অনেকটাই নির্ভার হয়ে সর্বাত্মক ভোটযুদ্ধে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
বাংলাদেশ সফর শেষে দেশে ফিরে যাওয়ার সময় গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের বেসরকারি নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়া স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু বাংলাদেশের জনগণের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ বিষয়ে আমরা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা দেখছি না। আমি শুধু বলতে চাই, আমরা কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ নিই না। আমি সহিংসতা প্রত্যাখ্যান করে সত্যিকারের শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও ন্যায্য গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে সমর্থন করতে সব পক্ষকে আহ্বান জানাই। আসুন, আমরা বাংলাদেশের জনগণকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ করে দেই। যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনকে সমর্থন করা।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের এমন অভিন্ন অবস্থানের ফলে বিএনপির নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি পূরণের বিষয়টি স্পষ্টতই আড়ালেই রয়ে গেল। এখন প্রশ্ন উঠেছে সংকট সমাধানের পথটা কী? এ অবস্থায় সংবিধানের মধ্যে থেকে সংলাপ বা আলোচনাকেই সংকট সমাধানের একমাত্র পথ বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপিও সংলাপের পথ একেবারে বন্ধ তা বলছে না। তবে সংলাপের উদ্যোগ বা দায়িত্ব কে নেবে- এ বিষয়ে দুই দলই জানা ও বোঝার চেষ্টা করছে। তবে রাজনীতিতে শেষ বলে কোনো কথা নেই। নির্বাচনের আগে ঠিকই সৃষ্ট সংকট সমাধানের একটি পথ বের হবে বলেই মনে করছেন অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদরাও।
সংলাপের ব্যাপারে কোনো চাপ অনুভব না করলেও আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের কেউ কেউ মনে করছেন, নির্বাচনের আগে বিরোধীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার প্রয়োজন হতে পারে- এমন একটা তাগিদ হয়তো এক পর্যায়ে আসতে পারে। কিন্তু শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন- এমন অসাংবিধানিক ইস্যুতে আওয়ামী লীগ কখনোই কোনো সংলাপে বসবে না। বিএনপি আগামী নির্বাচনে আসবে এমন নিশ্চয়তা দিলেই সংবিধানের মধ্যে থেকে তাদের কোনো দাবি-দাওয়া থাকলে তা নিয়ে আওয়ামী লীগ সংলাপের বিষয়টি বিবেচনা করবে।
অন্যদিকে, বিএনপি নীতিনির্ধারকদের অধিকাংশ নেতাই বুঝতে পেরেছেন বর্তমান অবস্থায় সংলাপ ছাড়া কোনো বিকল্প কোনো পথ নেই। কিন্তু এখন সংলাপের কথা বললে নেতাকর্মীদের রোষানলে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি থেকে আপাতত তাদের সরে আসার কোনো সুযোগ নেই। দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থকদের চাঙ্গা রাখতে এ ইস্যুতে তারা আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে গেলেও নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি বুঝে তারা সরকারের সঙ্গে সংলাপের প্রয়োজনীয়তা আছে কি-না, তা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে বিএনপি চাইছে, সংলাপের উদ্যোগটা সরকারের পক্ষ থেকেই নেওয়া হোক।
শনিবার বাংলাদেশে সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) তথ্যানুসন্ধানী প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বাংলাদেশের সংবিধান, সার্বভৌমত্ব, আইনি ব্যবস্থার ওপর ভিত্তি করে তারা আগামী নির্বাচন দেখতে চায়। তবে সংলাপ নিয়ে প্রতিনিধি দল কোনো কথা বলেনি। এমনকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার কিংবা সংসদ বিলুপ্তির বিষয় নিয়েও প্রতিনিধি দল কোনো কথা বলেনি। বাংলাদেশের সংবিধান ও বিধিবিধান অনুসারে আগামী নির্বাচন হবে। পৃথিবীর অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচনকালীন সরকার গঠন হবে। এখানে পার্লামেন্ট বিলুপ্তির প্রশ্নই ওঠে না। সরকারের পদত্যাগের প্রশ্নই ওঠে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রশ্নই ওঠে না।
বিএনপির সঙ্গে ইইউ প্রতিনিধি দলের বৈঠক শেষে দলটির স্থানীয় কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ব্রিফিংকালে বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নও বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও অংশীদারিত্বমূলক নির্বাচন দেখতে চায়। মানবাধিকার চায়, শ্রমিকের আইন সঠিকভাবে হচ্ছে কিনা জানতে চায়। সংলাপ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যেখানে কোনো ডেমোক্র্যাটিক অর্ডার নেই, মানবাধিকার প্রশ্নবিদ্ধ, আইনের শাসন প্রশ্নবিদ্ধ, লেভেল প্লেইং ফিল্ড অনুপস্থিত, সেখানে সংলাপের জন্য তো ডেমোক্র্যাটিক অর্ডার লাগে। সেই পরিবেশ তৈরি হোক, তার পর না সংলাপের প্রশ্ন আসে।
দুই পক্ষের এমন অনড় অবস্থায় সংলাপের দরজা আদৌ খুলবে কিনা, সে বিষয়ে সংশয়-অনিশ্চয়তা কাটছেই না। সংলাপের অতীত অভিজ্ঞতায় খুব আশাবাদী না হতে পারলেও রাজনৈতিক অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন, বড় দলগুলো যতই এখন অনড় অবস্থানে থাকুক, নির্বাচনের আগে সংলাপের রাস্তা একটা না একটা অবশ্যই বের হবে। এই সংলাপের মধ্য দিয়ে দুই পক্ষ তাদের অমননীয় অবস্থান থেকে সরে আসবে। তবে বড় দুই রাজনৈতিক দলের দুই মেরুতে অবস্থান দেশের জন্য শুভকর নয়। সংলাপ বা আলোচনার মাধ্যমেই রাজনৈতিক দলসহ দেশবাসীর মধ্যে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রত্যাশা তৈরি হবে।
নানা গুরুত্বপূর্ণ অভিন্ন ইস্যুতে দুই মেরুতে দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও দুদলের অবস্থান বিপরীতমুখী। তবে সংকট নিরসনে হঠাৎ করেই সামনে এসেছে দু’দলের সংলাপের সম্ভাবনা। সরকারের পদত্যাগ কিংবা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুটি নিয়ে সফররত বিদেশীরা কোনো কথা না বলায় এবং কার্যত বিষয়টি তাদের কাছে অগ্রহণযোগ্য হওয়ায় এখন সংলাপকেই সংকট সমাধানের একমাত্র পথ বলেই সবাই মনে করছেন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, বিএনপির নেতৃত্বে হলে সংলাপ এতটা সহজ হবে না। গত নির্বাচনে নেতৃত্বে ড. কামাল হোসেন থাকায় সরকারের তরফ থেকে দ্রুত সাড়া এসেছে। বিএনপিও ড. কামালকে সামনে রেখে কিছুটা বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার একটি পথ পেয়েছে। আগামী নির্বাচনকে ঘিরে সৃষ্ট সংকটের সমাধান সংকট দিয়ে নয়, সংলাপ দিয়েই হতে হবে। কারণ অতীত অভিজ্ঞতা সংলাপের সফলতার কথা বলে না। অবশ্য এর অর্থ এই নয় যে এবারের সংলাপও সফল হবে না। সবাই প্রত্যাশা করে সংলাপ হোক এবং নির্বাচনমুখী একটা পরিবেশ সৃষ্টি হোক। সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হোক। যদি দুই পক্ষ কিছুটা ছাড় দেওয়ার মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে আসে তা হলে অবশ্যই ভালো কিছু হবে।
তারা এও বলছেন, দুই দলই সংলাপে আসলে একটা না একটা পথ অবশ্যই বের হবে। গত সংলাপের সময় অনেকেই ধরে নিয়েছিলেন কোনো প্রাপ্তি আসবে না, সেখানে ১০ বা ২০ শতাংশ প্রাপ্তি অবশ্যই এসেছে। সেটাও কম কী? আর সংলাপের একটি ধারাবাহিকতা থাকে। হয়তো প্রথম বসায় কিছুটা হলো বা মনোমালিন্যই হলো। তবে আবারও একটি সংলাপের সম্ভাবনা থাকে। আমাদের প্রধান প্রত্যাশা নির্বাচনটা সুষ্ঠু হোক, সবার অংশগ্রহণে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচনটা হোক। আর সেদিকেই তাকিয়ে আছেন দেশের মানুষ।