একবিংশ শতকে বায়ু দূষণ বড় একটি সমস্যা হয়ে ধেয়ে আসছে
একবিংশ শতকে বায়ু দূষণ বড় একটি সমস্যা হয়ে ধেয়ে আসছে। নানা কারণে প্রকৃতি বিরূপ হয়ে দিন দিন বায়ু দূষণের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের বড় শহরগুলোতে বায়ূ দূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশি। পরিবেশ অধিদফতরের রিপোর্ট বলছে বায়ু দূষণে এগিয়ে আছে রাজধানী ঢাকা। এরপরই নারায়ণগঞ্জ ও বগুড়ার বায়ুদূষণ মাত্রা আশঙ্কাজনক। এই তিন নগরী ছাড়াও রাজশাহী, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনা ও বরিশালের বায়ু দূষণের মাত্রা বেশি। বিজ্ঞানীগণ বলছেন, বায়ু দূষণের কারণে মানব শরীরে ব্যাধি বালাই লেগেই থাকছে।
মানব মনে নতুন নতুন রোগ বাসা বাঁধছে। সবচেয়ে বেশি বাড়ছে রাগ, ক্ষোভ হঠাৎ বিগড়ে যাওয়া, খিটমিটে মেজাজ অস্বাভাবিক সেন্টিমেন্ট ও বিষণœতা। একটি রোগ থেকে আরেকটি (বা একাধিক) রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। সাধারণ চিকিৎসকগণ অনেক সময় সার্বিক পরীক্ষা নিরীক্ষা করে সঠিক রোগ নির্ণয় করতে পারছেন না। অনেক সময় মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হচ্ছে।
বায়ু দূষণের নানা কারণের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধুলাবালি। দেশের প্রতিটি শহরে ধুলাবালি এত বেশি যে অনেক সময় মনে হবে কুয়াশাপাত হচ্ছে। অবকাঠামো নির্মাণ, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ধুলাবালি সবচেয়ে বেশি। ইটভেঙ্গে খোয়া তৈরির (বর্তমানে যন্ত্রেও খোয়া ভাঙ্গা হয়) ধুলা নেই এমন কোন স্থান খুঁজে পাওয়া যায় না। রাস্তার ধারে ময়লা আবর্জনা ফেলা। শহরের ভেতরে ডাস্টবিন না থাকায় ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হওয়া। পৌরসভার ড্রেন পরিষ্কার করে রাস্তার ধারে দীর্ঘ সময় রাখা। এমন নানা কাজে বায়ু দূষণ বাড়ছেই।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে রাস্তার ধারে আবর্জনা জড়ো করে পুড়িয়ে ফেলা। অনেক সময় মেডিক্যাল বর্জ্য রাস্তায় ধারেই পোড়ানো হয়। বায়ু বিশেষজ্ঞগণ বলছেন, রাস্তার ধারে ময়লা আবর্জনা পুড়িয়ে ফেললে বায়ু দূষণ বেড়ে যায় অন্তত ৮০ শতাংশ। ঢাকার একটি এলাকায় প্রতি ঘনমিটার বাতাসে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর অতিক্ষুদ্র বস্তুকণা পাওয়া যায় ৪৬০ মাইক্রোগ্রাম। দৈনিক ৬৫ মাইক্রোগ্রাম পর্যন্ত সহনীয়। ঢাকায় প্রতিদিন প্রায় সাড়ে ৫ হাজার টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। এর বড় একটি অংশ পোড়ানো হয়।
ঢাকা ছাড়াও দেশের প্রতিটি শহরে প্রতিদিন কমবেশি বর্জ্য পোড়ানো হচ্ছে। প্রতিদিনের যে পরিমাণ ৩০০ থেকে ৩ হাজার টন। গবেষকগণ বলছেন এইসব বর্জ্য পোড়ানোর কারণে ডাইঅক্সিন, ফুরান, মার্কারি, পলিক্লোরিনেটেড বাই ফিনাইলসহ নানা ধরনের বিষাক্ত উপাদান বাতাসে যুক্ত হচ্ছে। একই সঙ্গে কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোস্কাইড, সালফার ডাই অক্সাইডসহ অন্তত ছয়টি বিষাক্ত গ্যাস তৈরি হচ্ছে। যার প্রভাব সরাসরি পড়ছে বায়ুম-লে। একজন চিকিৎসক বলেন ময়লা পোড়ানো ধোঁয়ায় মানব শরীরে তেজস্ক্রিয়া বেড়ে হৃদরোগ ও ¯œায়ুরোগে আক্রান্তের সম্ভাবনা বেশি। শিশুদের ফুসফুসের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। শরীরে এই ধোঁয়া অতিরিক্ত প্রবেশ করলে ক্যান্সারের ঝুঁকি থাকে।
বগুড়া নগরীতে বায়ু দূষণ বেড়ে মানুষের জীবন শঙ্কার মধ্যে থাকছে। যে এলাকায় বায়ু দূষণ যত বেশি সেই এলাকা ততবেশি বসবাসের অযোগ্য। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থার তৈরি বায়ুমান সূচক একিউআই (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) রিপোর্টে ঢাকার পরই অন্যতম দূষিত শহরের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে নারায়ণগঞ্জ ও বগুড়া। এই নগরীগুলোতে বায়ু দূষণের মাত্রা ৩৮০ থেকে ২৯০ একিউআই এর মধ্যে ওঠানামা করছে।
মার্কিন পরিবেশ সুরক্ষা সংস্থা বাতাসে দৃশ্যমান ক্ষতিকর পদার্থের উপস্থিতি বিবেচনায় একিউআইকে ছয়টি ক্যাটাগরিতে ভাগ করেছে। এই মান তিন শ’র ওপরে উঠলে তা বিপজ্জনক ধরা হয়। ৫০ এর নিচে থাকলে তা স্বাস্থ্যসম্মত। একিউআই সূচক ২০১ থেকে ৩০০ হলে শিশু বয়স্ক ব্যক্তি ও অসুস্থ রোগীর স্বাস্থ্য ঝুঁকি বেড়ে যায়। সূচক ৫১ থেকে ১শ’ স্কোরের মধ্যে থাকলে গ্রহণযোগ্য। ১০১ থেকে ১৫০ সূচক বাতাসের মান সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর। ১৫১ থেকে ২০০ সূচক হলে সকলের জন্য অস্বাস্থ্যকর।
পরিবেশ অধিদফতরের উত্তরাঞ্চলের প্রধান অফিস বগুড়ার বায়ু কর্মকর্তাগণ বলেন, বাতাসে ক্ষুদ্র বস্তুকণার (পিএম) উপস্থিতি ২ দশমিক ৫ এর মানমাত্রা হচ্ছে প্রতি কিউবিক মিটারে ১৫ মাইক্রোগ্রাম। এই মাত্রা যত বেশি তত ক্ষতিকর। বাংলাদেশের প্রতিটি শহরে এই মাত্রা বাড়ছে। বগুড়া শহরের দূষিত বায়ু বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণগুলো হচ্ছে শহর এলাকার ইটভাঁটি, ফাউন্ড্রি শিল্পে লোহা গলানো ফিটনেসবিহীন যানবাহনের কালো ধোঁয়া, অস্বাভাবিক পরিমাণ ছোট বড় মাঝারি যানবাহন চলাচল, বালি ও মাটিবাহী যানবাহনের চলাচল, যেখানে সেখানে ইটভাঙ্গা, অপরিকল্পিত ঘরবাড়ি নির্মাণ ইত্যাদি। পৌরসভার বর্জ্য ব্যবস্থাপনা দুর্বল। এই বিষয়ে পরিবেশ অধিদফতরের বিভাগীয় পরিচালক সুফিয়া নাজিম বলেন, শীতকালে বাতাসে দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। এই দূষণে দায়ী ক্ষুদ্র ও ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণার পরিমাণ বাতাসে অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়া।
যুক্তরাষ্ট্রের কিংস বিশ^বিদ্যালয় ও ব্রিটেনের পাঁচজন বিজ্ঞানী এক গবেষণায় প্রমাণ করেছেন, যে সব মানুষ দূষিত বায়ুর সংস্পর্শে আসে তাদের ২০ শতাংশ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়। বায়ু দূষণের সঙ্গে রাগ খিটমিটে মেজাজ বেশি হয়ে থাকে। অনেক সময় আত্মহননের মতো ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনে। বিজ্ঞানীগণ বলছেন শীত মৌসুমে বায়ু দূষণে রোগব্যধি বাড়ছে। মনের ভেতরে ভিন্ন ধরনের ব্যাধিব্যামোর সৃষ্টি হচ্ছে। কোন কাজে মনোযোগ ধরে রাখা যাচ্ছে না। প্রচ- অস্থিরতার সৃষ্টি হচ্ছে। রুক্ষè (দুর্ব্যবহার) ব্যবহারের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকী এনভায়রনমেন্টাল হেলথ পারসপেক্টিভে দূষিত বায়ুর দেশগুলোকে নিয়ে গবেষণায় উল্লেখিত ফলাফল এসেছে। বিশে^র বায়ুমান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘এয়ার ভিজুয়াল’ বলেছে বাতাসে ক্ষুদ্র ও ভারি বস্তুকণার সঙ্গে অন্যান্য ভারি ধাতু মানব শরীরে প্রবেশ করলে মস্তিষ্কে অক্সিজেন প্রবাহ কমে আসে। ফলে মানুষের মস্তিষ্কের স্নায়ুগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। যা মনে নানা ধরনের বিক্রিয়া ঘটিয়ে ক্ষোভ বিষণ্ণতা মেজাজ স্বাভাবিক না রাখার (রুক্ষè খিটমিটে বিগড়ে যাওয়া ইত্যাদি) বহুমুখী পথ সৃষ্টি করে।
করোনার কারণে মানুষের মাস্ক ব্যবহার বেড়েছিল। যা ফের কমে আসছে। বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণে মাস্ক ব্যবহার ছিল না। এখনও নেই। আবহাওয়া বিভাগ জানিয়েছে, উপমহাদেশের উচ্চচাপ বলয় বাংলাদেশের ওপর সক্রিয়। শুকনো মৌসুমে দেশজুড়ে নির্মাণ কাজ বেড়ে যায়। গ্রামে ভরবছর ফসলের মাড়াই কাটা চলছে। বেড়েছে ধুলার আধিক্য। এদিকে আরব সাগর হয়ে মরুভূমি পেরিয়ে আসা ধুলা বঙ্গোপসাগর থেকে আসা জলীয় বাষ্প মিশ্রিত ধুলা বাতাসে মিশে যাচ্ছে। বায়ুমান ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে।