রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশনের শহীদ এ কে এম শামসুল হক খান অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত গণশুনানির সুপারিশ
পাইকারি পর্যায়ের পর এবার গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দর ১৫ দশমিক ৪৩ শতাংশ বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। এই সুপারিশ কার্যকর হলে ইউনিট প্রতি বিদ্যুতের দাম বেড়ে যাবে ১ টাকা ২১ পয়সা।
রবিবার সকালে রাজধানীর বিয়াম ফাউন্ডেশনের শহীদ এ কে এম শামসুল হক খান অডিটরিয়ামে অনুষ্ঠিত দুই দিন ব্যাপী গণশুনানির প্রথম দিনে এই সুপারিশ উত্থাপন করা হয়। শুনানির বিষয়ে ৬০ কর্মদিবসের মধ্যে বিদ্যুতের দামের ওপর আদেশ ঘোষণা করবে বিইআরসি। গণশুনানিতে বিইআরসির কারিগরি কমিটি প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের খুচরা মূল্য ১ টাকা ২১ পয়সা বাড়িয়ে খুচরা বিদ্যুতের মূল্য গড়ে ৭ দশমিক ১৩ পয়সা থেকে বেড়ে ৮ দশমিক ১৩ পয়সা করার সুপারিশ করে।
শুনানিতে পিডিবির পক্ষ থেকে বলা হয়, প্রতি টন কয়লার দাম ২৩০ ডলার এবং প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েলের দাম ৭০ টাকা হলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেয়ার ক্ষেত্রে ৪০ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি প্রয়োজন হবে। কিন্তু বিআরসি পাইকারি মূল্য বৃদ্ধিতে ১৭ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি নির্ধারণ করে দিয়েছে। কাজেই এই মূল্য কাঠামো ধরে দাম বাড়ানো হলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ দেয়া সম্ভব হবে না।
এসময় পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) তাদের প্রস্তাবে জানায়, দাম না বাড়লে তাদের ক্ষতি হবে ১১২৭ কোটি টাকা। একইভাবে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ২৩৪ কোটি, ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির (ডিপিডিসি) ১৫৫১ কোটি, ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (ডেসকো) ১৪০২ কোটি টাকা, নর্দান ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানির (নেসকো) ৫৩৫ কোটি টাকা লোকসান হবে বলে দাবি করা হয়েছে। ওয়েস্টজোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) কোনও আর্থিক অঙ্ক দাঁড় না করালেও বলেছে, দাম না বাড়লে তাদের ক্ষতি হবে।
অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হলে এর প্রভাব সাধারণ মানুষের ওপর পরবে বলে মনে করছে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশে (ক্যাব)।
শুনানিতে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধি বাজারে সব পণ্যের দাম আরেক দফা বেড়ে যাবে। যেটা সাধারণ বা নিম্ন আয়ের মানুষের আয়সীমা ছাড়িয়ে যাবে। তাই এই মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত উচিত হবে না। তিনি বলেন, পাইকারি বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির পর গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়লে ২০২৩ সালের মূল্যস্ফীতিকে তা উসকে দেবে। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধি জনগণের কষ্ট বাড়িয়ে দিচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বিদ্যুৎ খাতের সিস্টেম লস, অনিয়ম বন্ধে সরকারকে উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান।
বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সংকট ইস্যুতে গত বছরের প্রায় পুরোটা সময় অস্থির অবস্থায় কেটেছে বিদ্যুৎ বিভাগের। লোডশেডিং, সাশ্রয়সহ নানা পদক্ষেপেও স্থিতিশীলতা আসেনি শীত আসার আগে পর্যন্ত। এরই মধ্যে বাড়ানো হয় বিদ্যুতের পাইকারি মূল্যহার। সঙ্গে সঙ্গেই লোকসানের শংকায় খুচরা পর্যায়েও দাম বাড়ানোর জন্য উঠেপরে লাগে বিতরণ কোম্পানিগুলো। বিইআরসিতে জমা পরে দাম বাড়ানোর প্রস্তাবনাও। এরই প্রেক্ষিতে শুরু হয়েছে খুচরা পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর গণশুনানি।
এর আগে গত ১৮ মে বিদ্যুতের পাইকারি হারে দাম বৃদ্ধি নিয়ে গণশুনানি করে বিইআরসি। বিদ্যুতের একক ক্রেতা হিসেবে বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে এ গণশুনানি করা হয়। গ্যাসের তৎকালীন মূল্য ধরে পিডিবি তার প্রস্তাবে প্রতি ইউনিটের দাম ৬৯ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৫৮ টাকা করার প্রস্তাব করে। গ্যাসের দাম ১০০ শতাংশ বৃদ্ধি হলে ৯ দশমিক ১৪ টাকা এবং ১২৫ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেলে ৯ দশমিক ২৭ টাকা করার প্রস্তাব করে পিডিবি। এর প্রেক্ষিতে রিভিউ শেষে গত ২১ নভেম্বর পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর ঘোষণা দেয় বিইআরসি। প্রতি কিলোওয়াট ৫ টাকা ১৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৬ টাকা ২০ পয়সা নতুন দর নির্ধারণ করা হয়। এতে করে প্রতি কিলোওয়াট বিদ্যুতের দাম বাড়ে ১ টাকা ৩ পয়সা। শতাংশের হিসাবে যা ১৯ দশমিক ২২ শতাংশ। যা কার্যকর হয় ডিসেম্বর মাস থেকেই। এই সিদ্ধান্তের কারণে পিডিবি বছরে অন্তত: ৮ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারবে বলে দাবি করলেও লোকসানের বৃত্ত থেকেই বের হতে পারছে না প্রতিষ্ঠানটি।
তখনই বিতরণ কোম্পানিগুলো লোকসানের ভয়ে খুচরা পর্যায়ে দাম বাড়ানোর প্রস্তাবনা জমা দেয় বিইআরসি’র কাছে। গত মাসেই বিদ্যুতের খুচরা মূল্য বৃদ্ধির প্রস্তাব জমা পরে বিইআরসিতে। বিইআরসি সূত্রে জানা যায়, গড়ে ১৯ দশমিক ৯২ থেকে ২৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ দাম বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে। একই সঙ্গে সঞ্চালন চার্জ বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে পাওয়ার গ্রিড কোম্পনি।
প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গ্রাহক পর্যায়ে সর্বোচ্চ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। সংস্থাটি গ্রাহক পর্যায়ে গড় মূল্যহার ২৬ দশমিক ৬৫ শতাংশ তথা এক টাকা ৯০ পয়সা বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। এতে গ্রাহক পর্যায়ে বিদ্যুতের গড় দাম বেড়ে দাঁড়াবে ৯ টাকা তিন পয়সা। বর্তমানে এ হার ৭ টাকা ১৩ পয়সা। পাশাপাশি ডিমান্ড চার্জ ও পোস্ট পেইড গ্রাহকদের জামানত বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। এছাড়া সকল থ্রি ফেজ এলটি গ্রাহকদের জন্য পাওয়ার ফ্যাক্টর সারচার্জ আরোপসহ আরও কিছু প্রস্তাব করেছে।
এদিকে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির জন্য ২০ দশমিক ২৯ শতাংশ বা এক টাকা ৩৫ পয়সা বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে। আর ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ডিপিডিসি) গড় মূল্যহার ২০ শতাংশ এবং ঢাকা ইলেকট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি (ডেসকো), ওয়েস্ট জোন পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি (ওজোপাডিকো) ও নদার্ন ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানি (নেসকো) বাল্ক মূল্য বৃদ্ধির অনুপাতে গ্রাহক পর্যায়ে অর্থাৎ ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে।
গণশুনানির দ্বিতীয় দিন হিসেবে আজ সোমবার পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেডের (পিজিসিবি) বিদ্যুতের সঞ্চালন ট্যারিফ পুননির্ধারণের প্রস্তাব নিয়ে শুনানি হবে।
স্বপ্না