ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

থাকবে ৮ লিফট, ২৮ এসকেলেটর ও ২৫ ট্রাভেলেটর

বৃহত্তম আন্ডারপাস ॥ এয়ারপোর্ট গোলচত্বরে হচ্ছে

আজাদ সুলায়মান

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ১০ জুন ২০২৩; আপডেট: ০০:১২, ১১ জুন ২০২৩

বৃহত্তম আন্ডারপাস ॥ এয়ারপোর্ট গোলচত্বরে হচ্ছে

যেদিক দিয়েই আসুন, ঢাকা এয়ারপোর্টের কাছাকাছি পৌঁছলেই আপনাকে যেতে হবে সরাসরি আন্ডারপাসে

যেদিক দিয়েই আসুন, ঢাকা এয়ারপোর্টের কাছাকাছি পৌঁছলেই আপনাকে যেতে হবে সরাসরি আন্ডারপাসে (পাতাল পথ)। আপনাকে বিদেশে যেতে হলে অবশ্যই নামতে হবে নিচে। তারপর ওপরে উঠবেন। আবার বিদেশ থেকে এলেও নামতে হবে নিচে। এরপর উঠতে হবে ওপরে। ইচ্ছে করলেই এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে সরাসরি আন্ডারপাস দিয়েই চলে যেতে পারবেন রেলস্টেশন, হজ ক্যাম্প, বিআরটি, এমআরটি ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে। আন্ডারপাস দিয়েই চলাচল করতে হবে ওই এলাকায়। যানজট নামক দুঃসহ যন্ত্রণা আর কখনোই আপনাকে পেয়ে বসবে না। এমনই অত্যাধুনিক ও সহজ যাত্রার নিশ্চয়তা দেবে দেশের বৃহত্তম আন্ডারপাস, যা তৈরি হবে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের গোল চত্বরে।
এটি নির্মাণ হলে ওই এলাকায় যানজট ভোগান্তির অবসান ঘটবে। বিদেশ ফেরত ও বিদেশগামী যাত্রীরা ইচ্ছে করলে হেঁটে আন্ডারপাস ব্যবহার করে সহজে গন্তব্যে পৌঁছতে পারবেন। হজযাত্রীরা হজক্যাম্প থেকে সহজে বিমানবন্দরে যেতে পারবেন। আবার যিনি চাইবেন তিনি রেলস্টেশনেও পৌঁছতে পারবেন কোনো ঝক্কি ঝামেলা ছাড়াই। সঙ্গে থাকছে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চড়ার সুবিধা। এমন সহজ ও নিরাপদ যাত্রার আন্ডারপাস এখন আর কেবল স্বপ্ন নয়। সব ধরনের প্রতিকূলতা পেরিয়ে এটি আগামী ডিসেম্বরে নির্মাণ কাজ উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। বহুল কাক্সিক্ষত এই প্রকল্পের নাম দেওয়া হয়েছে, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পথচারী আন্ডারপাস।
বিমানবন্দর সূত্র জানিয়েছে, এটি নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে এক হাজার ১৮৩ কোটি ৯৬ লাখ ৯৪ হাজার টাকা। এর মধ্যে ১ দশমিক ৭ কিলোমিটার টানেল নির্মাণে সর্বাধিক ৫৮৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা এবং মাটি কাটা ও সেগুলো শক্তিশালী করতে ২২৭ কোটি ৮৫ লাখ টাকা ব্যয় করা হবে। এর পুরোটাই সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে মেটানো হবে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়, সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ পরিকল্পনা কমিশনে প্রকল্পের প্রস্তাব পাঠিয়েছে। পরিকল্পনা কমিশন যাচাই-বাছাই করে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) পাঠাবে। একনেক চূড়ান্ত অনুমোদন দিলে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড এবং সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর যৌথভাবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে এই প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করে আনুষ্ঠানিকভাবে আগামী ডিসেম্বরে নির্মাণ কাজ উদ্বোধন করার সম্ভাবনা রয়েছে।

এ বিষয়ে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত আন্ডারপাস নির্মাণের নির্দেশনা দেন। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারিতে সড়ক যোগাযোগ ও সেতু মন্ত্রণালয় পথচারী আন্ডারপাস অ্যালাইনমেন্ট চূড়ান্ত করতে একটি কমিটি গঠন করে। কমিটি পুনরায় পরিদর্শন করে ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি অ্যালাইনমেন্ট চূড়ান্ত করে। ২০১৯ সালের মার্চে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় আন্ডারপাস নির্মাণের জন্য ভূমি ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। সম্প্রতি আন্ডারপাসের নক্সা প্রধানমন্ত্রীর সামনে উপস্থাপন করা হলে তিনি তাতে সম্মতি জানান। সব কিছু ঠিক থাকলে চলতি মাসেই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রকল্পটি উত্থাপন করার সম্ভাবনা রয়েছে।
জানা গেছে, বর্তমানে ঘণ্টায় সর্বোচ্চ প্রায় ১৪ হাজার ৭৭৭ জন পথচারী ও যাত্রী একটি মাত্র ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে এই মহাসড়ক পারাপার হন। ডিপিপিতে আরও বলা হয়েছে, প্রস্তাবিত এলাকায় নতুন রেলওয়ে ট্র্যাক সম্প্রসারণের কাজ চলমান রয়েছে। খুব শীঘ্রই এর সঙ্গে যুক্ত হবে বিআরটি বাস সুবিধা। এছাড়া এমআরটি ১-এর বাস্তবায়ন হলে এ এলাকায় যাত্রী চাপ বাড়বে। এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শেষ হলে প্রতিদিন প্রায় ৩ লাখ ৬০ হাজার যাত্রী এ এলাকায় চলাচল করবে। এর একটি বড় অংশ আন্ডারপাসের সুবিধা নেবে।
এদিকে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, প্রস্তাবিত এই আন্ডারপাসে ৯টি প্রবেশ ও বহির্গমন পথ থাকবে। এগুলো হচ্ছে, হজক্যাম্প, আশকোনা, বিমানবন্দর রেলওয়ে (বিআরটি) স্টেশন, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর টার্মিনাল-১, ২ ও ৩, বিমানবন্দর উত্তর গেট, দক্ষিণ গেট ও এমআরটি স্টেশন। আন্ডারপাস ব্যবহার করে হজক্যাম্প থেকে সরাসরি বিমানবন্দরের টার্মিনালে যাওয়া যাবে। আবার বিমানবন্দর টার্মিনাল থেকে সরাসরি এমআরটি স্টেশনে যাওয়া যাবে। যাত্রী ও পথচারীরা এর মাধ্যমে নিরাপদে বাস, বিমানবন্দর ও রেলস্টেশনে পৌঁছতে পারবেন।
সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী জানিয়েছেন, এ বছরের শেষের দিকে শুরু হবে আন্ডারপাসটির  নির্মাণকাজ। আগামী দুই বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২০২৫ সালের জুনে প্রকল্পের কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। রেলওয়ে স্টেশন এবং এর চারপাশে অবস্থিত বেশ কয়েকটি বাস ও মেট্রো স্টেশনসহ রাজধানীর ব্যস্ততম পয়েন্টগুলোর মধ্যে একটি হচ্ছে বিমানবন্দর গোলচত্বর। এই এলাকায় একটি মাত্র ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে ঝুঁকি নিয়ে প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রী চলাচল করে। তিনি বলেন, বর্তমানে গাজীপুর হয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের সঙ্গে যুক্ত বিমানবন্দর সড়কে প্রতিনিয়ত তীব্র যানজট দেখা যায়। ফুটওভার ব্রিজ অপ্রতুল হওয়ায় বিপুলসংখ্যক যাত্রী ও পথচারী এর নিচ দিয়েই রাস্তা পার হওয়ার চেষ্টা করে বলে এ জায়গায় প্রায়ই তীব্র যানজট হয়। ঘটে দুর্ঘটনা। আন্ডারপাসটি তৈরি হলে যানজট ও দুর্ঘটনা কমবে বলে আশা করা হচ্ছে।

আন্ডারপাসটি হবে শতভাগ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত। এতে থাকবে ৮টি লিফট, ২৮টি এসকেলেটর ও ২৫টি ট্রাভেলেটর।
প্রকল্প প্রস্তাবে বলা হয়েছে, ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক দেশের ৩২ জেলাকে সংযুক্ত করেছে। ব্যস্ততম এই মহাসড়কের একপাশে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও বিপরীত পাশে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন। বাস্তবায়নাধীন বিমানবন্দর টার্মিনাল-৩, এমআরটি লাইন-১, ঢাকা-আশুলিয়া এক্সপ্রেসওয়ে এবং বিআরটি প্রকল্পের চলমান কাজ এখন বিশাল কর্মযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। সডক ও জনপথ বিভাগের এই প্রকল্পটি বাস্তবয়ন করবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেড।

জেপিজেড কনসাল্টিং (বাংলাদেশ) লিমিটেড এই প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাই করেছে। আন্ডারপাসগুলোয় লিফট, এসকেলেটর, ট্রাভেলেটর ও অন্যান্য সুবিধা থাকবে। উন্নয়ন প্রকল্পের প্রস্তাব পাওয়ার পর পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্ট  কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেছে। তাদের ‘সামান্য তবে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনসহ’ তা পুনরায় জমা দিতে বলা হয়েছে।
এদিকে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, হজরত শাহজালাল বিমানবন্দরের সাম্প্রতিক মাস্টার প্ল্যানে একটি মূল পথচারী টানেল নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। বিমানবন্দরের এ মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের আগে ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হয়েছিল। সমীক্ষা অনুযায়ী, বিমানবন্দরটি ২০৩৫ সালের মধ্যে ২ কোটি ২০ লাখ যাত্রী পরিবহন করবে।
জানতে চাইলে সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, এ প্রকল্পের সব প্রক্রিয়া শেষ করতে হবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই। যত দ্রুত সম্ভব এটা করতেই হবে। জনগণের কল্যাণের কথা বিবেচনা করেই প্রকল্পটিকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। 
এই প্রকল্প  সম্পর্কে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, আগামী অক্টোবরে উদ্বোধন করা হচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত থার্ড টার্মিনাল। যদিও পুরোদমে সেটা চালু হতে আরও কমপক্ষে এক বছর সময় লাগবে। তারপরও আংশিক উদ্বোধনের পরও যাত্রী সাধারণের চাপ বাড়বে। থার্ড টার্মিনাল কেন্দ্রিক কর্মব্যবস্তায় গোটা বিমানবন্দর এলাকায় বড় ধরনের যানজট ও মানুষের জটলা দেখা দেওয়ার আশংকা রয়েছে। বিশেষ করে ওই এলাকা এখন এমনিতেই বেশ কটি বড় প্রকল্পের জংশনে পরিণত হয়েছে। যেমন-বিআরটি, এমআরটি, এলিভেটেডসহ আরও কয়েকটি স্থাপনা।

এতে করে মানুষের মনে একটা কৌতূহল  দেখা দিচ্ছে, এসব প্রকল্প চালু হলে গোলচত্বরের অবস্থা কতটা ব্যস্ততম পয়েন্টে পরিণত হতে পারে, সেটাই দেখার বিষয়। এ ধরনের বাস্তবতা থেকেই জনগণের স্বার্থে এই এলাকাকে  আরও সমৃদ্ধ করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে নেওয়া হয়েছে এই আন্ডারপাস প্রকল্পটি। এটি খুব দ্রুততম সময়েই শুরু ও শেষ করা হবে বলে প্রধানমন্ত্রীকেও আশ্বস্ত করা হয়েছে। কাজেই এই আন্ডারপাস তৈরি করা হলে বদলে যাবে বিমানবন্দর গোলচত্বরের পুরো দৃশ্যপট। 
উল্লেখ্য, বর্তমানে  সেতু কর্তৃপক্ষ ২টি এলিভেটেড এক্সপ্রেসয়েও নির্মাণ করছে। এর একটি বিমানবন্দর থেকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত এবং অন্যটি বিমানবন্দর থেকে নবীনগর-চন্দ্রা মহাসড়েেকর ঢাকা ইপিজেড পর্যন্ত।  ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত দেশের প্রথম ভূগর্ভস্থ মেট্রো রেল (ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট লাইন-১) বাস্তবায়নের কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। পাশাপাশি বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ডেডিকেটেড বাস করিডর নির্মিত হচ্ছে যা বিআরটি নামে পরিচিত।

পাশাপাশি চলছে বহুল আলোচিত মেগা প্রকল্প থার্ড টার্মিনালের কাজ। এ সব প্রকল্প  সম্পর্কে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. ইসহাক বলেন, ‘বিমানবন্দর এলাকাটি পরিবহন কেন্দ্রে পরিণত হবে। আন্ডারপাসটিতে এক মোড থেকে অন্য মোডে যাতায়াতের সুবিধা পাওয়া যাবে। সত্যিকাার অর্থেই জনগণের অভাবনীয় সুবিধা হবে। 

×