ঢাকা, বাংলাদেশ   সোমবার ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

কমবে মূল্যস্ফীতি ও অপচয়, বাড়বে রিজার্ভ, ঘুরে দঁাঁড়াবে অর্থনীতি

ব্যয় সংকোচন নীতি

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৩:০১, ১৭ ডিসেম্বর ২০২২

ব্যয় সংকোচন নীতি

অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরাতে ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনে আরও কঠোর হয়েছে সরকার

অর্থনীতিতে স্বস্তি ফেরাতে ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনে আরও কঠোর হয়েছে সরকার। অর্থনীতিকে চাপমুক্ত করতেই ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। সরকারি এই সিদ্ধান্তের ফলে দ্রব্যমূল্য কমবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তাঁদের মতে, খাদ্যপণ্যের দাম কমলে দারিদ্র্য হ্রাস পাবে। আমদানি ব্যয় কমানো গেলে বাড়বে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণ। অর্থাৎ ডলার সংকট দূর হবে।

শুধু তাই নয় গুরুত্বপূর্ণ খাতে বেশি বরাদ্দ ও ভর্তুকি দেওয়া সম্ভব হবে, যা দেশের অভ্যন্তরীণ মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে। এ ছাড়া অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজ স্থগিত থাকলে অপচয় রোধ করে বিদেশি ঋণের সর্বোচ্চ ব্যবহার করা সম্ভব হবে। এ কারণে সরকারের এই ব্যয় সংকোচন নীতির প্রতি সমর্থন দিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। ব্যয় সংকোচন নীতি ও সরকারের নানামুখী পদক্ষেপে অর্থনীতির ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছে বলে শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ীরাও মনে করছেন।
করোনা মহামারির পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কায় বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতিও বেশ চাপের মধ্যে পড়েছে। একদিকে ডলারের দাম বৃদ্ধি অন্যদিকে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স প্রবাহ কমে যাওয়া এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অর্থপাচার। ইউরোপ ও আমেরিকার মতো দেশগুলোতে মন্দা শুরু হওয়ায় চাপের মুখে পড়েছে রপ্তানি আয়ও।

এ অবস্থায় সরকারি ব্যয় কমানোর পথে হাঁটছে সরকার। অর্থাৎ ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে ব্যয় কমাতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এবার পরিচালন বাজেট বরাদ্দ কাটছাঁট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এরই ধারবাহিকতায়  পরিচালন বাজেট বরাদ্দ থেকে ভূমি অধিগ্রহণ, ভবন ও স্থাপনার নতুন ক্রয়াদেশ এবং যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনা পুরোপুরি স্থগিত থাকবে। সম্প্রতি এ সংক্রান্ত একটি পরিপত্র জারি করেছে অর্থ বিভাগ।
ওই পরিপত্রে বলা হয়েছে, বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্রসাধনের জন্য অর্থ বিভাগ ইতিপূর্বে জারি করা স্মারক ও পরিপত্রের অনুবৃত্তিক্রমে ২০২২-২৩ অর্থবছরে সব সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ, রাষ্ট্রমালিকানাধীন কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বাজেট বরাদ্দ থেকে তিনটি খাতে অর্থ ব্যয় স্থগিত বা হ্রাস করার বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সিদ্ধান্তগুলো হচ্ছে পরিচালন বাজেটের অধীন ‘ভূমি অধিগ্রহণ’ খাতে বরাদ্দ থাকা অর্থ ব্যয় সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকবে।

একইভাবে ভবন ও স্থাপনা খাতে বরাদ্দ করা অর্থের বিপরীতে নতুন কোনো কার্যাদেশ দেওয়া যাবে না। ইতোমধ্যে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে, এমন ক্ষেত্রে বাজেট বরাদ্দের ৫০ শতাংশের বেশি ব্যয় করা যাবে না। এ ছাড়া যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামাদি খাতে বরাদ্দকৃত অর্থ ব্যয়ও পুরোপুরি স্থগিত থাকবে। এ প্রসঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, চলমান বৈশ্বিক সংকটের বিষয়টি সামনে রেখে ব্যয় সংকোচনে সরকার আগে থেকেই বেশকিছু সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে। ফলে ব্যয় অনেক কমেছে।

নতুন এই সিদ্ধান্তের ফলে বেশকিছু খাতে আরও ব্যয় সংকোচন হবে, যা এই মুহূর্তে খুব জরুরি। তিনি বলেন, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট রয়েছে। সরকারের এই সিদ্ধান্তে আমদানিসহ অন্যান্য ব্যয় কমাবে এবং অর্থনীতির ওপর চাপ অনেকাংশে দূর হবে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়েই ব্যয় সংকোচন বা কৃচ্ছ্রতা সাধনে সর্বোচ্চ জোর দেওয়া হয়েছে। চলতি অর্থবছরের শুরু থেকে ব্যয় কমাতে বেশকিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এবার পরিচালন বাজেট বরাদ্দ কাটছাঁট করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

এরই ধারাবাহিকতায়  পরিচালন বাজেট বরাদ্দ থেকে ভূমি অধিগ্রহণ, ভবন ও স্থাপনার নতুন ক্রয়াদেশ এবং যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনা পুরোপুরি স্থগিত থাকবে। মূলত বছরের শুরু থেকেই ব্যয় কমাতে সরকার নানা পদক্ষেপ নেয়। গত জুলাই থেকে সরকার উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ কাটছাঁটের পথে হাঁটছে। তখন সিদ্ধান্ত হয়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে কিছু প্রকল্পে কোনো অর্থছাড় দেওয়া হবে না। আবার কিছু প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ ২৫ শতাংশ কম দেওয়া হবে।
সরকারি এই সিদ্ধান্তে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থের সাশ্রয় হবে বলে আশা করা হচ্ছে। সম্প্রতি সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতি নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) এক সংলাপে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়। ওই সময় সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, সরকারের বিভিন্ন খাতে ব্যয় কমিয়ে দীর্ঘমেয়াদে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য পূর্বপ্রস্তুতি নিয়ে রাখা সম্ভব। এখন দেশে চাল, আটা, ভোজ্যতেল ও চিনিসহ ভোগ্যপণ্য চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে।

কিন্তু এসব পণ্য আমদানি করতে ডলার ব্যয় করতেই হবে। এ কারণে যেসব আমদানি কম গুরুত্বপূর্ণ সেটি আপাতত স্থগিত রেখে বেশি গুরুত্বপূর্ণ খাতে জোর দেওয়া হলে এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। শুধু তাই নয়, অর্থনীতির ওপর যে বাড়তি চাপ তৈরি হয়েছে, তা ধীরে ধীরে কেটে যাবে। এ কারণে এটি সরকারের ভালো সিদ্ধান্ত। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম বলেন, সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতির ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আসবে। মূল্যস্ফীতি মোকাবিলার জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটও আমরা সংযত করেছি। ব্যয় বাড়ানো হলে অনেক সময় তা মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেয়।
উল্লেখ্য, বছরের শুরু থেকেই ব্যয় কমাতে সরকার নানা পদক্ষেপ নেয়। গত জুলাই থেকে সরকার উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দ কাটছাঁটের পথে হাঁটছে। তখন সিদ্ধান্ত হয়, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে কিছু প্রকল্পে কোনো অর্থছাড় দেওয়া হবে না। আবার কিছু প্রকল্পে অর্থ বরাদ্দ ২৫ শতাংশ কম দেওয়া হবে। চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরুতেই (৩ জুলাই) তিনটি আলাদা পরিপত্র জারি করে কৃচ্ছ্রতা সাধনের অংশ হিসেবে সরকারি প্রতিষ্ঠানে নতুন বা প্রতিস্থাপক হিসেবে সব ধরনের যানবাহন কেনা বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

একই সঙ্গে আপ্যায়ন, ভ্রমণ ও প্রশিক্ষণ ব্যয়ের ক্ষেত্রে বরাদ্দ থাকা অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ব্যয় করার নির্দেশনা দেওয়া হয়। এ ছাড়া উন্নয়ন প্রকল্পের বিভিন্ন কমিটির সম্মানী স্থগিত করা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির নিম্ন অগ্রাধিকার প্রকল্পে আপাতত অর্থছাড় স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া গত ৯ নভেম্বর আরেকটি পরিপত্র জারি করে সরকারের পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় সরকারি কর্মকর্তাদের সব ধরনের বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ ঘোষণা করা হয়।

একই সঙ্গে স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন করপোরেশন এবং রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর নিজস্ব অর্থায়নেও সকল প্রকার বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। তবে উচ্চশিক্ষার  ক্ষেত্রে অবশ্য কিছুটা ছাড় দেওয়া হয়। এ বিষয়ে বলা হয়, বিদেশি সরকার, প্রতিষ্ঠান, উন্নয়ন সহযোগী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থায়নে দেওয়া বৃত্তি বা ফেলোশিপের আওতায় স্নাতকোত্তর ও পিএইচডি কোর্সে পড়াশোনার জন্য অনুমোদন নিয়ে বিদেশ যাওয়া যাবে।

এ ছাড়া বিদেশের সরকার, প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সহযোগীদের আমন্ত্রণে ও সম্পূর্ণ অর্থায়নে আয়োজিত বিশেষায়িত বা পেশাগত প্রশিক্ষণ ও সেমিনারে অংশগ্রহণের জন্য বিদেশে যাওয়া যাবে। এ ছাড়া গত ২০ জুলাই ব্যয় সাশ্রয়ে আরও আটটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। ব্যয় সংকোচন নীতি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এক বৈঠক শেষে সেই সময় জানানো হয়েছিল-বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে আনতে সব মন্ত্রণালয় (মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ সব অফিস) প্রয়োজনীয় কর্মপন্থা নিরূপণ করবে।

সরকারের ব্যয় সংকোচন নীতিতে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরাও। এ প্রসঙ্গে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জনকণ্ঠকে বলেন, এর ফলে অর্থের অপচয় কমবে। অর্থনীতিতে স্বস্তি ফিরে আসবে। সরকারি নির্দেশনা মেনে দেশের বেসরকারি খাতও বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করে আসছে। তিনি জানান, সরকারি এই উদ্যোগ ভালো এবং এটি ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখতে হবে।

এদিকে, ব্যয় কমাতে  অন্য এক পরিপত্রে চলতি অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে বরাদ্দ পাওয়া ১,৪৮৭টি প্রকল্পকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ‘এ’, ‘বি’ ও ‘সি’ ক্যাটাগরিতে ভাগ করে ‘এ’ ক্যাটাগরির প্রকল্প বাস্তবায়নে শতভাগ বরাদ্দ অক্ষুণ্ণ রেখে ‘বি’ ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলোর বরাদ্দের সরকারি অংশের ২৫ শতাংশ কর্তন করা হয়েছে। আর ‘সি’ ক্যাটাগরির প্রকল্পগুলো চলতি অর্থবছর কোনো অর্থ ব্যয় করতে পারবে না। এ ছাড়া সরকারি ব্যয় কমাতে বিভিন্ন খাতে ভর্তুকির পরিমাণ কমানো হয়েছে। ইতোমধ্যে কয়েকদফা বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ানো হয়েছে।

×