কিশোরগঞ্জের আব্দুল হাই একটি আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন
কিশোরগঞ্জের আব্দুল হাই একটি আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। তিনি কয়েক বছর ধরেই নিয়ত করে আসছেন হজের খরচ আরেকটু কমলে টাকা জমা দেবেন। তার সে ইচ্ছে যেন পূরণ হওয়ার নয়। চার বছর ধরেই হজের খরচ বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে। ফলে এবারও হাইয়ের পক্ষে হজে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
শুধু হাই নয়, তার মতো এ রকম আরও হাজার হাজার নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষ হজ পালন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বিশেষ করে করোনা মহামারির পর এ বছরই বাংলাদেশ তার পূর্ণ কোটায় হজে পাঠানোর সুযোগ পেয়েছে। এতে অনেকেই নতুন করে হজে যেতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
কিন্তু গত মাসে হজের প্যাকেজ ঘোষণা করার পর অনেকেই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। হাইয়ের মতোই হাজার হাজার লোক হজ নিবন্ধন থেকে বিরত রয়েছেন। তাদের একটাই কথা-প্যাকেজ অনুযায়ী এবার কোরবানিসহ ব্যয় সাত লাখ টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এত টাকা খরচ করে হজে যাওয়া সম্ভব নয়। ৩/৪ লাখ টাকা হলে তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল।
এদিকে হজের এত অস্বাভাবিক খরচ বেড়ে যাওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে হাব, আটাবসহ বেশ কয়েকটি ইসলামী সংগঠন। তাদের মতে ঘোষিত প্যাকেজ কোরবানিসহ এবার হজের খরচ পড়বে সাত লাখ টাকার ওপরে। এত টাকা ব্যয়ে এবার অনেকেই হজে যাবেন না। ফলে এবারের একলাখ ২৭ হাজার হাজির কোটাও পূরণ হবে কিনা সে সংশয় দেখা দিয়েছে। এসব সংগঠন প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করে ব্যয় কমানোর দাবি জানিয়েছে। হজের এবারের ব্যয়কে নজিরবিহীন ও তুঘলকি কা- বলে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করে আটাব সভাপতি এসএন মঞ্জুর মোর্শেদ বলেন, দুনিয়ার কোথাও এক লাফে বিমান ভাড়া এত বাড়ানো হয়নি।
শুধু বিমানকে অতি মুনাফা এনে দিতে যারা হাজিদের পকেট কাটার ব্যবস্থা করেছেন-আল্লাহর দরবারে তাদের অবশ্যই একদিন জবাবদিহি করতে হবে। দুনিয়াতেই তাদের এজন্য মাসুল দিতে হবে। এ ব্যয় যদি ৫ লাখের নিচে রাখা যেত তাহলে কোটা পূরণ হতো। বিমানসহ সবারই লাভ হতো। এখন যদি সেটা ৫০ হাজারও না হয়- তাহলে তো দিনের শেষে এয়ারলাইন্সগুলোরই ক্ষতি হবে বেশি। পরিস্থিতি এখন সেদিকেই যাচ্ছে।
এদিকে সর্বশেষ বুধবার খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অস্বাভাবিক হারে প্যাকেজ ঘোষণার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ায় বিরূপ প্রভাব পড়েছে নিবন্ধনে। প্যাকেজ ঘোষণার পরদিন থেকেই অনেকেই নিবন্ধন করেও বাতিল করছেন। নিবন্ধনের প্রথম দিনে সাড়াতো মেলেইনি। এমনকি বুধবার পর্যন্তও চিত্র ছিল হতাশাব্যঞ্জক। ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৭ জনের কোটার বিপরীতে ব্যালটি- নন ব্যালটি মিলিয়ে মাত্র ১৭ হাজার হজ যাত্রী নিবন্ধন করেছেন।
নিবন্ধনের এ চিত্র দেখে হজ অফিসের কর্মচারীরাও বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছেন, যেখানে আগে নিবন্ধনের জন্য তদ্বির করা হতো-্এখন সেখানে টাকা তুলে নেওয়ার হিড়িক পড়েছে। ২৩ ফেব্রুয়ারি নিবন্ধনের প্রথম দফার তারিখ শেষ হলেও মানুষের আগ্রহ চোখে পড়েনি। এখন নতুন করে নিবন্ধনের সময়সীমা বাড়ানো হতে পারে। শুধু হজযাত্রীর সংখ্যা বাড়ানোর জন্য এ সময়সীমা আগামী ১০ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হতে পারে।
এ বিষয়ে একটি হজ এজেন্সির মালিক বলেন, মাঠ পর্যায়ের দালালদের কাছ থেকে যে ধরনের সংবাদ মিলছে- তাতে মনে হয়না এ বছর ৫০ হাজার হজযাত্রীও পাওয়া যাবে। যারা প্রাক নিবন্ধন করেছিলেন তারা এখন টাকা তুলে নিচ্ছেন। তাদের বেশির ভাগই হজের আশা ছেড়ে ওমরাহ করার পরিকল্পনাও করছেন।
হজ অফিস সূত্রে জানা গেছে, আগামী ১০ মার্চের দ্বিতীয় দফা সময়সীমা পর্যন্ত কেমন সাড়া পড়ে সেটা জানা যাবে প্রথম সপ্তাহেই। তখন আনুমানিক হজযাত্রীর সংখ্যা হাতে নিয়ে-সৌদি আরব যাবে হজ অফিসের টিম। তারা সে হিসেবে বাড়ি ভাড়া করবেন।
তবে হজ এজেন্সিগুলোর আশা-সময় বাড়ানো হলে হয়তো নিবন্ধনের সংখ্যা ৫০ হাজার হতে পারে। প্রাক-নিবন্ধন করা কয়েকজন জানান, হজ করতে যাওয়ার অনেক ইচ্ছা ছিল তাদের। কিন্তু এত টাকা খরচ করে হজে যাওয়ার সামর্থ্য নেই তাদের। তাই নিবন্ধন করেও হজে যাচ্ছেন না তারা। আব্দুল হাই জানান, তার পক্ষে এত ব্যয়ে এ বছর আর হজে যাওয়া সম্ভব হবেনা। তার মতোই শরীয়তপুরের বাসিন্দা আলী আকফাতও হজে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বাতিল করেছেন। তিনি জানান, তিনি প্রাক নিবন্ধন করেছিলেন। এখন আর নিবন্ধন করতে ইচ্ছুক নন। তাই ওমরাহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি।
এ সম্পর্কে এজেন্সিগুলোর মালিকও বেশ হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, প্রাক-নিবন্ধন করিয়েছেন, কিন্তু হজে যাচ্ছেন না, এমন মানুষের সংখ্যাই এখন পর্যন্ত বেশি। মূলত হজ প্যাকেজে খরচ বাড়ানোর কারণে এমনটা হচ্ছে। আবার করোনায় আয় কমে যাওয়ার কারণেও অনেকে যাচ্ছেন না বলে জানান। প্রতি বছর হাজিদের নিয়ে যে ব্যস্ততা থাকার কথা, এ বছর তেমন দেখা যাচ্ছে না।
উল্লেখ্য, এবছর কোরবানির খরচ ছাড়া হজের প্যাকেজ ধরা হয়েছে- সরকারিভাবে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৮ টাকা আর বেসরকারিভাবে ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা। কোরবানিসহ এ ব্যয় সাত লাখ ছাড়িয়ে যাবে। যা নি¤œ মধ্যবিত্তের ধারণাতীত। তাদেরই একজন হাই জানান, কয়েক বছর ধরে স্বপ্ন দেখছেন হজে যাবেন। পরিবারের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনাও করেছেন। খরচের হিসাবও মিলিয়েছিলেন। কিন্তু মহামারি করোনার পরের বছর হজযাত্রার বাড়তি খরচ ও বিধিনিষেধ থাকায় তার আর যাওয়া হয়নি। সে বছর হজের প্যাকেজ ছিল পাঁচ লাখ ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা। ভেবেছিলেন এ বছর হয়তো খরচ অনেকটা কমে যাবে। সে অনুযায়ী তিনি টাকার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু এ বছর সরকার নির্ধারিত হজের প্যাকেজ মূল্য ধরা হয়েছে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৫ টাকা। যা গত বছরের তুলনায় ১ লাখ ৫৫ হাজার ৬৭৫ টাকা বেশি। বাড়তি খরচের কারণে এ বছরও তিনি হজে যেতে পারছেন না।
এদিকে হজের অস্বাভাবিক ব্যয় কমানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছে ট্রাভেল এজেন্সিদের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব) সংস্কার সভাপতি এসএন মঞ্জুর মোর্শেদ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বলা হয়- এ বছর হজযাত্রায় প্রত্যেক হজযাত্রীর ছয় লাখ ৮৩ হাজার ১৮ টাকা বয় হবে। গত বছরের তুলনায় খরচ সর্বোচ্চ এক লাখ ৬১ হাজার ৮৬৮ টাকা বেড়েছে। পাশাপাশি কোরবানি ছাড়া বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজযাত্রীদের জন্য প্যাকেজ মূল্য ৬ লাখ ৭২ হাজার ৬১৮ টাকা নির্ধারণ করেছে হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব)।
হজে যাওয়ার প্লেন ভাড়া কমিয়ে হজের প্যাকেজ আরও সহনীয় পর্যায়ে আনতে হবে। চিঠিতে বলা হয়েছে- ধর্ম মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুসারে ২০১৫ সালে হজের সর্বনিম্ন খরচ ছিল ২ লাখ ৯৬ হাজার ২০৬ টাকা। ২০১৬ সালে ৩ লাখ ৪ হাজার টাকা, ২০১৭ সালে লাখ ১৯ হাজার টাকা, ২০১৮ সালে ৩ লাখ ৩১ হাজার টাকা, ২০১৯ সালে ৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। করোনা মহামারির কারণে ২০২০ ও ২০২১ সালে বাংলাদেশ থেকে হজে যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ ছিল। ২০২২ সালে হজ প্যাকেজের মূল্য ছিল ৫ লাখ ২৭ হাজার ৩৪০ টাকা এবং ২০২৩ সালে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে।
ধর্ম মন্ত্রণালয়ের হিসেবে বিবেচনায় নিলে, ২০১৯ সালের তুলনায় ২০২৩ সালে হজের ব্যয় বেড়েছে ৩ লাখ ৩৮ হাজার ১৫ টাকা। এই বছর সৌদি সরকার হজের আনুষঙ্গিক ব্যয় কমিয়েছে। গত ২০১৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৬ বছরে হজ যাত্রীদের নির্ধারিত বিমান ভাড়া ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে বং ২০২৩ সালে নির্ধারিত বিমান ভাড়া পূর্বের তুলনায় প্রায় ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়। মূলত বিমান ভাড়া বৃদ্ধি পাওয়ায় অস্বাভাবিকভাবে হজের প্যাকেজের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
জানতে চাইলে হাব সভাপতি শাহাদত হোসেন তসলিম বলেন, এয়ারলাইন্সগুলো আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের পরামর্শ না করেই তারা ইচ্ছেমতো ভাড়া বাড়িয়েছে। ডলার আর রিয়ালের দাম বাড়ার অজুহাতে হজের খরচ বাড়ানো হয়েছে প্রায় দ্বিগুণ। অথচ তেলের দাম তো সে হারে বাড়েনি। ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলার ও তেলের দামের অজুহাতে হাজিদের পকেট কাটার আয়োজন কর হয়েছে। এমন ব্যয় বৃদ্ধি না কমানো হলে এবার মোট কোটার অর্ধেকও পূরণ হয় কিনা সন্দেহ। আমরাও চাপের মুখে আছি। এজেন্সি মালিকরা খরচ কমানোর জন্য প্রতিদিন আমাদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে। কিন্তু কোনো সমাধান দেখছি না। যদি বিমান ভাড়া কমানো যায়- তবেই সম্ভব এ খরচ ৬ লাখের নিচে নামানো।
তিনি বলেন, প্রতি বছর যাত্রীদের খরচের বড় একটি অংশ যায় বিমানের টিকিটে। প্রতি বছর বিমান শুধু হজ ফ্লাইট থেকে বড় অঙ্কের মুনাফা করে। যা বিমানের আয়ের প্রায় ১৫ শতাংশ। অথচ সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে তারা চাইলে অল্প মুনাফা ধরে ভাড়া প্রস্তাব করতে পারে। এতে করে হজযাত্রীদের প্যাকেজের মূল্য অনেকটা কমে যায়। তারা কিছুটা হলেও আর্থিকভাবে স্বস্তি পান। তাই বিমান ভাড়া যৌক্তিক পর্যায়ে রাখতে স্বতন্ত্র টেকনিক্যাল কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেছিল হাব। সেটাও আমলে নেওয়া হয়নি। যেখানে সৌদি আরবসহ অনেক দেশ হজের খরচ কমাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশে খরচ বাড়ছে।