ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১

আজ জাতির পিতার ১০৩তম জন্মবার্ষিকী, নানা আয়োজনে পালন করবে কৃতজ্ঞ জাতি

বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২৩:১৩, ১৬ মার্চ ২০২৩

বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব

আজ জাতির পিতার ১০৩তম জন্মবার্ষিকী

‘এই বাংলার আকাশ বাতাস, সাগর, গিরি ও নদী/ ডাকিছে তোমায় বঙ্গবন্ধু, ফিরিয়া আসিতে যদি/ হেরিতে এখনো মানব হৃদয়ে তোমার আসন পাতা/ এখনো মানুষ স্মরিছে তোমারে, মাতা পিতা বোন ভ্রাতা।’...‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা/ গৌরী মেঘনা বহমান/ ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান..’।
মহাকালের আবর্তে অনেক কিছুই হারিয়ে যায়। হারিয়ে যাওয়া এ নিয়মের মধ্যেও অনিয়ম হয় কিছু স্মৃতি, গুটিকয়েক নাম। বাংলা ও বাঙালির কাছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নামটি যেমন। যতদিন বাংলাদেশ থাকবে ততদিন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ এ বাঙালির অবদানের পাশাপাশি তার জন্মের তিথিও চিরজাগরূক থাকবে বাঙালির প্রাণের স্পন্দনে। 
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ গোপালগঞ্জের অজপাড়া টুঙ্গিপাড়ায় জন্ম নেওয়া এক শিশু। ডাক নাম তার খোকা। শিশু থেকে দূরন্ত   কৈশোর। মধুমতি নদীতে সাঁতার কেটে টগবগে যুবকে পরিণত হয় সেই শিশুটি। কালক্রমে এই খোকা হয়ে ওঠেন বাংলার মহানায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। আজ শুক্রবার বাংলার মুকুটমণি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ১০৩তম জন্মবার্ষিকী। সারাদেশে দিনটি জাতীয় শিশু কিশোর দিবস হিসেবে উদযাপিত হবে। 
শতবর্ষ পরেও হয়তো কোনো পিতা তার পুত্রকে বলবেন- ‘জানো খোকা, আমাদের দেশে একজন মানুষ জন্ম নিয়েছিলেন, যার দৃঢ়তা ছিল ইস্পাত কঠিন, মানুষটির বিশাল হৃদয় ছিল, মানুষকে ভালবাসতেন অন্ধের মতো। দিবসের উজ্জ্বল সূর্যালোকে যে বস্তু চিকচিক করে জ্বলে, তা হলো মানুষটির সাহস। আর জ্যোৎ¯œা রাতে রূপালি কিরণধারায় মায়ের ¯েœহের মতো যে বস্তু আমাদের অন্তরে শান্তি ও নিশ্চয়তার বোধ জাগিয়ে তোলে, তা হলো তার ভালোবাসা। জানো খোকা, তার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।’
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্ম নেওয়া শিশুটি খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু, জাতির পিতা হয়ে ওঠার পেছনে যে ইতিহাস সেটার পেছনে মুখ্য ভূমিকা রেখে তার অদম্য সাহস, দেশপ্রেম, মানুষের প্রতি ভালোবাসা আর অসীম ত্যাগ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং শেখ মুজিবুর রহমান এ দুটো যমজ শব্দ, একটা আরেকটার পরিপূরক এবং দুটো মিলে আমাদের জাতীয় ইতিহাসের উজ্জ্বল-প্রোজ্জ্বল এক অচিন্তিত পূর্ব কালান্তরের সূচনা করেছে। 
এ আলোক শিখা ক্রমে ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র, নিকষ কালো অন্ধকারের মধ্যে পরাধীনতার আগল থেকে মুক্ত করতে পথ দেখাতে থাকে পরাধীন জাতিকে। অবশেষে বাংলার পুব আকাশে পরিপূর্ণ এক সূর্য হিসেবে আবির্ভূত হয়, বাঙালী অর্জন করে মুক্তি। স্বাধীন বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু আজ নেই, কিন্তু সে সূর্যের প্রখরতা আগের চেয়েও বেড়েছে অনেকগুণ। তার অবস্থান এখন মধ্যগগনে। সেই সূর্যের প্রখরতা নিয়েই বাঙালি জাতি আজ এগিয়ে চলেছে সামনের দিকে। 
দু’শ’ বছরের পরাধীনতার জিঞ্জির ছিঁড়ে এই বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শী নেতৃত্বেই ১৯৭১ সালে স্বাধীনতাকামী বাঙালির দীর্ঘ নয় মাস মৃত্যুপণ জনযুদ্ধের অনিবার্য পরিণতি হিসেবে অর্জিত হয়েছিল মহামূল্যবান স্বাধীনতা। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদান এবং অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে বাঙালি জাতি অর্জন করে তাদের হাজারও বছরের লালিত স্বপ্ন প্রিয় স্বাধীনতা। বিশ্বের মানচিত্রে স্থাপন করে সার্বভৌম বাংলাদেশ, নিজস্ব লাল-সবুজ পতাকায় আচ্ছাদিত হয় বাঙালির হৃদয়। বঙ্গবন্ধুর আজীবন সংগ্রাম ও দূরদর্শী নেতৃত্বেই পৃথিবীর মানচিত্রে সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।

পূর্ণতা পায় ভাষাভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবাদ। পাকিস্তানি শাসকদের শোষণ-বঞ্চনা, ঔপনিবেশিক লাঞ্ছনা-গঞ্জনা, নিপীড়ন-নির্যাতন থেকে বাঙালি জাতিকে মুক্ত করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু। 
নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ ও দেশের মানুষের প্রতি মমত্ববোধের কারণে বাঙালির ‘জাতির জনক’ উপাধি অর্জন করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য বিংশ শতাব্দীতে যারা মহানায়ক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাদের মধ্যে অন্যতম।

সাম্য, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার বিরামহীন সংগ্রামে অবিস্মরণীয় ভূমিকার কারণে বঙ্গবন্ধু ভূষিত হয়েছিলেন নোবেলখ্যাত বিশ্বশান্তি পরিষদের ‘জুলিও কুরি’ পদকে। বিশ্বের কোটি কোটি বাঙালির হৃদয়ের মণিকোঠায় বঙ্গবন্ধু যে অমলিন, তার প্রমাণ মেলে সারা বিশ্বের বাঙালির ওপর পরিচালিত বিবিসির জরিপে। সারাবিশ্বের বাঙালির শ্রদ্ধাঞ্জলিতে বঙ্গবন্ধু হাজার বছরের শ্রেষ্ঠতম বাঙালি হিসেবে নির্বাচিত হন। 
খোকা থেকে বঙ্গবন্ধু (১৯২০-১৯৭৫) ॥ ১৯৩৮ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি। অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং শ্রমমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গোপালগঞ্জ পরিদর্শনে যান। তাদের আগমনে এক সংবর্ধনার আয়োজন করে কৃষক প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগ। মিশন স্কুল পরিদর্শন শেষে প্রধানমন্ত্রী শের-ই-বাংলা ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন বাংলাতো ফিরে যাচ্ছিলেন, তখন রোগা পাতলা একটি বালক তাদের পথ আগলে দাঁড়ালেন। হতভম্ব সব ছাত্র ও শিক্ষক। 
প্রধান শিক্ষক বারবার ধমক দিচ্ছেন, কিন্তু জেদি, একরোখা, লিকলিকে ছেলেটি নাছোড়বান্দা। প্রধানমন্ত্রীর কাছে দাবি আদায় না করে রাস্তা ছাড়বেন না বলে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বাংলার বাঘ খ্যাত প্রধানমন্ত্রীও অবাক। এতটুকুন ছেলে, অথচ কি অসম সাহসী, যে কি না শের-ই-বাংলার পথ আগলে দাঁড়ায়! তবুও কন্ঠে মাধুর্য এনে বললেন- ‘কি চাও তুমি?’ লিকলিকে বালকের সপ্রতিভ উত্তর, ‘আমাদের স্কুলের একমাত্র ছাত্রাবাসের ছাদ নষ্ট। পানি পড়ে টপটপ করে। ছাত্রদের বিছানাপত্র নষ্ট হয়ে যায়। এ কাজে প্রয়োজন মাত্র ২০০ টাকা। এটা সারাবার ব্যবস্থা না করে দিলে আমি পথ ছাড়ব না।’ অসম্ভব সাহসী, বিনয়ী আর পরোপকারী ছাত্রটির কথায় মুগ্ধ প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে সরকারি ত্রাণ তহবিল থেকে ১২শ’ টাকা মঞ্জুর করে দেন। 
তিনিই হচ্ছেন টুঙ্গিপাড়ার খোকা, পরবর্তীতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। মধুমতি, বাইগার নদীতে সাঁতার কেটে কেটেছে যার দুরন্ত শৈশব। সময়ের পরিক্রমায় এই খোকাই একদিন হয়ে উঠেন বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা। পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব নেয়ার মতো মহান গুণ হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন শৈশবেই। মুষ্টি ভিক্ষার চাল উঠিয়ে গরিব ছেলেদের বই এবং পরীক্ষার খরচ বহন করা, বস্ত্রহীন পথচারী শিশুকে নিজের নতুন জামা পরাতেন। রাজনৈতিক দীক্ষাও নেন স্কুল জীবনেই।

১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের সময়ের কথা বঙ্গবন্ধু তার অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে নিজেই তুলে ধরেছেন- ‘দিন রাত রিলিফের কাজ করে কুল পাই না। লেখাপড়া মোটেই করি না। কলকাতা যাব, পরীক্ষাও নিকটবর্তী। আব্বা একদিন আমাকে ডেকে বললেন, ‘বাবা রাজনীতি কর, আপত্তি করব না। পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করছ, এতো সুখের কথা। তবে লেখাপড়া না শিখলে মানুষ হতে পারবা না।’
চার বোন ও দুই ভাইয়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ছিলেন পিতা শেখ লুৎফর রহমান ও মাতা সায়রা খাতুনের তৃতীয় সন্তান। ৭ বছর বয়সে তিনি পার্শ্ববর্তী গিমাডাঙ্গা    সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। পরবর্তীতে তিনি মাদারীপুর ইসলামিয়া হাইস্কুল, গোপালগঞ্জ সরকারি পাইলট স্কুল ও পরে গোপালগঞ্জ মিশন স্কুলে লেখাপড়া করেন। মাধ্যমিক স্তরে পড়াশোনার সময় বঙ্গবন্ধু চোখের বেরিবেরি রোগে আক্রান্ত হলে কলকাতায় তার চোখের অপারেশন হয়। এই সময়ে কয়েক বছর তার পড়াশোনা বন্ধ থাকে। 
১৯৪২ সালে তিনি ম্যাট্রিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে উচ্চ শিক্ষার্থে কলকাতায় গিয়ে বিখ্যাত ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন এবং সুখ্যাত বেকার হোস্টেলে আবাসন গ্রহণ করেন। ১৯৪৬ সালে তিনি বিএ পাস করেন। শেখ মুজিবুর রহমান এই সময়ে ইসলামিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। এই সময়ে তিনি শীর্ষ রাজনীতিক হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিমের মতো নেতাদের সংস্পর্শে আসেন।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হলে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৪৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে গ্রেপ্তার হন তৎকালীন আইনের ছাত্র যুব নেতা শেখ মুজিব। এর পর দেশে খাদ্য সংকটের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়েও গ্রেপ্তার হন তিনি।
১৯৪৮ সালে ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠায় মুখ্য ভূমিকা পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠা হলে কারাগারে থাকা অবস্থায় দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বঙ্গবন্ধু। 
১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে কারাগার থেকেই নেতৃত্ব দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। মাত্র ৩৩ বছর বয়সে তিনি প্রাদেশিক সরকারের কৃষি, বন ও সমবায় মন্ত্রী হন।  ১৯৫৬ সালে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে গঠিত মন্ত্রীসভায় শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম ও দুর্নীতি দপ্তরের মন্ত্রী হন বঙ্গবন্ধু। 
কিন্তু ছাত্র জীবন থেকেই স্বাধীনতার জন্য বাংলার একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত ছুটে বেড়িয়েছেন বঙ্গবন্ধু প্রতিটি বাঙালির কাছে পৌঁছে দিয়েছেন স্বাধীনতার শিকল ভাঙার গান। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হলে ফের গ্রেপ্তার হন শেখ মুজিব। বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ১৯৫৮-এর সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনসহ প্রতিটি স্বাধীকার আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সবার প্রিয় ‘মুজিব ভাই’। 
পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর হাত থেকে বাঙালির মুক্তির জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দাবি ঘোষণা করেন। ওই বছরেই তিনি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৭ সালে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র’ নামে এক মামলায় পুনরায় গ্রেপ্তার করা হয় বঙ্গবন্ধুকে। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে দেশের ছাত্র-জনতা। ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনের চাপে ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হয়। ঊণসত্তরের ২৩ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ১০ লাখ লোকের উপস্থিতিতে তাকে দেওয়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে পুরো বাঙালি জাতির পক্ষ থেকে শেখ মুজিবুর রহমানকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন তৎকালীন ডাকসু ভিপি বর্তমান আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ।
স্বাধীনতার জন্য পুরো জাতিকে একসূতোই গাঁথতে থাকেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করে। স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার গঠন করার কথা। কিন্তু তৎকালীন সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পিপলস পার্টির প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে সংসদ অধিবেশন ডাকার পর স্থগিত ঘোষণা করে। প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। পূর্ব বাংলায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে পশ্চিম পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধুর অঙ্গুলী হেলনে পূর্ব বাংলা পরিচালিত হয়। 
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে স্বাধীনতার ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এর পর ইয়াহিয়া ও ভুট্টো ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গোলটেবিল বৈঠক করেন। এতে কোনো সুরাহা না হওয়ায় ২৫ মার্চ  রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, চালায় ইতিহাসের কলঙ্কজনক গণহত্যা। বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা ঘোষণা দেন এবং বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণা তৎকালীন ইপিআরের ওয়্যারলেসের মাধ্যমে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
শুরু হয়ে যায় মহান মুক্তিযুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাকে রাষ্ট্রপতি করে বিপ্লবী সরকার (মুজিবনগর সরকার) গঠন করা হয়। এই সরকারের নেতৃত্বেই ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয় মহার্ঘ স্বাধীনতা। বাংলাদেশ পায় একটি স্বাধীন দেশ, স্বাধীন মানচিত্র। দেশ স্বাধীন হলে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু দেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ’ সংক্ষেপে বাকশাল নামে সর্বদল ভিত্তিক একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন এবং এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন বঙ্গবন্ধু। 
১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন। তিনি শিল্পকারখানা, ব্যাংক-বিমা জাতীয়করণ করে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করেন। ১৯৭৩ সালে বিশ্ব শান্তি পরিষদ বঙ্গবন্ধুকে নোবেলখ্যাত ‘জুলিও কুরি’ পদকে ভূষিত করেন। কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতিই শুধু নয়, তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধী লোকসভায় দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা; হিসেবে স্বীকৃতি দেন। দেশকে স্বাধীন করতে জীবনের মূল্যবান ১৩টি বছর কারাগারে কেটেছে বঙ্গবন্ধুর। দীর্ঘ ২৩ বছরের সংগ্রামে তিনি শত যন্ত্রণা, দুঃখ, কষ্ট-বেদনা সহ্য করেছেন, ফাঁসির মঞ্চও যাঁর কাছে ছিল তুচ্ছ- তিনি হচ্ছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি শেখ মুজিবুর রহমান।
একাত্তরের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানি জল্লাদরা কারাবন্দি রেখে কবর খুঁড়েও যাকে হত্যা করার সাহস পায়নি; অথচ স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় সেই হিমালয়সম ইস্পাত-কঠিন দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট একাত্তরের পরাজিত শক্তির প্রেতাত্মা নরপিশাচ ঘাতকরা হত্যা করে ক্ষমতার পালাবদল করেছিল। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের হয়ে কাজ করা ঘাতকচক্রের বুলেটে সেদিন ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল বাংলাদেশের হৃৎপিন্ড।  

কিন্তু তার পরও একটি জাতি ও অবহেলিত মানুষের মুক্তির অগ্রদূত হিসেবে বঙ্গবন্ধু শুধু দেশে নয়, সারা বিশ্বেই ইতিহাস হয়ে রয়েছেন। কারণ বঙ্গবন্ধু যে চিরঞ্জীব, চির অমলীন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম দেশের জন্য তার সুমহান আত্মত্যাগের ইতিহাস পড়ে নতুন শপথে বলীয়ান হবে, দেশকে ভালবাসবে, স্বাধীনতাবিরোধীদের সকল ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের ক্ষুধা-দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে ব্রতী হবে। 
‘৭৫-পরবর্তী ইতিহাসের এই রাখাল রাজার নাম মুছে ফেলার অনেক ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীদের সকল ষড়যন্ত্রই ব্যর্থ হয়েছে। কারণ বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব। ২১ বছর পর ক্ষমতায় এসে ১৯৯৭ সালে আওয়ামী লীগ সরকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনকে ‘জাতীয় শিশু দিবস’ এবং সরকারি ছুটি ঘোষণা করে। কিন্তু ২০০১ সালে যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াতকে সঙ্গে ক্ষমতায় এসেই বিএনপি ছুটি বাতিল করে দেয়। ২০০৯ সালে ভুমিধ্বস মহাবিজয় নিয়ে ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ সরকার আবারও সরকারি ছুটি ঘোষণা করে।

সেটি এখনও অব্যাহত আছে। তাই আজ সরকারি ছুটির দিন। কৃতজ্ঞ বাঙালি জাতি আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে বাংলাদেশ নামক জাতি রাষ্ট্রের মহান স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। শুভ জন্মদিন, হে জাতির পিতা। 
কর্মসূচি ॥ জাতির পিতার জন্মদিন উপলক্ষে আজ শুক্রবার দেশের সকল সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও  বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ সকল সরকারি ও বেসরকারি ভবন এবং বিদেশে বাংলাদেশ মিশনসমূহে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হবে। বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন এবং জাতীয় শিশু কিশোর দিবস উপলক্ষে আজ টুঙ্গিপাড়ায় গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সমাধীসৌধে পুস্পস্তবক অর্পণ করে শ্রদ্ধা জানাবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দিবসটি উপলক্ষে সেখানে জাতীয় শিশু সমাবেশ ও তিনদিন ব্যাপী বই মেলারও আয়োজন করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় আয়োজিত এই জাতীয় শিশু সমাবেশে যোগ দেবেন। এ ছাড়া বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক সংগঠন দিবসটি উপলক্ষে বিস্তারিত কর্মসূচি গ্রহন করেছে। সরকারি  বেসরকারি টেলিভিশন ও বেতার এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচার করবে।

ভোরে বঙ্গবন্ধু ভবন, কেন্দ্রীয় কার্যালয় এবং সারাদেশে সংগঠনের কার্যালয়ে দলীয় ও জাতীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল সাতটায় ধানমন্ডির বত্রিশ নম্বরে ঐতিহাসিক বঙ্গবন্ধু প্রাঙ্গণে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধার্ঘ্য অর্পণ, সকাল ১০টায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দলের জাতীয় নেতৃবৃন্দের জাতির পিতার সমাধিতে শ্রদ্ধা নিবেদন, দোয়া ও মিলাদ মাহফিল এবং শিশু সমাবেশে অংশগ্রহণ। 
এছাড়া মসজিদ, মন্দির, প্যাগোডা, গির্জাসহ সকল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে দেশব্যাপী বিশেষ দোয়া মাহফিল ও প্রার্থনা কর্মসূচি পালন করবে আওয়ামী লীগ। বাদ জোহর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদসহ সকল মসজিদে দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া আগামী রবিবার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভা, এতে সভাপতিত্ব করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

×