রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে
রাজধানীর জলাবদ্ধতা নিরসনে এ পর্যন্ত প্রায় ২০০ কোটি টাকা খরচ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। খাল সংস্কার, ড্রেনেজ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রকল্পে এ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ থেকে এখনও নগরবাসীকে পুরোপুরি মুক্ত করতে পারেনি। সামান্য বৃষ্টিতে ডুবে যায় ঢাকার বিভিন্ন সড়ক।
গত দুই সপ্তাহ আগেও সামান্য বৃষ্টি হলে মহানগরের বেশির ভাগ সড়ক পানির নিচে তলিয়ে যায়। চরম ভোগান্তি পোহাতে হয় নগরবাসীকে। তবে ঢাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় এমন ১৩৬টি পয়েন্টের মধ্যে ১০৪ টি পয়েন্টের কাজ শেষ হয়েছে বলে জানান ডিএসসিসির কর্মকর্তারা। আগামী দুই-এক বছরের মধ্যে পুরো কাজ শেষ হবে। এছাড়া খালগুলো সংস্কার করে পানি প্রবাহ সৃষ্টি হলে ঢাকার জলাবদ্ধতা পুরোপুরি নিরসন করা সম্ভব হবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে ডিএসসিসির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (পরিবেশ, জলবায়ু ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সার্কেল) মো. খায়রুল বাকের জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকার জলাবদ্ধতা নিরসনে কোন প্রকল্প নেই। দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের নিজস্ব অর্থায়নে খাল ও ড্রেনেজ সংস্কার করে জলাবদ্ধতা নিরসন করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত দেড়শ’ থেকে দুইশ’ কোটি টাকা বরাদ্দ রয়েছে। এর মধ্যে কিছু খরচ হয়েছে আরও কিছু বাকি আছে।
ঢাকায় জলাবদ্ধতার ১৩৬ পয়েন্টের মধ্যে ১০৪ পয়েন্টের কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে অনেক স্থানে ড্রেনের ময়লা পরিষ্কার করেই জলাবদ্ধতা নিরসন করা হয়েছে। তবে এটা একটি চলামান প্রক্রিয়া। এক পয়েন্টের কাজ শেষ হলে আবার নতুন পয়েন্ট যুক্ত হয়।’ তাই ঢাকার খালগুলো সচল না হলে জলাবদ্ধতা পুরোপুরি নিরসন করা সম্ভব নয় বলে জানান তিনি।
সংশ্লিষ্টদের তথ্যমতে, রাজধানীতে ঢাকা ওয়াসা রক্ষণাবেক্ষণ করে ৩৮৫ কিলোমিটার গভীর ড্রেন ও ৪টি পাম্প স্টেশন এবং ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট। পানি উন্নয়ন বোর্ড রক্ষণাবেক্ষণ করে ৫২টি স্লুইসগেট এবং ১টি পাম্প স্টেশন, রাজউক রক্ষণাবেক্ষণ করে ২৫ কিলোমিটার লেক এবং ৩০০ কিলোমিটার জলাশয়।
ডিএনসিসির ১ হাজার ২৫০ কিলোমিটার ড্রেনেজ লাইন রয়েছে এবং ডিএসসিসির রয়েছে ৯৬১ কিলোমিটার ড্রেনেজ লাইন। এছাড়া বর্তমানে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের আওতায় দেওয়া হয়েছে ২৬টি খাল। তবে সব খাল ও ড্রেনেজ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে ভরাট হয়ে যায়। তাই অল্প বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা জানান।
সামান্য বৃষ্টিতে তলিয়ে যায় ঢাকার সড়ক: গত সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে মাত্র আধ ঘণ্টার বৃষ্টিতেই রাজধানীর অনেক স্থানে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। এতে ঘরমুখো মানুষকে পোহাতে হয় ভোগান্তি। এতে নগরজীবনে অস্বস্তি সবচেয়ে বেশি। গত ১৪ সেপ্টেম্বর মাত্র আধ ঘণ্টার বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় ব্যস্ততম এলাকা ফার্মগেটের বিভিন্ন সড়ক। এছাড়া গ্রিন রোড, পান্থপথ, শাহবাগ, শুক্রাবাদ, রাজাবাজার, কাকরাইল, মালিবাগ, বিজয়নগর, নয়াপল্টন, ফকিরাপুল, আরামবাগ এলাকার মূল সড়ক থেকে অলিগলিতে হাঁটু জমি থাকায় ভোগান্তি পোহাতে হয় বলে স্থানীয়রা জানান।
এতে অফিস-কর্মস্থল থেকে ঘরমুখো মানুষকে বেশি ভোগান্তি পোহাতে হয় বলে আমিনুল নামের মালিবাগের এক বাসিন্দা জানান। তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বেলা ৩টায় অফিস ছুটির সময়। ফলে অফিস থেকে বের হয়েই বৃষ্টির কবলে পড়তে হয়েছে। প্রতি বছর সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি করে বড় বড় পাইন বসানো হয়। কিন্তু একটু ভারি বর্ষণ হলেই সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। প্রতি বছর এত টাকা খরচ করে কি লাভ। শুধু শুধু জনগণের ভোগান্তি।’
একই অবস্থা রাজধানীর বিজয়নগর থেকে আরামবাগ সড়কে। বৃষ্টি হলেই হাঁটু পানিতে ডুবে যায় সড়কটি। সাইফুল নামের আরামবাগের এক বাসিন্দা জনকণ্ঠকে বলেন, ‘ঢাকা শহরের সবচেয়ে নিচু সড়ক এই আরামবাগ রোড। বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা হবেই। রাস্তাটি প্রায় হাঁটু পানিতে ডুবে যায়। অথচ এই সড়কে কিছুদিন আগে ড্রেনেজ লাইন সংস্কার করে বড় বড় পাইপ বসানো হয়েছিল। কিন্তু কোন কাজে আসেনি।’
রাজধানীর গ্রিন রোড এলাকায় একই অবস্থা। পান্থপথ থেকে গ্রিন রোড পর্যন্ত রাস্তা পুরোটাই বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে যায়। গ্রিন রোড এলাকায় আশরাফুল ইসলাম নামের এক বাসিন্দা বলেন, ‘পান্থপথ থেকে আশপাশের বেশ কয়েকটি রাস্তায় বৃষ্টি হলেই পানি জমে। ফার্মগেটের দিকে, শুক্রাবাদ ও রাজাবাজার এলাকার অলিগলিতেও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। মেইন রোডেই তো হাঁটু পানি। অলিগলিগুলোর অবস্থা তো আরও খারাপ।’’
সাইদুর রহমান নামে এক বাসিন্দা বলেন, ‘সামান্য বৃষ্টিতেই এই সড়কে পানি জমে। কয়েকদিন আগেও রাস্তাঘাট নদী হয়ে গেছে। পাঠাও নেই, রিক্সাভাড়াও বেশি। এ শহরে বৃষ্টি হলেও যন্ত্রণা জলাবদ্ধতা।’
গত ১৩ সেপ্টেম্বর দুই ঘণ্টা বৃষ্টিতে ঢাকার বিভিন্ন সড়কে সৃষ্টি হয় জলাবদ্ধতা। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা তৈরি হয়েছে রাজধানীর বিমানবন্দর সড়কে। এর ফলে তেজগাঁও থেকে উত্তরার আব্দুল্লাহপুর, মালিবাগ থেকে খিলক্ষেত, মিরপুর-১০ থেকে বিজয় সরণি, কাওরানবাজার হয়ে শাহবাগ পর্যন্ত দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এসব সড়কে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানবাহন দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে স্থানীয়রা জানান।
ময়লায় বন্ধ থাকে ড্রেনের মুখ: জলাবদ্ধতা নিরসনে রাজধানীর প্রধান প্রধান সড়কে ড্রেনেজ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন কাজ করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। কিন্তু বেশির ভাগ সড়কে ময়লা পড়ে পানি নিষ্কাশনে ড্রেনের মুখগুলো বন্ধ হয়ে যায়। তাই ড্রেন দিয়ে পানি নামতে না পারায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হচ্ছে বলে স্থানীয়রা জানান।
এতে নিম্নাঞ্চলের মানুষদের সবচেয়ে ভোগান্তি পোহাতে হয় বলে জানান তারা। ফারুক নামের রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর বিবিরবাগিচা ২ নম্বর গেটের এক দোকানদার জনকণ্ঠকে বলেন, ‘এই মাসটি মোটামুটি ভালো। বৃষ্টির পরিমাণ কম। কিন্তু গত মাসে দুইদিন ভারি বৃষ্টির কারণে এই গলিতে হাঁটুপানি ছিল। ড্রেন দিয়ে পানি নামতে সমস্যা হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। বৃষ্টির পানির সঙ্গে ড্রেনের ময়লা পানি মিলে একাকার অবস্থা।’
ড্রেনের মুখ পরিষ্কার করে দিলেই পানি দ্রুত মেনে যাবে বলে জানান তিনি। একই অবস্থা জুরাইন আলম মার্কেট, পূর্ব জুরাইন বিভিন্ন গলিপথ, ধোলাইরপাড় বিভিন্ন সড়ক, পুরান ঢাকার বংশাল, চকবাজার ও কাজী আলাউদ্দীন রোডে বৃষ্টি হলেই জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয় বলে স্থানীয়রা জানান।
জহিরুল ইসলাম নামের জুরাইন এলাকার এক বাসিন্দা বলেন, ‘জুরাইনের অনেক এলাকাতে রাস্তা সংস্কার ও উন্নয়নের নামে রাস্তা উঁচু হয়ে যাওয়ার কারণে অল্প বৃষ্টিতেই বসতবাড়ি জলাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে, এমনকি কিছু এলাকায় বছরের অধিকাংশ সময় জলাবদ্ধ থাকে, যা চরম জনদুর্ভোগের কারণ। রাস্তার ড্রেনের মুখ বন্ধ থাকায় পানি প্রবেশ করতে পারে না।’ তাই রাস্তার পানি গলিপথ ও বাসা-বাড়ির নিচ তলায় প্রবেশ করে আরও দুর্ভোগ বাড়িয়ে দিয়েছে বলে জানান তিনি।
এছাড়া মিরপুর-১ নম্বরে চাইনিজের সামনে, মিরপুর-১৪ নম্বর, মিরপুর-২ নম্বরে কমার্স কলেজ সড়কে, শেওড়াপাড়া ও কাজীপাড়ায়, মোহাম্মদপুর, মগবাজারের মধুবাগ, মিরপুর-১০ থেকে খামারবাড়ি সড়কের বিভিন্ন জায়গায়, ঝিগাতলা, মোহাম্মদপুর এবং মিরপুর রোডের ধানমণ্ডি-২৭ নম্বর মোড়ে পানি জমে যায়।
এসব এলাকায় কোথাও গোড়ালি আবার কোথাও হাঁটু সমান পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। তবে জলাবদ্ধতা আগের মত দীর্ঘ সময় থাকে না। ঘণ্টা খানেকের মধ্যে সড়কের পানি নেমে যায় বলে স্থানীয়রা জানান।
ঝিগাতলা এলাকায় পাভেল নামের এক বাসিন্দা জনকণ্ঠকে বলেন, ‘বেশি বৃষ্টি হলে কিছুটা জলাবদ্ধতা হয়। তবে আগের মত এত সময় থাকে না। বৃষ্টি থামলে এক ঘণ্টার মধ্যে রাস্তার পানি নেমে যায়। সড়কের নিচে বড় বড় পাইপ বসানোর কারণে দুর্ভোগ কমেছে।’ কিন্তু বৃষ্টি থামলে গাড়ির চাপে যানজটের ভোগান্তি পোহাতে হয় বলে জানান তিনি।
বিশেষজ্ঞদের অভিমত, জলাবদ্ধতা নিরসনে ইতোমধ্যে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে, সেগুলোও সুপরিকল্পিতভাবে হয়নি। বিশেষ করে যথাযথভাবে হয়নি ড্রেনেজ, খাল ও বক্স কালভার্ট পরিষ্কার ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ। আর বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পাদনে সিটি কর্পোরেশন এবং সরকারের অন্য সংস্থার মধ্যে ছিল না তেমন কোনো সমন্বয়ও।
ফলে জলাবদ্ধতার জন্য একে অন্যকে দায়ী করেই বছর পার করছে সংস্থাগুলো। তবে সুযোগ পেলেই মোটা অঙ্কের একাধিক প্রকল্প নেওয়ার বিষয়ে যথেষ্ট আগ্রহী সংশ্লিষ্টরা। সমস্যার সমাধান হচ্ছে কিনা, সেদিকে নজর নেই তাদের। বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের ওপর তাগিদ দিয়ে প্রতিটি কাজের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘শুধু প্রকল্পের মাধ্যমে টাকা অংক বাড়ালেই জলাবদ্ধতা নিরসন হবে না। খাল সংস্কার, ড্রেনেজ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন কাজ করার পর তা মনিটরিং ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। কিন্তু সিটি করপোরেশন কাজ শেষ হওয়ার পর তা আর রক্ষণাবেক্ষণ না করার কারণে খাল ও ড্রেনের মুখ আবার ভরাট হয়ে যায়।’ তাই কাজ বাস্তবায়নের পর রক্ষণাবেক্ষণ ও জবাবদিহিতা থাকা দরকার বলে মনে করেন তিনি।