এক মাসের ব্যবধানে টনপ্রতি প্রায় ৪০ হাজার টাকা বেশি
উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর কারসাজির কারণেই দেশে সব ধরনের কাগজসংকট তীব্র আকার ধারণ করেছে। ফলে বেড়েই চলছে দাম। গত নভেম্বর মাসে প্রতিটন নিউজপ্রিন্ট ৮০-৮২ হাজার টাকায় বিক্রি হলেও সেই একই পরিমাণ কিনতে এখন খরচ হচ্ছে এক লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে টনপ্রতি প্রায় ৪০ হাজার টাকা বেশি গুনতে হচ্ছে ক্রেতাদের।
এতে করে দেশের সংবাদ শিল্পের প্রকাশনা চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। অন্যদিকে, হোয়াইটপ্রিন্ট নামে পরিচিত সাদা কাগজ বাজারে পাওয়াই যাচ্ছে না। এতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মহান একুশের বইমেলা সামনে রেখে উদ্বেগ বাড়ছে প্রকাশকদের। মুদ্রণ ও প্রকাশনা শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা কাগজ শিল্পের অসাধু সিন্ডিকেট ভেঙে দিয়ে দ্রুত সাদা কাগজ আমদানির অবাধ সুযোগ দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। এ লক্ষ্যে সরকারি পদক্ষেপের কথা বলছেন উদ্যোক্তারা।
সংবাদপত্র শিল্প টিকিয়ে রাখতে নিউজপ্রিন্টের সরবরাহ বাড়িয়ে দাম কমানোর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু নানা অজুহাতে দফায় দফায় মিলমালিকরা নিউজপ্রিন্টের দাম বাড়িয়ে বাজারকে আরও অস্থির করে তুলছে। বেসামাল হয়ে পড়ছে কাগজের বাজার।
ভোগ্যপণ্যের মতো দেশে কাগজ শিল্পেও ভয়াবহ অসাধু সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে মিলমালিক, ডিলার, পরিবেশক, এমনকি পাইকারি ব্যবসায়ীরাও।
পুরোপুরি সিন্ডিকেটের কব্জায় কাগজের বাজার। সংকটের কথা বলা হলেও বেশি দাম দিলে মিলছে কাগজ। দেশীয় শিল্প রক্ষায় হোয়াইটপ্রিন্ট এবং নিউজপ্রিন্ট সরাসরি বিদেশ থেকে আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। তবে প্যাকেজিং ও বৃহৎ শিল্পের প্রয়োজনে রঙিন ও মোটা কাগজ আমদানির সুযোগ রয়েছে। হোয়াইটপ্রিন্ট উৎপাদনের ‘পাল্প’ কাঁচামাল হিসেবে বিদেশ থেকে আমদানি করা হলেও নিউজপ্রিন্টের পাল্প দেশেই রিসাইক্লিং করে পেয়ে থাকেন উদ্যোক্তারা। এ কারণে নিউজপ্রিন্টের দাম বাড়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই।
এরপরও গত এক বছরের ব্যবধানে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে নিউজপ্রিন্টের দাম। অন্যদিকে, বৈশ্বিক সংকটের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে হোয়াইটপ্রিন্ট পাল্পের দাম সামান্য বাড়লেও দেশে কাগজের দাম তিন থেকে চারগুণ বাড়ানো হয়েছে। মূলত, কাগজ সিন্ডিকেটের অসাধু চক্রের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছেন প্রকাশক ও মুদ্রণ শিল্পের সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা। আর এর পুরো খেসারত দিতে হচ্ছে ভোক্তাদের। চাপ বাড়ছে ভোক্তা গোষ্ঠীর ওপর।
পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, বছরের এ সময়ে নতুন বই ছাপানোর জন্য সাড়ে আট লাখ টন কাগজের প্রয়োজন হয়। মৌসুম সামনে রেখে বাংলাবাজারের প্রকাশকরা বিভিন্ন ধরনের বই ছাপানোর কাজ করছেন। এ কারণে এখন কাগজের চাহিদা সবচেয়ে বেশি। অথচ চাহিদা অনুযায়ী কাগজ পাওয়া যাচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মুদ্রণ শিল্প সমিতির সভাপতি সাইদুর রহমান সান্নামত জনকণ্ঠকে বলেন, কাগজ সংকটের কারণে বছরের শুরুতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দেওয়া যাবে কি না, সেটা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
যদি কাগজের সরবরাহ না বাড়ে, তাহলে সরকারের চাহিদা অনুযায়ী সঠিক সময়ে বই সরবরাহ করতে পারবে না প্রকাশকরা। তিনি বলেন, এখন যে কাগজ আছে, তা দিয়ে তিন কোটি বই তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু প্রাথমিকেই বই লাগবে ১০ কোটি। এ জন্য আমদানির সুযোগ দেওয়া হোক।
ডলার সংকটের কারণে হোয়াইটপ্রিন্টের পাল্প আমদানিতে খরচ বাড়ছে, এমনকি অনেক ব্যাংক এলসি বা ঋণপত্র খুলছে না বলে অভিযোগ রয়েছে মিলমালিকদের। এ ছাড়া কারখানায় গ্যাসের সংকটের কথা বলছেন তারা। তবে কাগজের পাইকারি ক্রেতারা মিলমালিকদের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে জানিয়েছেন, দেশে হোয়াইটপ্রিন্ট এবং নিউজপ্রিন্টের বিপুল মজুত রয়েছে মিলগুলোতে।
সংকট থাকলেও বাড়তি দাম দিলে পাওয়া যাচ্ছে সব ধরনের কাগজ। অর্থাৎ বাজারে কাগজ আছে। বিক্রেতারা বলছেন, কাঁচামালের অভাবে দেশে কাগজ উৎপাদন কমে গেছে। কাগজ ব্যবহারকারী ও মুদ্রণশিল্প-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশীয় কাগজ কলগুলো কাঁচামাল ইচ্ছাকৃতভাবে কম আমদানি করছে। এভাবে সংকট জিইয়ে রেখে বাজারে উচ্চমূল্য ধরে রাখা হচ্ছে। কাগজের দাম বাড়ার কারণে এসএসসি পরীক্ষার ফিও বাড়িয়ে দিয়েছে দেশের শিক্ষা বোর্ডগুলো।
এ ছাড়া নতুন শঙ্কা তৈরি হয়েছে অমর একুশের বইমেলা নিয়েও। তরুণ লেখক-লেখিকারা সারাবছর মুখিয়ে থাকেন একুশের বইমেলায় নিজের একটি বই প্রকাশের জন্য। কিন্তু এবার কাগজের দাম বাড়ায় তারা বই প্রকাশ করতে পারবেন কি না- তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করছেন।
সম্প্রতি ‘বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতি’র পক্ষ থেকে ঢাকায় প্রেসব্রিফিং করে কাগজের দাম কমানোর দাবি জানানো হয়। ওই সময় লিখিত বক্তব্যে সংগঠনটির সভাপতি মো. আরিফ হোসেন ছোটন বলেন, সিন্ডিকেটের কারণেই কাগজের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। আগে সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। তিনি জানান, ২০২১ সালে যেখানে ৮০ গ্রাম ডিডি অফসেট কাগজের দাম ছিল এক হাজার ৫০০ টাকা রিম, এখন তার দাম তিন হাজার টাকার ৫০০ বেশি।
১০০ গ্রামের একই কাগজের যেখানে ২০২১ সালে দাম ছিল এক হাজার ৭৫০ টাকা রিম, এখন তার দাম চার হাজার ৫০০ টাকা। এদিকে, সরকার আগামী এক মাসের মধ্যে দেশের স্কুল-শিক্ষার্থীদের হাতে ৩৫ কোটি বই তুলে দেবে। এ ছাড়া একুশে বইমেলায় বই প্রকাশনার জন্যও প্রচুর কাগজের ব্যবহার হবে। সহজ শর্তে বিনা শুল্কে অথবা স্বল্পশুল্কে কাগজ আমদানি করা না গেলে, বই বিতরণ ও বইমেলায় চরম অচলাবস্থা সৃষ্টি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রকাশকরা।
খুচরা পর্যায়ে যে খাতা আগে ৪০ টাকা বিক্রি হয়েছে, সেটি এখন কিনতে হচ্ছে ৮০-৯০ টাকায়। ফটোকপির অপসেট পেপার প্রতিপিস আগে এক টাকা বিক্রি হলেও এখন ক্রেতাকে দুই টাকা দিতে হচ্ছে। আগে এক পৃষ্ঠা ফটোকপি করতে দেড় টাকা খরচ হলেও এখন তা তিন টাকা দিয়ে করতে হচ্ছে। বাংলাদেশ পেপার ইম্পোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সফিকুল ইসলাম ভরসা জনকণ্ঠকে বলেন, দেশীয় শিল্প বিকাশের স্বার্থে সাধারণত হোয়াইট পেপার ও নিউজপ্রিন্ট আমদানি নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। আমদানি হয় না বললেই চলে।
তবে মোটা কাগজ (আর্ট পেপার- যেটা শুল্কমুক্ত) আমদানি হয়, সেটা তৈরি পোশাক শিল্পে ব্যবহার করা হয় রপ্তানির জন্য। আর ‘ডিউটি’সহ বাইরে যেটা আমদানি হয়, সেটা খুবই সীমিত। তিনি বলেন, এখন যে সংকট, সেটা ব্যাংক থেকে এলসি না পাওয়ার কারণে। তিনি বলেন, চলমান সংকটকে পুঁজি করে উৎপাদনকারীরা ইচ্ছেমতো দাম বাড়িয়ে যাচ্ছেন। দেখার কেউ নেই।
জানা গেছে, সংকটের কারণে কলম, পেন্সিল ও রাবারসহ অন্যান্য শিক্ষা উপকরণের দামও চড়া। কাগজসহ সব মুদ্রণ উপকরণের দাম কমানোর দাবি জানিয়েছে জাতীয় মুদ্রণ ব্যবসায়ী সমিতি। সংগঠনের নেতারা বলছেন, কাগজসহ কালি, বোর্ড, ফিল্ম, কেমিক্যাল, প্লেট ও মুদ্রণের অন্যান্য অত্যাবশ্যকীয় উপকরণের দাম ক্রমাগত বৃদ্ধি পাওয়ায় এ পেশায় জড়িত বিভিন্ন শ্রেণির ব্যবসায়ী ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।
জাতীয় মুদ্রণ ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেওয়ান মো. ফজলুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক আসাদুল্লাহ টিটো সম্প্রতি এ সংক্রান্ত এক যৌথ বিবৃতিতে জানান, মুদ্রণ উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে এ পেশা ও শিল্পে জড়িত লাখ লাখ ব্যবসায়ীর পক্ষে বর্তমানে ব্যবসা পরিচালনা করা দুরূহ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি একদিকে জাতীয় উন্নয়নকে বাধাগ্রস্ত করছে, অন্যদিকে লাখ লাখ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক ব্যবসায়ী সর্বস্বান্ত¦ হচ্ছেন।
ভয়াবহ সংকটে সংবাদপত্র প্রকাশনা শিল্প ॥ কাগজের এই অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে ভয়াবহ সংকটে পড়েছে দেশের সংবাদপত্র শিল্প। ইতোমধ্যে ব্যয় সংকুলানে ব্যর্থ হয়ে অনেক সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে। অনেক সংবাদপত্র মুদ্রণসংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে। আবার কিছু পত্রিকার পাতা কমিয়েও খরচ বাঁচাতে পারছে না। কারণ, আকস্মিকভাবেই মাত্রাতিরিক্ত দাম বেড়েছে কাগজের। এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে অনেক সংবাদপত্রই বন্ধের উপক্রম হবে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, নিউজপ্রিন্টের দাম বাড়ায় সংবাদপত্র শিল্প চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। একদিকে নিউজপ্রিন্টের দাম বাড়ছে হু হু করে, অন্যদিকে আগের মতো আর বিজ্ঞাপন পাওয়া যাচ্ছে না। বিপুল পরিমাণের বিজ্ঞাপন বিল বকেয়া থাকছে। এ অবস্থায় গত এক বছরে দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে নিউজপ্রিন্টের দাম। গত এক মাসের ব্যবধানে প্রতিটনে দাম বেড়েছে প্রায় ৪০ হাজার টাকা। উত্তরবঙ্গের বগুড়া জেলাকেন্দ্রিক নিউজপ্রিন্টের একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। বিশেষ করে আজাদ পাল্প অ্যান্ড পেপার মিল থেকে দাম বাড়ানোর পরই অন্য মিলগুলোও নিউজপ্রিন্টের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে।
সর্বশেষ পহেলা ডিসেম্বরে আজাদ পাল্প অ্যান্ড পেপার মিলে এ সিট ৪২জিএসএম প্রতিটন নিউজপ্রিন্ট এক লাখ ২১ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। অথচ এক মাস আগে পহেলা নভেম্বর সমপরিমাণ কাগজ ৮০-৮২ হাজার টাকায় বিক্রি করেছে প্রতিষ্ঠানটি। দেশের অধিকাংশ সংবাদপত্র এ সব মিল থেকে কিংবা এদের এজেন্ট ও ডিলারদের কাছ থেকে কাগজ সংগ্রহ করছে। মূলত, সংবাদপত্র শিল্পের কাগজের জোগান দিচ্ছে দেশীয় পেপার মিলগুলো।
কিন্তু নানা সংকটের কারণ দেখিয়ে এখন দফায় দফায় নিউজপ্রিন্টের দাম বাড়ানো হচ্ছে। সংবাদপত্র সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পত্রিকা প্রকাশের জন্য দেশীয় নিউজপ্রিন্টই ভরসা। অথচ গত কয়েক মাস ধরে যেভাবে প্রতিনিয়ত দাম বাড়ছে, তাতে সংবাদপত্র শিল্প ভয়াবহ সংকটের মুখে পড়তে যাচ্ছে। অচিরেই নিউজপ্রিন্টের দাম কমাতে সরকারি পদক্ষেপ প্রয়োজন। নিউজপ্রিন্টের দাম বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করছেন মিলমালিকরাও। ডলারসংকট ছাড়াও নানা ছল-চাতুরির মাধ্যমে কাগজের দাম বাড়ানো হচ্ছে এমন অভিযোগ রয়েছে।
কাগজের কৃত্রিম সংকট তৈরি, গোপনে মজুত করে রাখাসহ বাজার অস্থিতিশীল করার জন্য দায়ীদের শাস্তি নিশ্চিতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে পাশে চেয়েছেন সৃজনশীল প্রকাশ ঐক্য। সংগঠনটির সভাপতি ও অনুপম প্রকাশনীর প্রকাশক মিলন কান্তি নাথ জানান, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর নিত্য ভোগ্যপণ্য নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। কাগজের কৃত্রিম সংকট যারা তৈরি করেন, গোপন মজুত করেন, যারা নানা ফন্দি এঁটে কাগজের বাজারকে অস্থিতিশীল করেন, তাদের শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান তিনি।