ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫, ২ মাঘ ১৪৩১

​​​​​​​তদন্ত শুরু করেছে গোয়েন্দা সংস্থা

১২ ওয়ারেন্ট নিয়েও ঘুরে গেছেন আরাভ খান!

​​​​​​​শংকর কুমার দে

প্রকাশিত: ২৩:৫৫, ১৯ মার্চ ২০২৩

১২ ওয়ারেন্ট নিয়েও ঘুরে গেছেন আরাভ খান!

.

পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার পলাতক আসামি দুবাইয়ের স্বর্ণ ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম ওরফে আরাভ খান ১২ ওয়ারেন্ট মাথায় নিয়ে দুবাই থেকে একাধিক বার দেশে এসে ঘুরে গেছেন। গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মাথায় নিয়েই তিনি দেশে এসেছিলেন গত ফেব্রুয়ারিতে। এর আগে গত বছরের মার্চ মাসেও বাংলাদেশে এসেছিলেন তিনি। আসার সময়ে দুবাইয়ের বাংলাদেশ কনস্যুলেট থেকে ভিসা নিয়েছিলেন তিনি। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে ইমিগ্রেশন পার হয়ে দুবাই থেকে এতগুলো ওয়ারেন্ট মাথায় নিয়ে দেশে এসে কিভাবে ঘুরে গেলেন, সেই বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে গোয়েন্দা সংস্থা। তাকে দেশে ফেরাতে ইন্টারপোলকে চিঠি দেওয়া হলেও এখনো পর্যন্ত ইন্টারপোলের রেড নোটিসের তালিকায় তার নাম নেই। এখন আবার তার নাম রেড নোটিসে অপরাধীর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে দেশে ফেরানোর প্রক্রিয়া শুরু করার অনুরোধ জানিয়ে চিঠি দেবে পুলিশ সদর দপ্তর।

রূপকথার কল্পকাহিনীর মতো কোনো আলাদিনের চেরাগের ছোঁয়ায় দরিদ্র থেকে এত অল্প সময়ে শত শত কোটি টাকার মালিক বনে গেলেন কিভাবে, সেই বিষয়ে তদন্ত করার জন্য সিআইডিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন সংস্থাকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আরাভ খানের সঙ্গে প্রভাবশালী মহলের সখ্যতা থাকার বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পুলিশ খুনের মামলার পলাতক আসামি আরাভ খান ওরফে রবিউল ইসলামের বাবা ছিলেন একজন ফেরিওয়ালা। তিনি ভাঙ্গাড়ির ব্যবসা করতেন। এলাকায় শুধু একটি ঘর আর সামান্য জমি। এই তো মাত্র কয়েকদিন আগে আরাভ খান তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার হিরণ ইউনিয়নের আশুতিয়া গ্রামে এসে তার পুরো পরিবারকে দুবাই নিয়ে গেছেন। আরাভের বাবার নাম মতিউর মোল্লা। আরাভ ছোটবেলায় বাগেরহাটের চিতলমারিতে থাকত। আশুতিয়া গ্রামে খুব অল্প সময় থেকে আরাভ ঢাকায় আসেন। এরপর ঢাকা থেকে চলে যান কলকাতায়। কলকাতা থেকে দুবাই চলে যান তিনি। মাঝেমধ্যে তিনি আমেরিকা, ইউরোপ যান। কিছুদিন আগে তার বাবা-মা দুই বোনকে দুবাই নিয়ে গেছেন। আরাভের একটি ছেলে সন্তান আছে। সে দাদা-দাদির সঙ্গেই থাকত। তাকেও দুবাই নিয়ে গেছেন আরাভ।

আরাভের বাবা মতিয়ার রহমান মোল্লা একসময় বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলায় ফেরি করে সিলভারের হাঁড়িপাতিল বিক্রি করতেন। এখানেই ১৯৮৮ সালে সোহাগ মোল্লার (আরাভ) জন্ম হয়। ২০০৫ সালে চিতলমারী সদরের একটি বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে। দারিদ্র্যতার কারণে এরপরে আর তার লেখাপড়া হয়নি। চিতলমারী থেকে ২০০৮ সালে ভাগ্যের অন্বেষণে তিনি ঢাকা চলে আসেন। ঢাকায় পুলিশ হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকা-ের অভিযোগে বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে ডজনখানেক মামলা হয়। খুনের ঘটনার পর তিনি পলাতক থাকেন। বারবার নাম পরিবর্তন করে সোহাগ মোল্লা, মোল্লা আপন, রবিউল ইসলাম রবি, শেখ হৃদি আরাভ খান নাম ধারণ করেন। তার বিরুদ্ধে পুলিশ খুনের মামলা তো আছেই, এছাড়া ধর্ষণ, নারী নির্যাতন, হত্যা অস্ত্র মামলাসহ গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়া থানাতেই আছে নয়টি মামলার ওয়ারেন্ট। পুলিশের খাতায় তিনি দীর্ঘদিন ধরে পলাতক।

কোটালীপাড়া থানার ওসি মো. জিল্লুর রহমান বলেছেন, সোহাগ মোল্লা ওরফে মোল্লা আপন ওরফে রবিউল ইসলাম রবি ওরফে শেখ হৃদি ওরফে আরাভ খানের বিরুদ্ধে পর্যন্ত নয়টি ওয়ারেন্ট আমার থানায় এসেছে। আমি ওয়ারেন্টগুলো তামিল করার জন্য চেষ্টা করেছি। কিন্তু তার কোনো হদিস পাইনি।

কোটিপতি জেলখাটার গল্প শোনালেন আরাভ আরাভ খান সম্প্রতি ফেসবুক লাইভে এসে তার কোটিপতি হওয়ার গল্প বলেন।  তিনি বলেন, আমি একজন দিনমজুরের ছেলে। আমি ঢাকায় এসে অনেক কষ্ট করেছি। হোটেলে কাজ করেছি। অনেক কষ্ট করে আমি আজ অবস্থানে এসেছি। অনেক কষ্ট করে আমি আমার এই ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান দাঁড় করিয়েছি। আল্লাহ যদি আমাকে সুস্থ রাখেন, তাহলে শীঘ্রই দেশের ৬৪টি জেলায় মসজিদ নির্মাণ করব। এখানে আমার কিছু ব্যবসায়িক প্রতিপক্ষ তৈরি হয়েছে। তারাই আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা রটাচ্ছে। গণমাধ্যমে যেসব খবর আসছে তা পুরোপুরি সত্য নয় বলে উল্লেখ করেন এই আলোচিত স্বর্ণ ব্যবসায়ী। নিজের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মামলার কথা তুলে ধরে আরাভ খান বলেন, আমার নামে মামলা হয়েছে কথা সত্য। তবে আমি কোনো হত্যাকা-ের সঙ্গে জড়িত নই। পুলিশ আমাকে অস্ত্র মামলায় জেলে দিয়েছে। কথা সত্য। তবে আমি দোষী না। আমি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে বিভিন্ন সময় জেলে গেছি। আবার জামিনে বেরিয়ে এসেছি। আদালত যদি আমাকে সাজা দেন, তা হলে আমি সে সাজা মাথা পেতে নেব।

আরাভ জুয়েলার্সের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আরও তারকা ক্রিকেট তারকা সাকিব আল হাসান ইউটিউবার হিরো আলম দুবাইয়েআরাভ জুয়েলার্স উদ্বোধন করতে গেলে সারাদেশে আলোচনায় আসেন আরাভ খান। তারকা ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান আরাভ খানের স্বর্ণের দোকান উদ্বোধন করতে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হওয়ার পর থেকে শুভেচ্ছা জানিয়ে ভিডিওবার্তা দিয়েছেন দেশের অনেক তারকা। আরাভের আমন্ত্রণেআরাভ জুয়েলার্স উদ্বোধন করেছেন নির্মাতা দেবাশীষ বিশ্বাস, গায়ক ইসরাত জাহান জুঁই, আরফিন আকাশ, মাইনুল আহসান নোবেল, জাহেদ পারভেজ পাবেল, বেলাল খান রুবেল খন্দকার। এসব তারকার বিষয়ে খোঁজখবর নিচ্ছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

বাংলাদেশে এসে ফিরে গেলেন কিভাবে পুলিশ পরিদর্শক মামুন ইমরান খান হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি আরাভ খান গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকার পরও গত বছরের মার্চ এবং সবশেষ গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন। ফেসবুক লাইভে তিনি তাঁর উপস্থিতির জানান দিয়েছিলেন। গত এক বছরে বাংলাদেশ সফরের সময় তিনি দুবাইয়ের বাংলাদেশ কনস্যুলেট থেকে ভিসা নিয়েছিলেন। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরের ইমিগ্রেশন পার হয়ে ঢাকায় এসেছেন তিনি। শুধু তাই নয়, তার বিরুদ্ধে প্রায় এক ডজন গ্রেপ্তারি পরোয়ানা থাকা সত্ত্বেও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখে ধুলা দিয়ে কিভাবে বাংলাদেশে এসে পরিবার পরিজনকে নিয়ে দুবাই চলে গেলেন? গত ১২ মার্চ দুবাইয়ের বাংলাদেশ শিল্পী সমিতির বর্ষপূর্তির অনুষ্ঠানে পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন আরাভ খান। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দুবাইয়ে বাংলাদেশের দূতাবাসের একজন কর্মকর্তা। তিনি ওই অনুষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকের হাতে ক্রেস্ট তুলে দিয়েছিলেন। কিভাবে এমন সব ঘটনা ঘটল, সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজছেন গোয়েন্দারা।

শৈশব থেকেই উচ্চাভিলাষী আরাভ শৈশবের রবিউল ইসলাম হতে চেয়েছিলেন রূপালী পর্দার অভিনেতা বা মডেল। অভাব-অনটনের সংসার  হলেও শৈশব থেকেই ছিলেন উচ্চাভিলাষী। বাগেরহাটের চিতলমারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে (এসএম মডেল স্কুল) পড়াশোনার পাঠ চুকিয়ে পাড়ি জমান ঢাকায়। যাতায়াত শুরু করেন এফডিসিতে। নানা কৌশলে মডেলিংয়ের জগতে প্রবেশ করেন। উঠতি বয়সী অনেক নারী মডেলের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। সমাজের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের টার্গেট করে ওই মডেলদের মাধ্যমে ব্ল্যাকমেইল করতে থাকেন। এভাবে প্রভাবশালী অনেক ব্যক্তির ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। একপর্যায়ে মডেলিং থেকে হাঁটতে শুরু করেন অপরাধজগতে। জড়িয়ে পড়েন খুনসহ নানা অপরাধে। এতে তার সঙ্গী ছিল দেশের আরও কয়েক বিতর্কিত মডেল কথিত প্রযোজক। এসব করতে গিয়ে অনেক মেয়ের সঙ্গে তার পরিচয় হয়।

তাদের দিয়ে গুলশান-বনানীকেন্দ্রিক বড় চক্র গড়ে তোলেন। বদলে যেতে থাকে তার চলাফেরা চালচলন। শূন্য হাতে ঢাকায় আসা যুবক হয়ে ওঠেন প্রভাবশালী। এরপর তার বিরুদ্ধে অন্যায়ভাবে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ আসতে থাকে। ্যাবের হাতে গ্রেপ্তার কথিত এক প্রযোজক এবং তার স্ত্রীও হয়েছেন তার সহযোগী। তার স্ত্রী ওই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেছেন। ওই প্রযোজক নিজেকে সরকারের সাবেক এক মন্ত্রীর এপিএস বলে পরিচয় দিতেন। দেশে তিনি আরাভের গুরু হিসাবে পরিচিত। এই চক্রের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ রয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার আরেক বিতর্কিত নারী মডেলের।

স্বর্ণের চোরাচালানে জড়িয়ে পড়েন প্রলোভনে ফেলে টার্গেটকৃত ব্যক্তিদের আপত্তিকর ছবি তুলে ব্ল্যাকমেইল করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া চক্রের সদস্য ছিলেন আরাভ খান। এসবি কর্মকর্তা মামুনকে ডেকে নিয়ে টাকা আদায়ে ব্যর্থ হয়ে হত্যা করেন। হত্যাকা-ের পর পাড়ি জমান দুবাইয়ে। দুবাই গিয়ে জড়িয়ে পড়েন স্বর্ণ চোরাচালানে। সেখানে গড়েছেন হাজার কোটি টাকার সম্পদ।

নেপথ্যে প্রভাবশালী মহল অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একজন কর্মকর্তা বলেছেন, স্বাভাবিক উপায়ে অল্প সময়ে আরাভ খানের এত বিপুল পরিমাণ টাকার মালিক হওয়ার কথা নয়। দুবাইয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের স্বর্ণ চোরাচালানকারীদের একটি চেইন গড়ে উঠেছে, যার পরিচালনায় আছে আরাভ খান। ছাড়া দুর্নীতির টাকা অবৈধভাবে হুন্ডির মাধ্যমে পাচার করা অর্থ তার মাধ্যমে দুবাইয়ে বিনিয়োগ করা হয়েছে। আরাভ খানের হঠাৎ বড়লোক হয়ে ওঠার পেছনের রহস্য খুঁজতে মাঠে নেমেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) আরাভের জুয়েলারি ব্যবসার শত শত কোটি টাকার উৎস কী, সেটা জানার চেষ্টা করছে তারা। পাশাপাশি কোন মাধ্যমে স্বর্ণের চোরাচালান অবৈধভাবে টাকাগুলো দেশের বাইরে পাচার হয়েছে, সেটাও অনুসন্ধান চলছে। আরাভ খানের পেছনে বাংলাদেশের এমন কোনো রাঘব বোয়াল শ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তি থাকতে পারেন, যার সঙ্গে ক্ষমতাসীন দলের যোগাযোগ থাকতে পারে। কারণ অস্ত্র খুনের এক ডজন মামলার ফেরারি আসামি হয়েও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিয়মিতকিছুই হবে না বলে দম্ভোক্তি করছেন আরাভ খান। এটা কিভাবে সম্ভব?

×