
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও পা দিচ্ছে মেট্রোরেল যুগে
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশও পা দিচ্ছে মেট্রোরেল যুগে। দিয়াবাড়ি থেকে আগারগাঁও এই অংশে উড়াল ট্রেন চালুর মধ্যদিয়ে আজ বুধবার বাংলাদেশ প্রবেশ করছে বহুল কাক্সিক্ষত মেট্রোরেল যুগে। সেই সঙ্গে রাজধানী ঢাকার গণপরিবহনেও প্রথমবারের মতো যুক্ত হচ্ছে মেট্রোরেল। ঢাকার গণপরিবহন নিয়ে বহু বছর ধরে অস্বস্তিতে আছেন নগরবাসী। একে তো লক্কড়-ঝক্কড় বাস তার ওপর ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকা। চাকরিজীবী, পেশাজীবী, শিক্ষার্থী- যারা প্রতিদিন কোথাও না কোথাও যাতায়াত করেন তাদের ভোগান্তিটা চরম বিরক্তির পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। মেট্রোরেল চালু হলে ঢাকার রাস্তায় নিত্য যাতায়াতকারীদের একটি অংশ অন্তত স্বস্তি পাবেন বলে আশা করা হচ্ছে।
সেই সঙ্গে নারীর ক্ষমতায়ন বাড়াবে মেট্রোরেল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ২০ বছর আগে দিল্লিতে মেট্রোরেল চালু হয়। এরপর সেখানে শ্রম বাজারে নারীদের অংশগ্রহণ অনেক বেড়ে যায়। একই ঘটনা ঢাকার ক্ষেত্রেও ঘটবে বলে মনে করেছে প্রকল্পে অর্থায়নকারী সংস্থা জাইকা। সংস্থাটি বলছে, এ অঞ্চলে নারীদের চলাফেরার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা অন্য অঞ্চলের থেকে বেশি।
দক্ষিণ এশিয়ার সমাজকে বিবেচনায় নিলে নারীর ক্ষমতায়নে এটি বড় ভূমিকা রাখবে এই রেল। কারণ, দিল্লি মেট্রোর ওপর অনেকগুলো জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে নারীরা মনে করেন দিল্লি মেট্রো হচ্ছে সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ও নিরাপদ পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। দিল্লি মেট্রো তৈরির ক্ষেত্রেও সহায়তা করেছিল জাইকা। একই ঘটনা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঘটবে বলে আশা করা যায়।
মেট্রোরেল চালুকে কেন্দ্রে করে উত্তরা ও টঙ্গী এলাকার অনেকেই স্বপ্ন বুনছেন এই স্বপ্নের বাহনটিতে করে ঢাকায় এসে অফিস করার। অপেক্ষার প্রহর ঘনিয়ে সেই স্বপ্ন এখন ছুঁয়ে দেখার মুহূর্ত। পদ্মা সেতুর পর এবার বাস্তবে ধরা দিচ্ছে দেশের আরও একটি বৃহৎ প্রকল্প। আজ বুধবার ঘটা করে বিদ্যুৎচালিত দেশের প্রথম মেট্রোরেল প্রকল্পের উদ্বোধন করবেন জাতির পিতার কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তবে উদ্বোধনের পরই পুরোদমে চলবে না মেট্রোরেল। উদ্বোধনের পর প্রথম সপ্তাহে শুধু সকালে নির্দিষ্ট সময়ে চলবে। ধীরে ধীরে ট্রেন চলার সময় বাড়বে। পূর্ণমাত্রায় চালু হলে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত উড়ালপথের ট্রেন ১০ মিনিট ১০ সেকেন্ডে পৌঁছবে গন্তব্যে।
আগামীকাল বৃহস্পতিবার থেকে স্বল্প সংখ্যায় ট্রেন চলাচল শুরু হবে। চালু থাকবে সকাল ৮টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত। মূলত এই চলাচলও পরীক্ষামূলক। এতদিন যাত্রী ছাড়া চলেছে, এখন কয়েক মাস স্বল্প যাত্রী নিয়ে পরীক্ষামূলক চালাচল করবে। ইতোমধ্যে মেট্রোরেলে চড়তে যাত্রীদের মধ্যে টিকিট কেনার সাড়া পড়ে গেছে। উদ্বোধনের পরদিন থেকে স্টেশন কাউন্টারেই মিলবে মেট্রোরেলের টিকিট। যাত্রীরা স্থায়ী ও অস্থায়ী দুই ভিত্তিতেই টিকিট সংগ্রহ করতে পারবেন। আপাতত স্টেশন থেকে সংগ্রহ করা যাবে ১০ বছর মেয়াদি স্থায়ী কার্ড। পরে স্টেশনের বাইরে থেকেও এটি সংগ্রহ করা যাবে। মোবাইলের মতো রিচার্জ করে যাতায়াত করতে পারবেন যাত্রীরা। তবে জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে করতে হবে নিবন্ধন।
মেট্রোরেল কর্তৃপক্ষ বলছে, ১০ বছর মেয়াদি স্থায়ী কার্ড কিনতে হবে ২০০ টাকা দিয়ে। এই কার্ডে যাতায়াতের জন্য টাকা ভরা (রিচার্জ) যাবে। তবে প্রথমবার কার্ডটি নেওয়ার সময় চারশ’ টাকা লাগবে। যার দুইশ’ টাকা জামানত হিসেবে রাখা হবে। আর দুইশ’ টাকা রিচার্জ করা থাকবে, যা যাত্রী ব্যবহার করতে পারবে। আবার কার্ড জমা দিয়ে জামানতের টাকা ফেরত নিতে পারবেন যাত্রীরা।
অন্যদিকে এক যাত্রার কার্ড নির্ধারিত ভাড়া পরিশোধ করে নিতে হবে। ট্রেন থেকে নামার সময় তা রেখে দেওয়া হবে। নামার সময় কার্ড জমা না রাখলে যাত্রীরা বের হতে পারবেন না। পর্যায়ক্রমে স্টেশনের বাইরেও মেট্রোরেলের কার্ড বিক্রির জন্য কিছু প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক বলেছেন, সাধারণ যাত্রীদের মধ্যে স্থায়ী কার্ড নেওয়ার জন্য আগ্রহ বেশি লক্ষ্য করছেন। এই কার্ডে মুঠোফোনের আর্থিক সেবা (এমএফএস) ও ব্যাংক কার্ডের মাধ্যমেও টাকা ভরার ব্যবস্থা আছে। এজন্য ২৯ ডিসেম্বর থেকে ডিএমটিসিএলের ওয়েবসাইটের মাধ্যমে নিবন্ধনের সুযোগ দেওয়া হবে। নিবন্ধন করতে নিজের নাম, পিতা-মাতার নাম, ফোন নম্বর ও ই- মেইল লাগবে। যারা স্থায়ী কার্ড সংগ্রহ করবেন তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়ে গেলে হবে। তবে সিঙ্গেল যাত্রার কার্ড নিতে কিছু প্রয়োজন হবে না।
সরকার মেট্রোরেলের সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করেছে ২০ টাকা। এরপর প্রতি দুই স্টেশন পর ১০ টাকা করে ভাড়া যোগ হবে। উত্তরা উত্তর স্টেশন থেকে আগারগাঁও স্টেশন পর্যন্ত ভাড়া হবে ৬০ টাকা। যদিও এই ভাড়া নিয়ে যাত্রী কল্যাণ সমিতির পক্ষ থেকে আপত্তি জানানো হয়েছে। তারা ভাড়া ৫০ শতাংশ কমানোর দাবি করেছে। অন্যদিকে আইপিডি নামক অপর একটি গবেষণা সংস্থা এই ভাড়া ৩০ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব করেছে।
দূর হবে ভোগান্তি ॥ রাজধানীর ফার্মগেটে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন মোহাম্মদ নূরউদ্দিন। দুই বছর ধরে তিনি পূর্ব রাজাবাজারে থাকছেন। টঙ্গীর স্টেশন রোড এলাকায় তার নিজের বাড়ি আছে। সেখানে পরিবারের অন্য সদস্যরা থাকেন। প্রতিদিন বাসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে পড়ে থাকার ঝক্কি এড়াতে পরিবার ছেড়ে দূরে থাকেন নূরউদ্দিন। তিনি বলেন, ‘একসময় টঙ্গী থেকে প্রতিদিন বাসে ফার্মগেট আসা-যাওয়া করতাম। ২১ কিলোমিটারের কিছুটা বেশি রাস্তা। প্রায় আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা লেগে যেত। উপায় না পেয়ে পরিবার ছেড়ে অফিসের কাছাকাছি চলে এসেছি। এখন মেট্রোরেল চালু হলে আবার টঙ্গী থেকে অফিস করব।’
নূরউদ্দিনের মতো অনেকেরই ভোগান্তি দূর হবে মেট্রোরেল চালু হলে। যদিও খরচ একটু বেশি হবে। কিন্তু সময় এবং ভোগান্তি দুটোই কমবে। ফলে যাত্রীদের মধ্যে উচ্ছ্বাসের শেষ নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যাত্রীরা নানা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে মন্তব্য করে চলেছেন। উত্তরার শান্ত মারিয়াম ইউনিভার্সিটিতে ফ্যাশন ডিজাইন নিয়ে পড়াশোনা করছেন তাহমিনা আমিন। সপ্তাহে চারদিন ক্লাসে যেতে হয় তাকে। আগারগাঁওয়ের এ বাসিন্দা জানান, মেট্রোরেল চালুর খবরে তিনি দারুণ খুশি। সময় বাঁচাতে তিনি মেট্রোরেলে আসা-যাওয়া করবেন। তবে ভাড়াটা আরও কমানো এবং শিক্ষার্থীদের জন্য হাফভাড়া চালুর দাবি জানান তিনি।
বর্তমানে যানজটে বছরে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ২ দশমিক ৫ শতাংশ ক্ষতি করছে। টাকার অংকে যা প্রায় ৮৭ হাজার কোটি। ঢাকা শহরের ১২৮ কিলোমিটার সড়কের যানজটে মূলত এই ক্ষতি হয় দেশে। এসব ক্ষতির কথা মাথায় রেখে ২০৩০ সালনাগাদ ১২৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের মোট ছয়টি মেট্রোলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে সরকার। এর মধ্যে এমআরটি-৬ এর আওতায় উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার লাইন উন্মুক্ত করা হচ্ছে ২৮ ডিসেম্বর। এতে যানজটের ক্ষতি কমবে অন্তত ৯ শতাংশ। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড (ডিএমটিসিএল) সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে।
আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ২৪ সেট মেট্রোরেল বগি নিয়ে শুরু হচ্ছে এমআরটি লাইন-৬ এর যাত্রা। প্রতি সেট মেট্রোরেল ট্রেনে প্রাথমিকভাবে ছয়টি করে বগি থাকবে, যাতে পরবর্তীকালে আরও দুটি বগি যোগ করে বগি সংখ্যা আটটিতে উন্নীত করার ব্যবস্থা থাকছে। মেট্রোরেল সুষ্ঠু পরিচালনা, রক্ষণাবেক্ষণ এবং উন্নত সেবা নিশ্চিত করতে থাকছে একটি অত্যাধুনিক অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টার।
যাত্রীদের সুবিধার্থে মেট্রোরেলের স্টেশনগুলো হচ্ছে এলিভেটেড। টিকিট কাউন্টার ও অন্যান্য সুবিধা থাকছে দোতলায় এবং ট্রেনের প্ল্যাটফর্ম থাকছে তিনতলায়। প্রত্যেকটি মেট্রোরেল স্টেশনে লিফট, চলন্ত সিঁড়ি, সার্বক্ষণিক সিসিটিভি ক্যামেরার পর্যবেক্ষণ, প্রবেশপথে স্বয়ংক্রিয়ভাবে টিকিট সংগ্রহের মেশিনসহ আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন সর্বাধুনিক ব্যবস্থা থাকছে। র্যাপিড পাস ব্যবহার করে যাত্রীরা নির্ঞ্ঝাটে মেট্রোরেলে যাতায়াত করতে পারবেন। নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, প্রতিবন্ধী, ধনী-গরিব সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে ও আরামদায়ক পরিবেশে মেট্রোরেলে যাতায়াত করতে পারবেন।
পরিবেশবান্ধব মেট্রোরেলের বগিগুলোতে থাকছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থা। থাকছে সুবিন্যস্ত আসনব্যবস্থা। যাত্রা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় তথ্য সংবলিত ডিসপ্লে-প্যানেল ইত্যাদি। হুইলচেয়ার ব্যবহারকারী যাত্রীদের জন্য প্রতিটি ট্রেনের বগিগুলোতে থাকছে নির্ধারিত স্থান। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে মেট্রোরেলে রয়েছে নিজস্ব বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা।
উত্তরা থেকে মতিঝিল লাইন প্রথম কেন ॥ যানজটপূর্ণ রাজধানীতে যুক্ত হওয়া প্রথম মেট্রোলাইনটি উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নির্মাণ করা হচ্ছে। লাইনটির প্রথম স্টেশন উত্তরায়, যা রাজধানীর অন্যতম কম ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা। আবার মতিঝিল স্টেশন হলো সবচেয়ে বেশি অফিসকেন্দ্রিক ব্যস্ত এলাকা। এই দুই বিপরীতধর্মী এলাকাকে যুক্ত করার জন্যই মেট্রোরেলের প্রথম লাইন নির্ধারণ করা হয়েছে উত্তরা থেকে মতিঝিল।
এ প্রসঙ্গে মেট্রোরেল নির্মাণ প্রকল্পেরও উপদেষ্টা বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, ‘উত্তরা থেকে আগারগাঁও হলো মেট্রোরেলের উত্তর করিডর, যার এক প্রান্ত শুধুই আবাসিক এলাকা। উত্তরা, পল্লবী, শেওড়াপাড়া, সেনপাড়া; এগুলো পুরোপুরি আবাসিক এলাকা। এরপর শুরু হয়েছে অফিসপাড়া। আগারগাঁও, ফার্মগেট, কাওরান বাজার, পল্টন ও মতিঝিল বিরাট বাণিজ্যিক ও অফিসকেন্দ্রিক এলাকা। এসব আবাসিক এলাকা থেকে ব্যস্ত সময়ে এখান থেকে প্রচুর ব্যক্তিগত গাড়ি ও বাস আসে। এই যাত্রীদের যদি ওপরে উঠিয়ে (মেট্রোরেলে) নিয়ে আসা যায়, তাহলে বিরাট একটি জট কমবে। আর তাদের মেট্রোরেলে ওঠার আগ্রহ তখনই হবে, যখন তাদের গন্তব্যে অর্থাৎ মতিঝিল অথবা আশপাশের কর্মস্থলে পৌঁছে দিতে পারব।’
তিনি জানান, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের উত্তরা তৃতীয় পর্যায় প্রকল্পের এলাকার বিরাট অংশে মানুষের বসবাস নেই, মেট্রোরেলের কারণে সেখানে এখন মানুষ বসবাসে আগ্রহী হবেন। এবারের আবাসন মেলায়ও দেখা গেছে উত্তরা এবং মিরপুরে ফ্ল্যাট কেনায় মানুষের বেশ আগ্রহ। এর অন্যতম কারণই হচ্ছে যাতায়াতের সুবিধা। মেট্রো স্টেশনের পাশে আবাসন থাকলে পরিবহনের সময় ও খরচ দুটোই বেঁচে যায়।
গাড়ি অতিরিক্ত রাখার আগ্রহ কমে যায়। ফলে রাস্তা বানানোর খরচ বেঁচে যায়। একে বলে ‘ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট’, যা হবে মেট্রোকেন্দ্রিক অফিস আদালত, মেট্রোকেন্দ্রিক সেবা ও আবাসিক এলাকা।
পুরো মেট্রোরেল পথের দৈর্ঘ্য ২০ কিলোমিটারের কিছু বেশি। এর মধ্যে উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত পথের দৈর্ঘ্য ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার। মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল ২০২৩ সালের শেষ দিকে চালুর কথা রয়েছে। অন্যদিকে মেট্রোরেল কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত ১ দশমিক ১৬ কিলোমিটার সম্প্রসারণ করা হবে। আর এই রুট তথা উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
বিদ্যুতে চলবে মেট্রোরেল ॥ জ্বালানির পরিবর্তে মেট্রোরেলে ব্যবহার করা হবে বিদ্যুৎ। ইতোমধ্যে বিদ্যুৎ সরবরাহের যাবতীয় প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে।
উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ১১.৭৩ কিলোমিটার মেট্রোরেল চলাচলে প্রতিদিন ৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রয়োজন হবে। তবে প্রাথমিকভাবে চালু হতে যাওয়া উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত লাগবে ৯ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। যা সরাসরি জাতীয় গ্রিড থেকে সরবরাহ করা হবে। পাওয়ার গ্রিড অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) মূল তত্ত্বাবধানে ডেসকো, ডিপিডিসি সমন্বিতভাবে মেট্রোরেলে বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে।
কর্তৃপক্ষ বলছে, কোনো কারণে জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ পাওয়া না গেলে বিশেষ ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। বিশেষ পরিস্থিতিতে মেট্রোরেলের এনার্জি স্টোরেজ সিস্টেম (ইএসএস) থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে মেট্রোরেলকে নিকটবর্তী স্টেশনে নিয়ে আসা হবে।
এ প্রসঙ্গে মেট্রোরেলের প্রকল্প পরিচালক এম এ এন ছিদ্দিক বলেন, মেট্রোরেলে বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য আমরা গ্রিড লাইনের ছয়টি সোর্স থেকে আলাদাভাবে বিদ্যুৎ নিচ্ছি। যদি কোনো কারণে সবগুলো গ্রিড ফেল করে, তাহলে মেট্রোরেল পরিচালনায় কিছুটা অসুবিধা হবে। তখন আমাদের যে নিজস্ব বিদ্যুৎ ব্যবস্থাপনা আছে সেটি দিয়ে আমরা ট্রেনটিকে নিকটবর্তী স্টেশনে নিয়ে আসব। যদি সমস্যাটি দীর্ঘমেয়াদি হয় তাহলে ভিন্ন একটা ব্যবস্থা করে দেওয়া হবে।
প্রধান দুই চ্যালেঞ্জ অতিক্রম যেভাবে ॥ মেট্রোরেল বাংলাদেশের অন্যতম বিরাট অবকাঠামো প্রকল্প এবং এটি সম্পন্ন করা সহজ ছিল না। এর অন্যতম চ্যালেঞ্জ ছিল ভূমি অধিগ্রহণ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসন। এছাড়া ভালো কন্ডাক্টর নিয়োগ ও শ্রমিকদের নিরাপত্তা সুবিধাও ছিল চ্যালেঞ্জের মধ্যে।
তবে সবচেয়ে বড় যে দুটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে সেগুলো হলো, হলি আর্টিজান সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা এবং কোভিড-১৯ মহামারি। ২০১৬ সালে যখন হলি আর্টিজানে হামলা হয় তখন একজন কন্ট্রাক্টর চুক্তি সই করেছিলেন। আরেক জন কন্ট্রাক্টর নিয়োগের দরপত্র প্রক্রিয়া তখন চলছিল। হলি আর্টিজান ঘটনার পর অনেক কোম্পানি দরপত্র প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে অনীহা প্রকাশ করে। তারা নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল।
হলি আর্টিজানে নারকীয় জঙ্গি হামলায় তিন বাংলাদেশী, সাত জাপানি, ৯ ইতালীয় ও এক ভারতীয় নাগরিক জঙ্গিদের নির্মম হত্যাকা-ের শিকার হন। সেখানে নিহত সাত জাপানি নাগরিক মেট্রোরেল নির্মাণের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তারা মেট্রোরেল প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে কাজ করতেন। তারা মেট্রোরেলের সমীক্ষা কাজের পাশাপাশি রাজধানী ঢাকার যানজট ব্যবস্থাপনা নিয়েও গবেষণা করছিলেন। সেই অভিজ্ঞ প্রকৌশলীরা হলেন- তানাকা হিরোশি, ওগাসাওয়ারা, শাকাই ইউকু, কুরুসাকি নুবুহিরি, ওকামুরা মাকাতো, শিমুধুইরা রুই ও হাশিমাতো হিদেইকো। হলি আর্টিজানের মর্মান্তিক ঘটনায় তাদের মৃত্যু হয়। স্তম্ভিত হয়ে যায় বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্ব।
ঘটনার একদিন পর ২০১৬ সালের ৩ জুলাই জাপানের পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী শেইজি কিহারার নেতৃত্বে জাপানের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করেন। দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে। ওই ঘটনার পর জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কথা বলেন। তখন তিনি সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ দমনে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করার কথা বলেন।
হলি আর্টিজানের ঘটনায় নিহত সাত জাপানি নাগরিকের স্মরণে উত্তরার দিয়াবাড়ি মেট্রোরেল স্টেশনে নির্মাণ করা হয়েছে মেমোরিয়াল মোমেন্ট বা স্মৃতিস্তম্ভ। উদ্বোধনের পর যা দেখা যাবে নিয়মিত।
ওই সময়ে বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় চেষ্টায় সম্ভাব্য কন্ট্রাক্টররা নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়ে আশ্বস্ত হন। সরকার বিভিন্ন ধরনের নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ নেয়। যেমন অফিসের চারপাশে নিরাপত্তা দেওয়াল তৈরি করা এবং নিরাপত্তা সেবা দেওয়ার জন্য কোম্পানি নিয়োগ দেওয়া হয়।
এ প্রকল্পে জাপানের পাঁচটি বিখ্যাত কোম্পানি যুক্ত রয়েছে। এগুলো হচ্ছে কাওয়াসাকি, নিপ্পন, তোশিবা, মারুবেনি ও মিতসুবিসি। এরমধ্যে কাওয়াসাকি, নিপ্পন ও তোশিবা মেট্রোরেল প্রকল্পের বিভিন্ন সরঞ্জাম তৈরির সঙ্গে জড়িত।
মেট্রোরেল নিয়ে জাপানের আগ্রহের শুরুর সময়ে জাইকা সদর দপ্তরে বাংলাদেশের ডেস্কের পরিচালক ছিলেন ইচিগুচি তোমোহিদে। ওই সময়ে তিনি প্রায়শই ঢাকা সফর করতেন এবং বিভিন্ন প্রকল্পে কাজ করতেন। পরে তিনি ঢাকায় জাইকার প্রতিনিধি হিসাবে পদায়ন পেয়েছেন এবং এখন প্রকল্পের কাজ সম্পন্ন হওয়া দেখছেন।
বাংলাদেশে জাইকার প্রধান প্রতিনিধি ইচিগুচি তোমোহিদে বলেন, ‘এই প্রকল্পে অনেক চ্যালেঞ্জ ছিল। অনেকে মনে করে কনস্ট্রাকশন (নির্মাণ) একটি মেকানিক্যাল বিষয়। কিন্তু বাস্তবে এটি সত্যি নয়। এটি মানবিক ও সামাজিক বিষয় এবং এরসঙ্গে প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জ জড়িত থাকে।’
তিনি বলেন, ‘কোভিডের সময় কয়েক মাস নির্মাণ কাজ স্থগিত ছিল। ওই সময়ে লকডাউন ছিল এবং ঠিকাদাররা কোনো কাজ করতে পারছিলেন না। ওই সময়ে সরকার বেশ কিছু নিয়ম চালু করে। এর মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক মাস্ক পরা, হাত ধোয়ার ব্যবস্থা, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা, স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা ইত্যাদি। এর ফলে ঠিকাদাররা আত্মবিশ্বাস ফিরে পায় এবং কাজ শুরু করে।’
শুরুর কথা ॥ ২০০৫ সালে বিশ্ব ব্যাংকের স্টাডি রিপোর্টে প্রথমবারের মতো এমআরটি (ম্যাস র্যাপিড ট্রানজিট) করার প্রস্তাব করা হয়। এরপর জাপান সরকারের উন্নয়ন সংস্থা জাইকা এ কাজে আগ্রহ প্রকাশ করে এবং ২০০৮ সালে এতে যুক্ত হয়। ২০০৫ সালে বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় সরকার ঢাকায় স্ট্র্যাটেজিক ট্রান্সপোর্ট প্ল্যান (এসটিপি) তৈরি করে। ওই এসটিপিতে তিনটি এমআরটি লাইনের প্রস্তাব করা হয়। এসটিপির ওপর ভিত্তি করে জাইকা ২০০৮ সালে আরবান ট্রাফিক ফর্মুলেশন স্টাডি করে। ওই সময়ে এমআরটি লাইন ৬ কে সবচেয়ে সম্ভাবনাময় হিসেবে চিহ্নিত করে ২০১০-১১ অর্থবছরে সমীক্ষা জরিপ (ফিজিবিলিটি স্টাডি) চালানো হয়।
সমীক্ষা জরিপ হয়ে যাওয়ার পরে জাপানের সঙ্গে ঋণ চুক্তি সই করা হয়। ২০১৩ সালে প্রথম ঋণ ছাড় এবং পরামর্শক নিয়োগ দেওয়া হয়। পরামর্শক নিয়োগের পরে দরপত্র প্রক্রিয়া শুরু এবং ঠিকাদার নিয়োগ হয়। ২০১৬ সালে শুরু হয় নির্মাণ কাজ।
২৮ ডিসেম্বর চালু হতে যাওয়া এমআরটি-৬ গোটা নেটওয়ার্কের একটি লাইন। জাইকা আরও দুটি লাইন নিয়ে কাজ করছে। সেগুলো হচ্ছে এমআরটি লাইন-১ এবং এমআরটি লাইন-৫ (উত্তর)। এদের দরপত্র প্রক্রিয়ার কাজ চলছে। তিনটি লাইনের মোট দৈর্ঘ্য ১০০ কিলোমিটারের বেশি। টোকিওতে মোট মেট্রোলাইনের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ৩০০ কিলোমিটার। দিল্লিতে এর দৈর্ঘ্য ৪০০ কিলোমিটার। ফলে ঢাকা পৃথিবীর অন্যতম বড় মেট্রোপলিটন শহর হতে যাচ্ছে। মেট্রোরেলের মধ্য দিয়ে এ শহরে এক ধরনের রূপান্তর ঘটবে বলে আশা করা হচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে জাইকা প্রতিনিধি ইচিগুচি তোমোহিদে বলেন, ‘এই তিনটি লাইন আমাদের অগ্রাধিকার। তবে আমার ধারণা গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি ও বায়ু দূষণের কারণে ওই তিনটি লাইনের পরে আরও কাজ করতে হবে।’ তিনি জানান, ঢাকার মেট্রো প্রকল্পের ওপর এখন বেসলাইন স্টাডি করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে কাজের আগে এবং পরের অবস্থা নিয়ে একটি তুলনামূলক চিত্র পাওয়া যাবে।
জাইকার প্রধান প্রতিনিধি বলেন, মেট্রোরেল এখন আংশিক বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করার চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত রুট আগামী বছর উদ্বোধন হবে। এর পরের বছর মতিঝিল থেকে কমলাপুর স্টেশন। আমার মনে হয়, আমরা ঠিকমতো এগিয়ে যাচ্ছি এবং নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বাকি কাজগুলো শেষ হবে।
তিনি আরও জানান, জাপানিজ কোম্পানিগুলো এই প্রকল্পে যে প্রযুক্তি নিয়ে এসেছে, সেটি আবার ব্যবহৃত হতে পারে। এই প্রযুক্তি এমআরটি লাইন বা অন্য প্রকল্পে ব্যবহার করা যাবে। এছাড়া এসব কোম্পানি বার্তা দিচ্ছে ব্যবসা করার জন্য বাংলাদেশ একটি ভালো জায়গা।
সমন্বিত প্রকল্প ॥ মেট্রোরেল শুধু একটি প্রকল্প নয়। এরসঙ্গে অনেক বিষয় জড়িত রয়েছে। এই প্রকল্প মানুষের চলাচলকে মসৃণ ও সহজ করার পাশাপাশি বাণিজ্যিক ও অর্থনৈতিক উন্নতিতে বড় আকারে অবদান রাখার জন্য বিভিন্নমুখী পরিকল্পনা রয়েছে।
এর একটি হচ্ছে, পরিবহন বিষয়ক উন্নয়ন। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে ‘ইন্টারমোডাল’ যোগাযোগ বৃদ্ধি করা। এজন্য বাস, প্রাইভেট কার, এমনকি রিক্সাকেও স্টেশনের সঙ্গে যোগাযোগের মধ্যে থাকতে হবে। এছাড়া স্টেশনকে কেন্দ্র করে টাউনশিপ তৈরি করার প্রয়োজন হবে। এ ব্যাপারে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (রাজউক) জাইকা টাউনশিপ ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান তৈরি করতে সহায়তা দিচ্ছে। যার মাধ্যমে একই সঙ্গে স্টেশনের কাছাকছি বাণিজ্যিক অঞ্চল তৈরি করা হবে।