জেল হত্যা দিবস ২০২২ স্মরণে আলোচনা সভা
শেখ হাসিনা ২০০৮ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় না আসলে বঙ্গবন্ধু ও চার নেতার হত্যাকারীদের বিচার হতো না বলে মন্তব্য করেছেন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আমির হোসেন আমু। বৃহস্পতিবার রাজধানীর আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইন্সটিটিউটে জেল হত্যা দিবস ২০২২ স্মরণে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
আমু বলেন, বঙ্গবন্ধুর খুনীরা গণমাধ্যমের সামনে খুনের কথা স্বীকার করেছিলেন। অনেকেই বলেছিল তারা যেহেতু স্বীকার করেছেন তাদের হয় বিশেষ ট্রাইবুনাল বা শুটিং স্কোয়াডের মাধ্যমে বিচার করা হোক। বঙ্গবন্ধু কন্যা তা করেননি। ইতিহাসের কুখ্যাত অপরাধীরাও আইনের সব সুযোগ পেয়েছিলেন। যেকারণে সরকারের এক মেয়াদেও তাদের বিচার হয়নি। আওয়ামী লীগ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর বিচারের রায় কার্যকর হয়।
অনুষ্ঠানে প্রধান আলোচক ছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। আলোচক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ডা. সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি। অনুষ্ঠানটির সভাপতিত্ব করেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান। জেল হত্যা দিবস ২০২২ স্মরণে আলোচনা সভার আয়োজন করে বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ গবেষণা ইন্সটিটিউট। এসময় চার জাতীয় নেতার স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
৪৭ বছর আগে ৩ নভেম্বর ভয়াল রাতের কথা স্মরণ করে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর সদস্য আমির হোসেন আমু বলেন, আমি সেদিন একই সঙ্গে কারাগারে ছিলাম। আমার পাশের কক্ষেই জাতীয় চার নেতা দুই কক্ষে থাকতেন। কারাগারে যাওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন আলোচনা হত। আমরা শুনলাম, সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় চার নেতার সঙ্গে আলোচনা করা হবে। ওইদিন রাত দুইটায় বটের আওয়াজ পাওয়া গেল। জেলার সাহেব তাদেরকে বললেন আলোচনার জন্য লোক এসেছে। এর ২০ মিনিট পর আমরা ব্রাশ ফায়ারের আওয়াজ পেলাম। এর ১০ মিনিট পর আবারও ব্রাশ ফায়ার। পরদিন আমাদের কক্ষের লকাপ আর খোলা হল না। শুনলাম সব শেষ পরে বুঝলাম মেরে ফেলা হয়েছে। পরে কাদেরকে মারা হয়েছে তা জানতে আরও চার দিন লেগেছে আমার।
আমির হোসেন আমু বলেন, এই হত্যাকান্ডের শুরু হয়েছিল ১৫ আগস্ট। এই হত্যাকান্ড কোন ব্যক্তি বা পরিবার কেন্দ্রিক ছিল না। এরপর ৩রা নভেম্বরের জেল হত্যাকান্ডে আর বুঝতে বাকী ছিল না স্বাধীনতা বিরোধীরাই এসব কান্ড ঘটাচ্ছে।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর আমলে সাড়ে ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধী কারাবন্দী ছিল। তাদের সাড়ে ৪শ লোকের বিচার হয়েছিল। ৫২ জন লোকের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। কিন্ত জিয়াউর রহমানের একটি কলমের খোঁচায় সবাইকে মুক্ত করা হয়েছিল। কোন আইনে তা করা হয়েছিল এ বিষয়ে প্রশ্ন রাখেন আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান এ নেতা।
শেখ হাসিনাকে ১৯ বার হত্যা চেষ্টা করা হয়েছে জানিয়ে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মন্ডলীর এ সদস্য বলেন, বিরোধী দলীয় নেতা দাঁড়ালে স্পিকার মাইক দিতে বাধ্য। এটি সংসদীয় আইন। কিন্তু শেখ হাসিনার উপর গ্রেনেড হামলার পর তিনি যখন কথা বলতে চেয়েছেন তাকে কথা বলতে দেওয়া হয়নি। তারাই আবার গণতন্ত্রের কথা বলে। দ্রব্যমূল্যের বাজার নিয়ে বিএনপি জল ঘোলা করছে বলেও তিনি জানান।
অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, শহীদ চার নেতা দেশকে ভালবেসেছেন। বঙ্গবন্ধুকে ভালবেসেছেন। প্রথম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছিল। এই চারজন সেই সরকার গঠনে অন্যতম ভূমিকা রাখেন। এই চার নেতা বৈরী পরিবেশে তাদের নেতার অবর্তমানে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। তারা তাদের নেতার অবর্তমানে শুধুমাত্র নির্দেশনায় পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। দেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা, দেশপ্রেম, নেতার প্রতি আনুগত্য সবই চার নেতার মধ্যে ছিল।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. মশিউর রহমান বলেন, ‘৩রা নভেম্বরের হত্যাকারীরা অনিরাপদ ও শঙ্কাময় বাংলাদেশ তৈরি করতে চেয়েছিল। এ দিন একটি শিশু পুত্র অপেক্ষায় ছিল পিতা ফিরবে। পিতা ফিরেছে। কিন্তু লাশ হয়ে। ওই শিশুটির বয়স তখন ছয় বছর। নাম সোহেল তাজ। বাবার লাশ পেয়ে নিজে দাফন করেছে। বাবার লাশ দাফন করে মাকে বলেছে, দাফন করে এসেছি। শিশুপুত্রের জন্য খুনীরা, বাংলাদেশ বিরোধীদের কোনো দয়া ছিল না। তারা হত্যাকারী, ষড়যন্ত্রকারী, পিতা হত্যাকারী, বাংলাদেশ হত্যাকারী। ৩রা নভেম্বর, ১৫ আগস্ট, ২১ আগস্ট, এসব অভিন্ন যোগসূত্রে গাঁথা। তারা বাংলাদেশ বিরোধী।
সৈয়দ নজরুল ইসলামের কন্যা সংসদ সদস্য ডা. সৈয়দা জাকিয়া নূর লিপি বলেন, পৃথিবীর অন্যতম নিরাপদ স্থানে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়। কারণ তারা তাদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বেইমানী করেননি। আজকের এই দিনে আমার কথা বলাটা অনেক কঠিন। বাবা মানে আমার কাছে বিশাল একটি শুন্যতা। আমি খুব ছোট থাকতেই বাবাকে হারিয়েছি।
তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ১ নভেম্বর আমরা জেলখানায় গেলাম। তখন আব্বা বললেন, তোমরা চিন্তা করো না। আমরা আবার এক সঙ্গেই থাকবো। আমি আর আমার বোন বাসায় ফিরে এলাম। এরপর বাসা থেকে খাবার পাঠালাম। খাবার ফেরত আসে। পরদিন খাবার পাঠালাম সেটিও জেল থেকে ফেরত দেওয়া হলো। এরপর জেলখানা থেকে খবর আসে লাশ শনাক্তের জন্য। আব্বা কথা দিয়েছিলেন আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন।
তিনি ফিরে আসবেন নিথর দেহে, ঝাঝরা বুক নিয়ে। আমার বাবা নেতার রক্তের উপর দিয়ে মন্ত্রী পরিষদে যাবো না। তিনি বলেছিলেন, যেখানে মুজিব নেই সেখানে সৈয়দ নজরুল ইসলাম নেই। আমরা দ্বারে দ্বারে বিচারের জন্য ঘুরেছি, বিচার পাইনি।
শেখ হাসিনা, শেখ রেহেনা আপা দ্বারে দ্বারে বিচার চেয়েছেন। কিন্তু কুখ্যাত কালো আইন ইনডেমনিটি বিল পাস হওয়ার কারণে তা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর এই কুখ্যাত আইন রধ করে বঙ্গবন্ধুর খুনীর বিচার হয়েছে। জাতীয় চার নেতার খুনীর বিচার হয়েছে। কিন্তু আমার মা এই বিচার তিনি দেখে যেতে পারেননি।
তাজউদ্দীন আহমেদের কন্যা সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি শারীরিক অসুস্থতার জন্য অনুষ্ঠানে উপস্থিত হননি। কিন্তু একটি ভিডিও বার্তায় তিনি জানান, দেশের স্বাধীনতায় এই চারজন মানুষের অনেক অবদান আছে। বঙ্গবন্ধুর হত্যার কিছু দিনের মধ্যেই এই চারজনকে জেল খানায় হত্যা করা হয়।
অথচ আজকের এই দিন সম্পর্কে মানুষ তেমন কিছুই জানেন না। চার নেতার জীবনী বা তাদের কর্মকান্ডের বিষয়ে পাঠ্যপুস্তকে বিস্তারিত তুলে ধরতে শিক্ষামন্ত্রীকে অনুরোধ করেন তিনি।
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য হারুন অর রশিদ বলেন, ১৫ আগস্ট ও ৩রা নভেম্বর হত্যাকান্ডের সঙ্গে মেজর জিয়াউর রহমান সরাসরি জড়িত। কারণ তিনি ছিলেন চিফ অব স্টাফ।
অনেকেই বলেন, খন্দকার মুসতাক এ কান্ড ঘটিয়েছে। বিএনপি জামাতের সমালোচনা করে তিনি বলেন, জামায়াত একটি টেরোরিস্ট সংগঠন। বিএনপি এর জনক। এরাই জামায়াতকে ছত্র ছায়ায় রাখেন।
অনেকে বলেন, ১৫ আগস্টের ঘটনার বেনেফিসিয়ারি মেজর জিয়া। আমি তা মনে করি না। বঙ্গবন্ধুর ১৩ জন হত্যাকারীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তখন বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত বানিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছে। বেনিফিশিয়ারী হলে তিনি এগুলো করবেন কেন। আসলে তিনি ছিলেন এই পরিকল্পনার মূল খল নায়ক। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা দেখতে চাই, রক্তের গঙ্গা বয়ে যাবে না এমন দেখতে চাই, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা দেখতে বর্তমান সরকারের উপর আস্থা রাখার আহবান জানান তিনি।
এমএস