
গণপরিবহন
- চার বছরেও বন্ধ হয়নি চুক্তিভিত্তিক বাস চালনা
- রাজধানীতে দেড় হাজার বাসের
- রুট পারমিট নেই, ফিটনেস নেই এক হাজারের
বিশৃঙ্খল রাজধানীর গণপরিবহন ব্যবস্থা। এর মূল কারণ চুক্তি ভিত্তিক বাস পরিচালনা। মালিকের কাছে দৈনিক জমা হিসেবে বাস বুঝে নেয় চালকরা। দিনে যত ট্রিপ তত লাভ বাস শ্রমিকদের। চুক্তির টাকা পরিশোধের পর যা আয় হয়, সব বাস চালক ও সহকারীর পকেটে যায়। চুক্তি ভিত্তিক গাড়ী চালানোর কারণে একই রুটে বিভিন্ন কোম্পানির বাস চালকদের মধ্যে চলে প্রতিযোগিতা। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফলে প্রতিনিয়ত ঘটছে সড়ক দুর্ঘটনা।
ঢাকায় বাসের অসুস্থ প্রতিযোগীতা বন্ধের জন্য ২০১৮ সালে চুক্তি ভিত্তিক বাস পরিচালনা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিলো সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। কিন্তু গত চার বছরেও এই ঘোষণা পুরোপুরি কার্যকর হয় নি। নতুন করে ঢাকার গণপরিবহনে ৪৫ টি রুটে ই-টিকেটিং পদ্ধতি চালু করা হয়েছে। কিন্তু চুক্তি ভিত্তিক বাস চালানো বন্ধ হয়নি।
রাজধানীর গুলিস্তান এলাকায় স্বপন নামে শিড়ক পরিবহনের এক চালক জনকণ্ঠ’কে বলেন, ‘চুক্তিতে বাস চালালে আমাদের লাভ বেশি হয়। এখনো আমাদের বেতনভুক্ত করা হয় নি। দিনে যা আয় হয় এর মধ্যে ২০০০-২৫০০ টাকা জমা দিতে হয়। বাকি টাকা আমাদের থাকে। বেশি যাত্রীর জন্য একই নাম্বারের (কোম্পানির) বাসের মধ্যে পাল্লাপাল্লি হয়।’
২০১৯ সালে বাসের প্রতিযোগিতার কারণে সড়ক দুর্ঘটনায় এক শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় সু-প্রভাত ও জাবালে নূর নামের দু’টি কোম্পানির বাসের লাইসেন্স বাতিল করেছিল সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। এর আগেও ২০১৮ সালের জুলাই মাসে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে দু’টি বাসের প্রতিযোগিতার কারণে বাসচাপায় দুই কলেজশিক্ষার্থী নিহত হয়। ওই সময় জাবালে নূরের দুটি বাসের রুট পারমিট বাতিল করা হয়েছিল। কিন্তু তারপরও বন্ধ হয় নি সড়কের বাসের অসুস্থ প্রতিযোগীতা।
সর্বশেষ গত রবিবার রাজধানীর প্রগতি সরণিতে ভিক্টর পরিবহনের একটি বাসের চাপায় নাদিয়া নামের এক শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন। বাসের প্রতিযোগিতার কারণে পিছন থেকে নাদিয়াদের মোটরসাইকেলে ধাক্কা দেয় ভিক্টর পরিবহন। এতে রাস্তায় ছিটকে পড়েন নাদিয়া ও তার বন্ধু। এরপর বাসটি নাদিয়াকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। এ সময় নাদিয়ার বন্ধুও গুরুতর আহত হন বলে স্থানীয়রা জানান।
ইচ্ছেমত চলছে ঢাকার গণপরিবহন সার্ভিস
সড়ক পরিবহন আইন থাকলেও বাস্তবে পুরোপুরি তা মানা হচ্ছে না। তাই ইচ্ছেমত চলছে ঢাকার গণপরিবহন সার্ভিস। রাজধানীতে বেশিরভাগ বাস-মিনিবাস চলছে রুট পারমিট ছাড়াই। কিছু বাস কোম্পানি রুট পারমিট থাকলেও নির্ধারিত রুটে তা চলাচল করে না। বেশি যাত্রীর আশায় এক রুটে একাধিক কোম্পানির বাস চলাচল করে। ঢাকা মহানগরীতে রুট পারমিটবিহীন কি পরিমাণ বাস-মিনিবাস চলাচল করে এর কোন পরিসংখ্যা নেই সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)’র কাছে।
বিআরটিএ’র সূত্র জানায়, ঢাকায় বাস-মিনিবাসের রুট পারমিট দেয় ঢাকা মেট্রোপলিটন রিজিওনাল ট্রান্সপোর্ট কমিটি (আরটিসি)। এই কমিটির আহবায়ক হলেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার। এছাড়া সড়ক পরিবহন মালিক-শ্রমিক সংগঠনের নেতার সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে এই কমিটি। ২২ সদস্য বিশিষ্ট এই কমিটির সদস্য সচিব হলে বিআরটিএ’র ঢাকা অঞ্চলের পরিচালক। কিন্তু গত দুই বছর যাবত এই কমিটি কোন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান।
এ বিষয়ে বিআরটিএ’র পরিচালক (ইঞ্জিনিয়ারিং) শীতাংশু শেখর বিশ্বাস জনকণ্ঠ’কে বলেন, ‘ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের মেয়রের নেতৃত্বে বাস রুট রেশনালাইজেশন কমিটি থাকায় বর্তমানে আরটিসি’র কার্যক্রম স্থবির অবস্থায় আছে। আরটিসি আগে যে সব রুট অনুমোদন দিয়েছিলো সেগুলো বর্তমানে চলাচল করছে। বর্তমানে রুটগুলো কি অবস্থা এর কোন হালনাগাদ তথ্য আমাদের কাছে নেই।’ তবে একটি বাসকে তিন বছর পর পর রুট পারমিট নবায়ন করতে হয় বলে জানান তিনি।
সড়ক পরিবহন আইন যথেষ্ট নয়-নিসচা
মঙ্গলবার জাতীয় প্রেসক্লাবের রোড সেফটি কোয়ালিশনের এক সংবাদ সম্মেলনে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা) আন্দোলনের চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন বলেছেন, দুর্ঘটনা রোধের জন্য বর্তমানে সড়ক পরিবহন আইনে (২০১৮) যা আছে তা যথেষ্ট নয়। ওই আইনে নিরাপত্তা বিষয় নতুন অধ্যায় সংযোজন অথবা পৃথক আইন প্রণয়ন করতে হবে। সড়ক কীভাবে নির্মাণ করতে হবে জাতিসংঘ একটি ব্যবস্থাপত্র দিয়েছে। সড়কে গাড়িগুলো কীভাবে চলবে আমাদের আইনে আসেনি। আমরা দাবি করছি, হয়তোবা একটা অধ্যায় যুক্ত করা হোক বা নতুন আইন করা হোক। গাড়ি চলাচলের জন্য সুন্দর জায়গা রাখতে হবে। জাতিসংঘের নিরাপদ সড়ক তৈরির বিষয়টি আমাদের সড়ক আইনের মধ্যে নেই।’ এর জন্যই ওই আইনে নিরাপত্তা বিষয় নতুন অধ্যায় সংযোজন অথবা পৃথক আইন প্রণয়নের দাবি জানাচ্ছি।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে নিচসা’র চেয়ারম্যান বলেন, সড়ককে অধিকতর নিরাপদ করার লক্ষ্যে ২০১৮ সালের সড়ক পরিবহন আইনে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত পাঁচটি পিলার বা ‘সেইফ সিস্টেমস অ্যাপ্রোচ (সড়ক ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ সড়ক, নিরাপদ মোটরযান, নিরাপদ সড়ক ব্যবহারকারী, এবং দুর্ঘটনা পরবর্তী কার্যকর ব্যবস্থাপনা) পদ্ধতিতে একটি পৃথক সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়নের দাবি জানাই।
তিনি বলেন, সড়ক পরিবহন বিধিমালা জারির বিষয়টি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হলেও এতে কিছু সীমাবদ্ধতা রয়ে গেছে। আমাদের বর্তমান সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এবং সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২ মূলত সড়ক পরিবহন আইন এবং সড়ক পরিবহন ব্যবস্থা সংক্রান্ত।
এই আইন ও বিধিমালা সড়ক নিরাপত্তা বিধিমালা নিশ্চিতকরণে যথেষ্ট নয়। কারণ ‘জাতিসংঘের সেকেন্ড ডিকেড অব অ্যাকশন ফর রোড সেইফটি ২০২১-২০৩০’ এ বর্ণিত পাঁচটি পিলার এবং বাংলাদেশ সরকারের অষ্টম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বর্ণিত পাঁচটি পিলারের আলোকে সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের জন্য বর্তমান সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এবং সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২ করা হয়নি। তাই আমরা দাবি জানাচ্ছি, দ্রুততার সঙ্গে পৃথক সড়ক নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করার।
১ হাজার মোটরযানের ফিটনেস নেই-বিআরটিএ
আরটিসি’র রুটের তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা মেট্রোপলিটন পরিবহন কমিটি (আরটিসি)’র অনুমোদিত ৩৮৬টি বাস রুটের মধ্যে বর্তমানে সচল রয়েছে ১২৮ রুট। বাস না থাকায় বন্ধ রয়েছে ২৫৮ টি রুুট। সচল ১২৮টি রুটে ৭ হাজার ৪৯৪ টি বাসের অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু চলাচল করে প্রায় ৬ হাজার। এর মধ্যে ১ হাজার ৬৪৬টি রুমের কোন রুট পারমিট নেই। এক রুটের বাস অন্য রুটে চলে ২ হাজারের বেশি। এছাড়া প্রায় ১ হাজার মোটরযানের ফিটনেস নেই বিআরটিএ’র একটি তালিকায় উল্লেখ করা হয়েছে।
আরটিসি’র তালিকায় দেখা গেছে, রাজধানীর সায়েদাবাদ থেকে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত এ-২২৯ নম্বর রুটে বিভিন্ন মালিকের ২০ টি সিলিং (মোটরযান) অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইস্যুকৃত রুট পারমিট মোটযানের সংখ্যা দেখানো হয়েছে ৮টি। কিন্তু বাস্তবে গাড়ি চলে ৩৬টি। অন্য রুটে গাড়ি রয়েছে ২২টি। রুট পারমিট বিহীন গাড়ি রয়েছে ১৪ টি। ফিটনেস মেয়াদোত্তীর্ণ মোটরযান রয়েছে ৮টি।
একই অবস্থা এ-২৩৬ নম্বর রুটের। সায়েদাবাদ, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, রায়েরবাগ, লিংক রোড় হয়ে নারায়ণগঞ্জ পর্যন্ত এই রুটে ২০ মোটরযানের অনুমোদন রয়েছে। তবে ইস্যুকৃত বাসের সংখ্যা ৯টি। পরিবহন কোম্পানির নাম উৎসব ট্রান্সপোর্ট লিমিটেড। কিন্তু রুটে সব বাস চলাচল করে গুলিস্তান থেকে। এই রুটে ৪০টি বাস চলাচল করে। একটি বাসেও রুট পারমিট নেই। রাজধানীর বেশীর ভাগ রুটের একই অবস্থা বলে জানান সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার জনকণ্ঠ’কে বলেন, ‘ঢাকা মহানগরীতে আরটিসি’র অনুমোদিত রুটের সংখ্যা ছিলো ৩৮৬টি। কিন্তু অনেক রুটে এখন আর বাস চলে না। অনুমোদন নেয়ার পর বাস নামে নি এমন রুটও আছে। আবার এক রুটে অনুমোদন নিয়ে অন্য রুটে চলে। অনেকে আবার রুট পারমিট ছাড়াই কোম্পানীর নাম ব্যবহার করে বাস চালাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমান আদালতের মামলা ও জরিমানা করা হচ্ছে। পুলিশের অসহযোগীতার কারণে পুরোপুরি কার্যক্রম চালানো সম্ভব্য হচ্ছে না বলে জানান তিনি।
পুলিশের অসহযোগীতা বলতে বিআরটিএ’র চেয়ারম্যান বলেন, ‘অভিযান চলাকালে যে গাড়িটা ধরতে বলা হয় পুলিশ তা ধরতে পারে না। ধরে এমন একটি গাড়ি যার রুট পারমিট অন্যান্য কাগজ-পত্র ঠিক আছে। এছাড়া মাঠ পর্যায়ে আইন বাস্তবায়নকারী সংস্থা হলো পুলিশ। সড়কে শৃঙ্খলার জন্য পুলিশেই যথেষ্ট। সারাদেশে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব্য নয়। তাছাড়া বিআরটিএ’র পর্যাপ্ত জনবলও নেই যে সব স্থানে মনিটরিং করবে।’