ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, ২৩ মাঘ ১৪৩১

সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল ॥ সরেজমিন

ভোগান্তি যেখানে নিত্যসঙ্গী

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:২৮, ৯ নভেম্বর ২০২২

ভোগান্তি যেখানে নিত্যসঙ্গী

রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে প্রতিদিনই হয়রানির শিকার হচ্ছেন রোগীরা

১৩৫০ শয্যার হাসপাতাল। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এত কাছের এই আধুনিক হাসপাতালের নির্মাণশৈলী দেখলে মুগ্ধ হবে যে কেউ। শক্ত ভিত্তি আর দৃষ্টিনন্দন ভবন হলেও হাসপাতালজুড়ে নেই প্রতিবন্ধী বা রোগীবহনকারী স্ট্রেচারের জন্য কোনো র‌্যাম্প। হাসপাতালের চার কোনায় চারটি সিঁড়ি থাকলেও তিনটিই নির্মাণ কাজের জন্য রয়েছে বন্ধ। সবচেয়ে বড় কথা দিনে প্রায় ৪ হাজার মানুষের চলাচলের জন্য রয়েছে মাত্র দুটি লিফট। এর একটি চালু করা হয় ৪ মাস আগে।

কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই বন্ধ থাকে এদের মধ্যে একটি। বছর খানেকের বেশি সময় যাবৎ বন্ধ থাকা আইসিইউ-২ নতুন করে চালু করার কথা থাকলেও তা না করে এটিকে বানানো হয়েছে এইচডিইউ। ফলে মৃতপ্রায় রোগীদের প্রয়োজন থাকলেও দেয়া যাচ্ছে না আইসিইউ সেবা। শুধু তাই নয় হাসপাতালজুড়ে নতুন নতুন কেবিন হলেও লবিংয়ের জোর না থাকলে হাসপাতালটিতে পাওয়া যায় না সিটও। ফলে রোগীদের ভোগান্তির অপর নাম হয়ে দাঁড়িয়েছে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল।

সরেজমিনে দেখা যায়, হাসপাতালের জরুরি বিভাগের পেছনে লিফটের সামনে মিনিটে মিনিটে জড়ো হয় ২০ থেকে ৫০ জন রোগী ও তাদের স্বজনরা। পাশাপাশি দুইটি লিফটের মধ্যে একটি যান্ত্রিক ত্রুটিজনিত বন্ধ রয়েছে। তাই দায়িত্বরত এক আনসার জানায়, সবাইকে উঠতে হবে একই লিফটে। ফলে হাসপাতালে আসা রোগী, রোগীর স্বজন, চিকিৎসকসহ বর্জ্য বহনকারী ট্রলি, ময়লা-আবর্জনার ঝুড়ি, খাবারের ট্রলি এমনকি রোগীর স্ট্রেচার নিয়েও আয়ারা দাঁড়িয়ে আছেন একই লাইনে।

লিফটের ভেতরে প্রবেশ করতেই আরেক বিপত্তি। ভেতরে কোনো ফ্যান তো দূরে থাক বাতাস চলাচলেরও কোনো বাড়তি সুবিধা নেই। ফলে মানুষের শরীরের গন্ধের পাশাপাশি ময়লা-আবর্জনার গন্ধে লিফটে দম বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম।
হাসপাতালের চতুর্থ তলার নিউ কেবিনে চিকিৎসারত এক রোগীর ছেলে বলেন, মায়ের ফুসফুসে কিছু জটিলতা থাকায় গত প্রায় দেড় মাস হলো হাসপাতালে আছি। যেহেতু প্যাথলজি নিচ তলায় তাই বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য মাকে নিচে নিয়ে যেতে হয় দিনে একাধিকবার। কিন্তু লিফটে জায়গা পাওয়াই খুব কষ্ট। আমি সুস্থ মানুষ না হয় সিঁড়ি ভেঙ্গে নামতে-উঠতে পারব, কিন্তু রোগীকে কিভাবে নেব? শুধু কি তাই লিফটের ভেতরে যেখানে রোগীর হুইলচেয়ার থাকে তার পাশেই থাকে ময়লার ভ্যানও। কি যে দুর্বিষহ পরিস্থিতি তা যে ভুক্তভোগী সেই জানে।
এক দিন পর পর নিজের মায়ের ডায়ালাসাইসিস করাতে ৩য় তলা থেকে ৬ষ্ঠ তলার ডায়ালাইসিস রুমে যেতে হয় নাজিমা আক্তারকে। একটি লিফট প্রায় সময়ই বন্ধ থাকায় প্রতিবারই পোহাতে হয় চরম ভোগান্তি। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ হাসপাতালে মাত্র একটি লিফট! এটা কি মেনে নেয়া যায়? যে কয়টা সিঁড়ি রয়েছে সেগুলোও বেশিরভাগ সময় নির্মাণকাজের জন্য থাকে বন্ধ। ফলে রোগী নিয়ে এমন দুর্ভোগ পোহাতে হয় যে ভাষায় প্রকাশযোগ্য নয়।
একটি লিফটেই রোগী, খাবারের ভ্যান, ময়লার ভ্যানের সঙ্গেই ওঠা-নামা করতে হয় হাসপাতালের চিকিৎসকদেরও। তাই তাদের মধ্যেও রয়েছে চরম বিরক্তি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শিশু বিভাগের এক চিকিৎসক জনকণ্ঠকে বলেন, হাসপাতালে চিকিৎসা দিতে গিয়ে দুইবার আমি করোনায় আক্রান্ত হয়েছি। করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে গেলে খুব শ্বাসকষ্ট হয়।

কিন্তু লিফট তো মাত্র একটা! এই লিফটে কিভাবে উঠবো? যে কোনো হাসপাতালে চিকিৎসকদের জন্য আলাদা লিফট থাকে। সেটা তো দূরে থাক এই হাসপাতালে পুরো হাসপাতালেই রয়েছে মাত্র একটা লিফট। এই লিফটে একবার যে উঠেছে তার অভিজ্ঞতা যে ভয়াবহ হবে তা নিজেই বুঝতে পারি।
হাসপাতালের ওয়ার্ড মাস্টার জাকির হোসেন জানান, ১৩৫০ শয্যার হাসপাতাল হলেও বেশিরভাগ সময়ই এখানে ধারণক্ষমতার চাইতে বেশি রোগী থাকে। প্রতি রোগীর সঙ্গে যদি একজন করেও সহযোগী থাকে তাহলে প্রায় তিন হাজার। এর বাইরে নতুন ৭০টি কেবিনসহ পুরাতন কেবিন রয়েছে আরও ১৮টা। সব মিলিয়ে দুটি লিফট দিয়ে প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার মানুষকে যাতায়াত করতে হয়। এর মধ্যে যদি একটি বন্ধ থাকে তাহলে কি পরিস্থিতি হয় বুঝতেই পারছেন।
উপরন্তু হাসপাতালটিতে নেই কোনো র‌্যাম্প। যেটি থাকলে হয়তো রোগীকে স্ট্রেচারে করে উঠানো নামানো যেত দাবি করে এক রোগীর স্বজন অভিযোগ করেন, আর যাই হোক সিঁড়ি দিয়ে তো আর হুইল চেয়ার উঠানো যায় না?
যদিও হাসপাতালে ৪টি লিফট বসানোর জায়গা নির্ধারণ করা আছে। কিন্তু কবে নাগাদ এসব লিফট বসবে তা খোদ হাসপাতালের পরিচালকও জানেন না। পরিচালক ডা. মো. খলিলুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, আসলে হাসপাতালে লিফট বসানোর দায়িত্ব গণপূর্ত অধিদপ্তরের (পিডব্লিউডি)। তারা একটি লিফট আমাদের দিয়েছে। বাকি দুইটা কবে দেবে আলোচনা করছি। র‌্যাম্প নেই কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, আসলে হাসপাতালটি যখন বানানো হয়েছিলো তখন র‌্যাম্প বানানোর পরিকল্পনায় ছিলো না। এই র‌্যাম্প তৈরি করার মতো কোনো জায়গা নেই। তাই হয়তো এটি করা যাবে না।
শুধু লিফট বা র‌্যাম্প নয় জনবল এবং যন্ত্রপাতি সংকটে আইসিইউ-২ কে বানানো হয়েছে এইচডিইউ। জানা যায়, ২০ বেডের আইসিইউ-২ দুই বছর বন্ধ থাকার পর গত সেপ্টেম্বর মাসে পুনরায় চালু করার কথা থাকলেও ভেন্টিলেটর মেশিন এবং দক্ষ জনবল না থাকায় এটিকে বানানো হয়েছে এইচডিইউ। বিষয়টি স্বীকার করেছেন পরিচালকও। তিনি বলেন, আমাদের আরেকটি আইসিইউ হচ্ছে। আইসিইউ থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা একজন রোগীকে তো সরাসরি কেবিনে বা ওয়ার্ডে স্থানান্তর করা যায় না। তাকে আরও কিছু সময় পর্যবেক্ষণ করতে হয়। তার জন্য এইচডিইউ দরকার হয়। তাই আমরা আপাতত এটিকে এইচডিইউ হিসেবে ব্যবহার করছি।
অভিযোগ রয়েছে হাসপাতালের সার্বিক পরিচালন ব্যবস্থা নিয়েও। এখানে সর্বত্র অনিয়ম ছড়িয়ে আছে বলে অভিযোগ করেন হাসপাতালে কর্মরত একজন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মী জনকণ্ঠকে বলেন, করোনার আগে হাসপাতাল যেমন ছিল এখন আর তেমন নেই। সব জায়গায় অনিয়ম।

গরিব রোগীদের জন্য বিনামূল্যে টেস্ট করার কথা থাকলেও এখানে টেস্টের জন্য ফি নেওয়া হয়। আউটসোর্সিংয়ে নিয়োগের ক্ষেত্রেও বিশাল দুর্নীতি হাসপাতালের পরিচালকের নেতৃত্বে হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, এখন এসব দেখার কেউ নেই। এটা যেন মগের মুল্লুক হয়ে গেছে। তিনি অভিযোগ করেন, কয়েকটি বিভাগ আছে তো যেখানকার চিকিৎসকরা কক্ষেই নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করেন বন্ধু-বান্ধব মিলে। আর নোংরা-আবর্জনা তো চোখেই দেখছেন। পরিচালক একজন নামে থাকলেও তার যেন দায় নেই এই হাসপাতালের জন্য। তিনি অভিযোগ করেন, মৃতদেহের সঙ্গে যৌন কেলেঙ্কারির যে ঘটনা আলোচনায় এসেছে এতেও পরিচালকের মদদ রয়েছে।
হাসপাতালের বিভিন্ন করিডর ঘুরেও ময়লা আবর্জনার স্তূপ দেখা যায়। তৃতীয় তলায় শিশু বিভাগের সিঁড়ির মুখ তো যেন একটি ডাস্টরুমেই পরিণত হয়েছে। ভাঙ্গা চেয়ার থেকে শুরু করে, বালতি, বদনা, কাঁথা-বালিশের টুকরাও দেখা যায়। দেয়ালগুলোর কার্নিশে আধখাওয়া পাউরুটি, তরকারির ঝোল, পানের পিক যে কোনো সুস্থ মানুষের বমির উদ্রেকের কারণ হতে বাধ্য।

হাসপাতাল প্রাঙ্গণ নোংরা থাকার বিষয়টি স্বীকার করেছেন খোদ পরিচালকও। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, হাসপাতালে প্রতিদিন সারা দেশ থেকে হাজার হাজার মানুষ চিকিৎসা নিতে আসেন। নানাজন নানারকম ভাবে হাসপাতালকে নোংরা করে যায়। তবে আমাদের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা নিয়মিত কাজ করেন। অবশ্য হাসপাতাল প্রাঙ্গণে নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন এবং নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতির কোনো বিষয়ে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হন নি।

শুধু তাই নয়। রোগীদের অভিযোগ লবিং ছাড়া মিলে না সিট। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর তিতুমীর কলেজের এক শিক্ষার্থীকে তার রুমমেটরা নিয়ে আসেন ভর্তি করাতে। কিন্তু সিট না থাকার অজুহাতে তাকে সকাল থেকে অপেক্ষা করিয়ে রাখা হয়। আউটডোর থেকে বলা হয় ডাক্তারের রাউন্ড শেষ হলে সিট খালি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

কিন্তু চোখের সামনে আরও কয়েকজনকে ভর্তি হতে দেখেছেন দাবি করে ওই শিক্ষার্থীর রুমমেট শামীম হোসেন বলেন, কয়েকজন এসেই কর্তব্যরত চিকিৎসককে কাউকে ফোনে ধরিয়ে দিচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গেই ভর্তি হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষকেই পোহাতে হয় যত দুর্ভোগ। সরকারি হাসপাতালগুলোর এমন দুর্ভোগের শেষ কোথায় এমন প্রশ্ন যেন তিতুমীর কলেজের ওই দুই শিক্ষার্থীর চোখে-মুখে।

×