
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা
প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আগামী নির্বাচনেও দেশের জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে এমন দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, এখনও নির্বাচনের এক বছরের বেশি সময় সময় বাকি আছে। নির্বাচনে আমাদের সঙ্গে কে থাকবে না থাকবে, নতুন জোট হবে কি হবে না-অসুবিধা নেই। সবাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক সেটাই আমরা চাই। আর যদি কেউ নির্বাচন না করে ওটা যার যার দলের সিদ্ধান্ত।
সেজন্য তো আমাদের সংবিধানিক প্রক্রিয়া বন্ধ করে রাখতে পারি না। আমরা চাই গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত থাকুক। আর দেশের জন্য এত কাজ করার পর এবং চলমান উন্নয়নের ধারাটা অব্যাহত রাখতে দেশের জনগণ তাদের ভোট অবশ্যই আওয়ামী লীগকে দেবে, এটা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। উন্নয়ন না চাইলে তো কিছু করার নেই, সেটা জনগণের ইচ্ছা। নির্বাচনে আমাদের সঙ্গে যারা সবসময় ছিল, তারা আমাদের সঙ্গে থাকবে। এতে আমাদের কোন আপত্তি নেই।
বুধবার তাঁর সরকারি বাসভবন গণভবনে ভারত সফর পরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। কোভিড মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ তিন বছর বিরতির পর তাঁর এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা হাসতে হাসতে বলেন, মনে হয় না যে একেবারে শূন্য হাতে ফিরে এসেছি। বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের সব দল-মত এক থাকে। এটাই বড় কথা।
সরকার প্রধান বলেন, ভারত সফরের সময় দেশটির রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ যাঁদের সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছে সবাই খুব আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। আপনি যদি নিজে ভাল বন্ধু হন তো সবাই ভাল থাকবে। সব মিলিয়ে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে এ সফরের মাধ্যমে দুই দেশের একসঙ্গে নতুনভাবে এগিয়ে চলার গতি সঞ্চার হয়েছে। উভয় দেশের জনগণের কল্যাণে এই সহযোগিতার ধারা অব্যাহত থাকবে এবং বাংলাদেশ ও ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়া অচিরেই একটি সমৃদ্ধশালী অঞ্চলে পরিণত হবে।
সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে মঞ্চে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিম-লীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী এবং মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক উপস্থিত ছিলেন। সংবাদ সম্মেলনে সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য, আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ এবং প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী প্রায় দেড় ঘণ্টাব্যাপী ভারত সফরে অর্জিত সাফল্য তুলে ধরার পাশাপাশি সিনিয়র সাংবাদিকদের প্রশ্নের স্বভাবসুলভ হাস্যোজ্জ্বল কণ্ঠে জবাব দেন।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দরজা খোলা ॥ আগামী নির্বাচন আওয়ামী লীগ ১৪ দল না কি মহাজোটগত ভাবে করবে এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা বলেন, এ বিষয়টা তো সময় এলে বলতে পারব। আমরা ১৪ দল করেছি। আমরা জোটবদ্ধভাবে নির্বাচন করেছি। জাতীয় পার্টি আমাদের সঙ্গে ছিল। তারা আলাদা নির্বাচন করেছে। আমাদের সঙ্গে একটা সমঝোতা ছিল। আর আগামী নির্বাচনে কে কোথায় থাকবে, সেটা তো সময়ই বলে দেবে। আর আওয়ামী লীগ উদারভাবে কাজ করে, আওয়ামী লীগের দরজা খোলা।
তিনি বলেন, আমরা সরকারে আসার পর সারাদেশের ব্যাপক উন্নয়ন করেছি। যোগাযোগ ব্যবস্থা, নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু, গৃহহীনদের গৃহ তৈরি করে দেয়া, দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা, গবেষণার সুযোগ তৈরি করা; এভাবে সার্বিক দিক থেকে অর্থনীতি থেকে শুরু করে ব্যবসা-বাণিজ্য, কর্মসংস্থান করেছি। আমাদের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় কথা একেবারে তৃণমূল পর্যায় থেকে আমরা উন্নয়নটা করে যাচ্ছি। বিনা পয়সায় করোনার টিকা দিয়েছি। এত কাজ করার পরে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি- অবশ্যই জনগণ আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবে, যদি এই চলমান উন্নয়নের ধারাটা অব্যাহত রাখতে চান। না চাইলে তো কিছু করার নেই। সেটা জনগণের বিষয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবাই নির্বাচনে অংশগ্রহণ করুক সেটাই আমরা চাই। আর যদি কেউ না আসে তবুও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। আওয়ামী লীগ একটানা ক্ষমতায় আছে তাই গণতান্ত্রিক ধারাটা অব্যাহত আছে। হয়ত অনেকে ভুলে গেছে, পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হত্যার পরে যে বার বার ক্যু হচ্ছিল। একটা মিলিটারী ডিক্টেটরের পরে আরেকটা মিলিটারী ডিক্টেটর বা তার স্ত্রী ক্ষমতা নিয়ে গেল ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে। তখন জনগণের কি ছিল? তাদের কী আদৌ কোনো অধিকার ছিল?
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দলীয় মনোনয়নে পরিবর্তনের বিষয়ে অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যে কোন নির্বাচনে নমিনেশন পরিবর্তন এটা তো খুবই স্বাভাবিক বিষয়। ক্ষেত্র মতো অবশ্যই আমরা যাচাই করে দেখব। কার জেতার সম্ভাবনা আছে, কার নেই। অথবা বেশকিছু নিবেদিতপ্রাণ কর্মী আছে। হয়ত বেশি দিন বাঁচবে না, হয়ত বয়স বেশি হয়ে গেছে। তাদের আর কষ্ট দিতে চাইনি, মনোনয়ন দিয়েছি। ফলে এগুলো নির্বাচনকে সামনে রেখে সবকিছু বিবেচনা করেই দেয়া হয়। এখনো তো নির্বাচনের প্রায় এক বছরের বেশি সময় বাকি আছে, সময় যত যাবে এই বিষয়টা ততই পরিষ্কার হবে।
’৭৫ পরবর্তী দীর্ঘ ২১ বছরে দেশের বাস্তব অবস্থা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এখন টকশো করেন যে যার মতো কথা বলেন? একটা কথা জিজ্ঞাসা করি আওয়ামী লীগ সরকারে আসার আগে, কে এত কথা বলার সুযোগ পেয়েছে বলেন তো? কেউ পেয়েছে কখনো সুযোগ? পায়নি। এখন শুনি সব কথা বলার পর বলে কথা বলার অধিকার নেই। আজকে রাস্তায় আন্দোলনে জনগণ সাড়া না দিলে সেটা তো আমাদের দায়িত্ব না।
আওয়ামী লীগ সব সরকারের আমলে নির্যাতিত হয়েছে উল্লেখ করে দলটির প্রধান বলেন, আওয়ামী লীগের উপর তো সবাই চড়াও হয়েছে। সেই জিয়াউর রহমান থেকে শুরু, তারপর থেকে একের পর এক। লাশ টানতে টানতে আর আহতদের চিকিৎসা করতে করতে নাভিশ্বাস উঠেছিল আমাদের। এখন কি সেই পরিবেশ আছে? তা তো নাই। এমনকি আমার পার্টির কেউ যদি কোন অন্যায় করে আমরা কিন্তু ছেড়ে দেই না। দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে কিছু বলব না; তা নয়। যে অন্যায় করবে তার বিরুদ্ধে আমি ব্যবস্থা নেব এবং নিচ্ছি। এ ধরনের কর্মকা- আমি কখনো সহ্য করব না।
বাংলাদেশের উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা অর্জনের প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এটা কী এত সহজ ছিল? যদি সুষ্ঠুভাবে, সঠিকভাবে রাষ্ট্র পরিচালনা করতে না পারতাম, যদি অর্থনৈতিকভাবে অগ্রগতি না হত, যদি গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত না হত, তাহলে তো এই অর্জনটা সম্ভব হতো না। সমালোচনা যারা করবে, করুক না। করা তো ভাল। আমাদের কোন আপত্তি নাই। আমরা শুনব। সেখান থেকে যদি ভাল কিছু আসে গ্রহণ করব। মন্দ থাকলে পরিহার করব। আমরা পরিকল্পনা নিয়ে দেশ পরিচালনা করছি বলেই দেশের এত উন্নয়ন হয়েছে, যার সুফলটা দেশের মানুষ পাচ্ছে। দেশের মানুষ ভালো আছে কি না, সেটাই আমার কাছে বড় কথা।
বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের সব দল এক ॥ ভারত সফরে গিয়ে দেশটির আন্তরিকতা উপলব্ধি করেছেন কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের সব দল-মত এক থাকে। এটাই বড় কথা। ভারত সফরের সময় দেশটির রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীসহ যাঁদের সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছে সবাই খুব আন্তরিকতা দেখিয়েছেন। আপনি যদি নিজে ভাল বন্ধু হন তো সবাই ভাল থাকবে।
ভারত সফরে গিয়ে বাংলাদেশ কী পেয়েছে-সেই প্রশ্ন যারা করেন তাদের উদ্দেশে পাল্টা প্রশ্ন রেখে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ কী পায়নি? ভারত সফরে বাংলাদেশ কী পেল, এটা আপেক্ষিক প্রশ্ন। বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র হিসেবে ভারত সব বিষয়েই সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এ সফরেও আমরা একেবারে শূন্য হাতে ফিরেছি, এটা বলতে পারব না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্র, যার সবদিকে ভারত। একপাশে ছোট্ট একটুখানি মিয়ানমার সীমান্ত। বাকি সীমান্তজুড়ে বঙ্গোপসাগর, এটাও আমাদের মাথায় রাখতে হবে। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো, বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের সব দল-মত এক থাকে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত সফরে গিয়ে যথেষ্ট আন্তরিকতা পেয়েছি। যাদের সঙ্গেই দেখা হয়েছে সবাই খুব আন্তরিক ছিলেন। তবে বড় কথা হলো, বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারতের সব দল এক। যেমন, আমাদের এখানে একাত্তরে সব দল-মত এক হয়ে সমর্থন দিয়েছিল। আবার যখন আমরা আমাদের স্থল সীমানা চুক্তি বাস্তবায়ন করি, যখন ছিটমহল বিনিময় করি, ভারতের পার্লামেন্টে যখন স্থলসীমান্ত বিল পাস হয়, সব দল মিলে কিন্তু আইনটা পাস করেছিল।
তিনি বলেন, ভারত বন্ধুপ্রতিম দেশ, তাদের সঙ্গে অবশ্যই সুসম্পর্ক থাকবে। এটাও বাস্তব, পাশাপাশি একটি দেশের সঙ্গে নানা সমস্যা থাকতে পারে। তবে আমি মনে করি আলোচনার মাধ্যমে এগুলো সমাধান করা যায়। আমাদের নিজেদের জন্যই দরকার। তিনি বলেন, ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পর অনেক রেল যোগাযোগ, সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এখন একে একে আমরা এগুলো খুলে দিচ্ছি। আমাদের উত্তরের যে জেলা-উপজেলাগুলো আছে সেগুলোর আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন যাতে আরও গতিশীল হয় সেজন্যই এটা হচ্ছে। কাজেই আন্তরিকতার আমি কোন অভাব দেখিনি।
তিনি আরও বলেন, আপনি যদি নিজে ভাল বন্ধু হন তো সবাই ভাল থাকবে। আর যদি নিজে একটু এদিক-ওদিক করেন, তবে সবাই ভাল থাকে না, তাই না? আর আমাদের পররাষ্ট্রনীতিতেই তো বলা আছে সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়। আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকে আমরা এটা মেনে চলছি। বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখেও ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আদালতে গিয়ে সমুদ্রসীমা মিটমাট করলাম। আমাদের বন্ধুত্ব কিন্তু নষ্ট হয়নি।
রফতানি বন্ধ করলে আগাম বার্তা দেবে ভারত ॥ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী জানান, চিনি, পেঁয়াজ, আদা, রসুনের মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য রফতানি বন্ধের আগে বাংলাদেশকে আগাম বার্তা দেবে ভারত। সে অনুযায়ী সরকার পদক্ষেপ নেবে। তিনি বলেন, সফরকালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে সহযোগিতা, ভারতের মধ্য দিয়ে নেপাল ও ভুটান থেকে বিদ্যুত আমদানির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়েও আলোচনা হয়েছে। বৈঠক শেষে দুই দেশের মধ্যে ৭টি এমওইউ বা সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়।
তিনি আরও বলেন, এবারের সফরে গঙ্গার পর প্রথমবারের মতো অভিন্ন নদী কুশিয়ারা থেকে সুরমা-কুশিয়ারা প্রকল্পের আওতায় ১৫৩ কিউসেক পানিবণ্টনে আমরা একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছি। এই সমঝোতা স্মারকের ফলে রহিমপুর সংযোগ খালের মাধ্যমে ৫ হাজার হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা পাওয়া যাবে। এ ছাড়া পরিবেশ, জলবায়ু পরিবর্তন, সাইবার নিরাপত্তা, মহাকাশ প্রযুক্তি, গ্রিন ইকোনমি, সুনীল অর্থনীতি, সাংস্কৃতিক ও জনগণের সঙ্গে জনগণের যোগাযোগ বৃদ্ধিসহ প্রভৃতি ক্ষেত্রে সহযোগিতার বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।
আরও অর্থ পাচারকারীর নাম আসবে ॥ দেশ থেকে অর্থপাচার নিয়ে অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, অর্থপাচারকারী এমন অনেকের তথ্য আছে সেটা আপনারা (সাংবাদিক) লিখবেন কি না সন্দেহ। আমি সোজা কথা বলি, অনেক স্বনামধন্যের তথ্য আমার কাছে আছে। দুর্নীতি দমন কমিশন আর বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। সামনে তাদের নাম আসবে, তবে আপনারা ছাপাবেন কি না আমি সেটা দেখব। সিআইডির মাধ্যমে আমরাই তো অর্থপাচারের ঘটনা বের করেছি, সাংবাদিকরা তো উদঘাটন করতে পারেনি।
তিনি বলেন, দ্বিতীয় কথা হচ্ছে অর্থপাচারকারীর তথ্য নেয়া হচ্ছে। সুইস ব্যাংকে কিন্তু আমরা বহু আগে ডিমান্ড পাঠিয়েছিলাম। আমরা তালিকা চেয়েছিলাম। কিন্তু তালিকা আসেই নাই। সবাই হাওয়ায় কথা বলে যায় কিন্তু কেউ সঠিক তথ্য দিয়ে বলে না। মানিলন্ডারিং বন্ধে যথেষ্ট উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। আর ডলার সঙ্কট বাংলাদেশের একার না, বিশ্বব্যাপী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারপরও আমি বলব, আমরা ১৯৯৬ সালের সরকার গঠনের পর রিজার্ভ কত ছিল? করোনার সময় কোন খরচ ছিল না, তখন আমাদের রিজার্ভ বেড়েছে। এরপর যখন আমদানি শুরু হয়েছে তখন তো কিছু কমেছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে বাংলাদেশ যেখান থেকে ঋণ নেয় সবসময় ঠিক সময়ে শোধ করে। আমরা কোনদিন খেলাপি হইনি। সেটা করতে যেয়েও রিজার্ভে একটু টান পড়ে।
তিনি বলেন, ডলার নিয়ে কিছু একটা খেলা শুরু হয়েছিল, কিন্তু ভালভাবে নজরদারি করা হয়েছে বলেই আজকে একটা স্থিতিশীল পরিস্থিতি আছে। সঙ্কট তো আন্তর্জাতিক বিষয় থেকে এসেছে। এখন যেই সঙ্কট দেখছেন হয়ত সামনের বছর আরও বেশি সঙ্কট দেখা দিতে পারে। যুদ্ধ যদি বন্ধ না হয়, নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা না হয় আমার তো শঙ্কা সারাবিশ্বে দুর্ভিক্ষ দেখা দিবে, চরম অর্থনৈতিক অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। তাই সবাইকে বলব সাশ্রয়ী হতে, সঞ্চয়ী হতে। আর এক ইঞ্চি জায়গাও যেন অনাবাদি না থাকে। আমাদের খাবার যেন আমরা নিজেই উৎপাদন করতে পারি।
যার যার ধর্ম স্বাধীনভাবে পালনের পরিবেশ সৃষ্টি করেছি ॥ অপর এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবাই যার যার ধর্ম যেন শান্তিপূর্ণভাবে পালন করতে পারে, সেই পরিবেশ আমরা বাংলাদেশে ভালভাবে ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। কিছু কিছু ঘটনা ঘটে বা ঘটানো হয়, তারপরও যারা অপরাধী আমরা তাদের বিরুদ্ধে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেই। আমরা তাদের কখনোই ছেড়ে দেই না। আমাদের যখন উৎসব হয়, পূজা-পার্বণ হয় সেখানে কিন্তু ভারতের অনেকে এসে যোগ দেয়, আবার ভারতে যখন হয় আমাদের এখান থেকেও অনেকে যোগ দেয়।
এটা যেমন পূজা-পার্বণে হয়, আবার আমাদের এখানে যখন ইসলামিক কোন অনুষ্ঠান হয় বা ধর্মীয় কোন অনুষ্ঠান হয় সেখানে বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রতিনিধিরা আসেন। এটা কিন্তু আছে, একেবারে নাই যে তা না। আর আমরা যে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চেতনা ধারণ করি, বাংলাদেশে সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের অধিকার আছে। আমি সব সময় বলি ধর্ম যার যার উৎসব সবার। এটা আমরা যথাযথভাবে মেনে চলি।
পাইপ লাইনে জ্বালানি আসবে বাংলাদেশে ॥ সংবাদ সম্মেলনে জ্বালানি সঙ্কটের সমস্যার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারতের শিলিগুড়ি থেকে বাংলাদেশের দিনাজপুরের পার্বতীপুর পর্যন্ত ভারত-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইনের মাধ্যমে ডিজেল আসবে। ফলে তেল পরিবহনের খরচ অনেকটা কমে যাবে। এ প্রকল্পের আওতায় ১৩১ দশমিক ৫৭ কিলোমিটার পাইপলাইন রয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ অংশে রয়েছে ১২৬ দশমিক ৫৭ এবং ভারত অংশে ৫ কিলোমিটার পাইপলাইন ভারত সরকারের অর্থায়নে নির্মাণ কাজ চলছে। দিনাজপুরের পার্বতীপুর ডিপোতে এই তেলটা থাকবে। উত্তরবঙ্গে আর সুদূর চট্টগ্রাম থেকে বাঘাবাড়ি হয়ে তেল যেতে হবে না। রিফাইন করা তেল ওখান থেকেই আসবে।
অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্য আরও বাড়বে। উত্তরবঙ্গের মঙ্গা আমরা দূর করেছি। পাশাপাশি ভারত থেকে এলএনজি আমদানির ব্যাপারেও আলোচনা হয়েছে। ভারত যে এলএনজি নিয়ে আসছে, সেখান থেকে খুলনা অঞ্চলের জন্য যেন এলএনজি পেতে পারি সেই আলোচনা হয়েছে। হাসতে হাসতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, মনে হয় না যে একেবারে শূন্য হাতে ফিরে এসেছি।
রোহিঙ্গা ইস্যুতে ভারত ইতিবাচক, সমস্যা মিয়ানমারের ॥ রোহিঙ্গা ইস্যুতে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ভারতকে আমরা বলেছি তারা যেন মিয়ানমার ইস্যুতে সহযোগিতা করে। তাদের ইতিবাচক সাড়া পেয়েছি। সমস্যা হয়ে গেছে মিয়ানমারের সরকারকে নিয়ে। যে যতই চাপ দিক এরা কোন ব্যাপারই নেয় না। এরা নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লিপ্ত আছে। এখানেই বড় সমস্যা। ভারত মনে করে এটার সমাধান হওয়া উচিত।
তিনি আরও বলেন, আমরা মানবিক কারণে তাদের স্থান দিয়েছি, কিন্তু এখন যে পর্যায়ে যাচ্ছে তারা (রোহিঙ্গা) আমাদের জন্য বড় একটা বোঝা হয়ে যাচ্ছে। তারাও তো মানুষ, আমরা তো ফেলে দিতে পারি না। আজকে শরণার্থী তো সব জায়গাতেই হচ্ছে। ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধে কত মানুষ শরণার্থী হয়ে যাচ্ছে। এ জন্য আমাদের সবসময়ের আহ্বান আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। মানুষের কল্যাণ হোক সেটাই চাই।
তারা তো সবকিছু ভুলে যায় ॥ যারা সমালোচনা করে তাদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বন্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে আমরা একটি স্মারক সই করলাম। তার মাধ্যমে সিলেট বিভাগের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে। এসব বিষয় নিয়ে যারা সমালোচনা করে তারা কী এনেছিলেন? তারা তো সবকিছু ভুলে যান। তিনি বলেন, কুশিয়ারার পানি বণ্টনে সমঝোতা নিয়ে অনেকেই সমালোচনা করছেন। কতটুকু পানি আসল সেটা নিয়ে তাদের এই সমালোচনা।
আমরা যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করলাম, এর ফলে পুরো সিলেট বিভাগ বিশেষ করে সিলেটের গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, কানাইঘাট, সিলেট সদর, জকিগঞ্জ উপজেলার ৫৩ হাজার ৮২০ হেক্টর এলাকায় বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন হবে। সেচ প্রদানের জন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। এতগুলো জমি চাষের আওতায় এসে ফসল দেবে, সেই ফসল আমাদের দেশের মানুষেরই কাজে লাগবে।
ভারত সফরে জামদানি শাড়ি পরা নিয়ে যা বললেন প্রধানমন্ত্রী ॥ ভারতে চার দিনের রাষ্ট্রীয় সফরের প্রায় সবটা জুড়েই বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের ঐতিহ্য জামদানি শাড়ি পরেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এসব জামদানি শাড়ির সৌন্দর্য, বুনট আর ডিজাইন ভারতে সবারই নজর কাড়ে। বিষয়টিকে প্রধানমন্ত্রীর ‘জামদানি কূটনীতি’ হিসেবে উল্লেখ করেন অনেকে। তাৎক্ষণিকভাবে এই ব্র্যান্ডিংয়ের সুফলও মেলে। প্রধানমন্ত্রী সেখানে থাকা অবস্থায়ই দিল্লীতে আন্তর্জাতিক এক মেলায় বাংলাদেশি শাড়ির বিক্রয় কেন্দ্রে উপচেপড়া ভিড় তৈরি হয়।
এ বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেসে বলেন, অন্তত একটা বিষয়ে আমি খুশি যে আমাদের তাঁতিরা কাজ পারেন। সুফলটা তাদের হাতেই যাবে। এটা বাস্তব কথা। আমি যখন যেখানে যাই, আমার নিজের দেশের যেটা আছে সেটাই ব্যবহার করি। নিজের দেশকে তুলে ধরার চেষ্টা করি। দেশের পণ্যটা মানুষের সামনে তুলে ধরার চেষ্টা করি। দেশের পণ্য যাতে ভাল বাজার পায় সেই চেষ্টা আমি করি। করব না কেন?
দু’দেশের সম্পর্কের নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে ॥ সাম্প্রতিক ভারত সফরের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোভিড মহামারীর পরিপ্রেক্ষিতে দীর্ঘ তিন বছর বিরতির পর আমার এই সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের সূচনা হয়েছে। সফরের পুরো সময়ে আমরা ভারতের আন্তরিকতার বহির্প্রকাশ ও সৎ-প্রতিবেশী হিসেবে সমতা ও শ্রদ্ধার ভিত্তিতে দুই দেশের সহযোগিতা অব্যাহত রাখার অঙ্গীকার লক্ষ করেছি।
ভারতীয় নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায়ে, সংবাদ মাধ্যমে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে আমি বাংলাদেশের জন্য যে প্রীতি ও সৌহার্দ্য লক্ষ করেছি তা সত্যিই অসাধারণ। এই প্রীতির সম্পর্ককে সুসংহত করে আমরা আরও এগিয়ে যেতে চাই। আর এই সফরে সহযোগিতার যেসব ক্ষেত্র চিহ্নিত হয়েছে এবং বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা বাস্তবায়ন করলে উভয় দেশের জনগণ উপকৃত হবে। সব মিলিয়ে পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে এ সফরের মাধ্যমে দুই দেশের একসঙ্গে নতুনভাবে এগিয়ে চলার গতি সঞ্চার হয়েছে। উভয় দেশের জনগণের কল্যাণে এই সহযোগিতার ধারা অব্যাহত থাকবে এবং বাংলাদেশ ও ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়া অচিরেই একটি সমৃদ্ধশালী অঞ্চলে পরিণত হবে।
ঐতিহাসিকভাবে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্কের কথা তুলে ধরে সরকার প্রধান বলেন, ভারত আমাদের কাছের প্রতিবেশী এবং বন্ধুরাষ্ট্র। ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। ভাষা ও সংস্কৃতির সাযুজ্যের কারণে আমাদের সম্পর্ক প্রগাঢ় হয়েছে। এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালে সহায়তা ও স্বাধীনতা পরবর্তীকালে সহযোগিতা এ বন্ধুত্বকে বিশেষত্ব দিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তম দেশ ভারত অর্থনৈতিক ও প্রযুক্তিগত ক্ষেত্রে ইতোমধ্যেই প্রভূত সাফল্য অর্জন করেছে।
প্রধানমন্ত্রী জানান, ঐতিহাসিক মুজিবনগর থেকে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত পর্যন্ত ‘স্বাধীনতা সড়ক’ চালু করা হবে। এ সফরের উল্লেখযোগ্য অর্জন হিসেবে ভুটানের সঙ্গে রেল যোগাযোগ ও অন্যান্য আন্তঃসীমান্ত রেল সংযোগে ভারতের বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা হবে।