.
বিশ্বজুড়ে যখন জ্বালানির বাজারে অস্থিরতা চরমে তখন দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি দেখাচ্ছে আশার আলো। বর্তমানে দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ৯১০.৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হচ্ছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চলমান রয়েছে আরও অন্তত ৩২টি প্রকল্পের কাজ। এগুলো থেকে পাওয়া যাবে আরও এক হাজার ৪৪২ মেগাওয়াট বিদ্যুত। শুধু তাই নয় প্রক্রিয়াধীন আরও ৭৬টি প্রকল্প। এইসব প্রকল্পে উৎপাদন হবে প্রায় ৪ হাজার ৬৩২ মেগাওয়াট বিদ্যুত। পাশাপাশি আমদানি প্রক্রিয়া চূড়ান্ত হয়েছে নেপালের জলবিদ্যুতেরও। এই খাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ভবিষ্যতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
পাওয়ার সেলের তথ্যমতে, সরকারীভাবে বিদ্যুতের উৎপাদন ক্ষমতা ২৫ হাজার ৭০০ মেগাওয়াটের কথা বলা হলেও বর্তমানে সর্বোচ্চ উৎপাদন হচ্ছে ১৮ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত। এর বাইরে ভারতের আদানি থেকে আমদানি করা হবে ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট বিদ্যুত। সম্প্রতি উদ্বোধন হওয়া রামপাল থেকে জাতীয় গ্রীডে যোগ হবে আরও ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট। নেপাল থেকে ৫০০ মেগাওয়াটের জলবিদ্যুতের পাশাপাশি জিটুজি ভিত্তিতে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের আমদানি প্রক্রিয়া চূড়ান্ত। এসব মাধ্যমে দেশে বিদ্যুতের সরবরাহ ছাড়াবে ২১ হাজার ৩৬৬ মেগাওয়াটের বেশি। পাওয়ার সেলের সর্বশেষ তথ্যমতে, গত ১৬ এপ্রিল উৎপাদিত হয়েছে সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুত।
তবে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেছেন, দেশে বর্তমানে বিদ্যুত উৎপাদিত হচ্ছে ১৮ হাজার মেগাওয়াট। চাহিদা রয়েছে ১৫ হাজার মেগাওয়াট। এই চাহিদা পূরণে ডিজেল চালিত বিদ্যুত কেন্দ্রগুলোর ওপরও অনেকাংশে নির্ভরশীল হতে হচ্ছে। তাই নবায়নযোগ্য জ্বালানির এসব প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে উচ্চ মূল্যে ডিজেল দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদন করতে হবে না। চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের সরবরাহ থাকবে আরও বেশি।
বিদ্যুত বিভাগ বলছে, জ্বালানি সঙ্কটে দেশে দেশে বিদ্যুত উৎপাদনে সঙ্কট সৃষ্টি হচ্ছে। তাই নতুন করে জোর দেয়া হচ্ছে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে। বাংলাদেশও বিদ্যুত উৎপাদনে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দেয়া হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় সম্প্রতি স্বাক্ষরিত হয়েছে বর্জ্য থেকে বিদ্যুত উৎপাদনের একটি চুক্তি। নারায়ণগঞ্জের জালকুড়িতে বাস্তবায়িত হতে যাওয়া ৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন এই বিদ্যুতকেন্দ্রটি স্থাপন হলে এই কেন্দ্র থেকে ইউনিট প্রতি প্রায় ২০ টাকায় বিদ্যুত কেনা হলেও মাত্র ৫ থেকে ৬ টাকায় বিক্রি করা যাবে জানিয়ে বিদ্যুত, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, এই ঘাটতির সংস্থান করবে বিদ্যুত বিভাগ। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, এর মূল কারণ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী চেয়েছেন দেশের সব বর্জ্য ব্যবস্থাপনার একটি নির্দিষ্ট কাজ হোক। তার এই আগ্রহের কারণেই এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। শুধু তাই নয় এই কেন্দ্রটি স্থাপন হলে নারায়ণগঞ্জের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অনেক ভাল অবস্থানে আসবে। এই কেন্দ্র থেকে নো পেমেন্ট নো-ইলেকট্রিসিটি অনুযায়ী বিদ্যুত নেয়া হবে। এখান থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুত ২০ দশমিক ৯১ সেন্টে কিনবে পিডিবি। এই চুক্তি সইয়ের পর ৪৫৫ দিনের মধ্যে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে বলেও জানান তিনি।
শুধু বর্জ্য বিদ্যুত নয় জোর দেয়া হচ্ছে বায়ু বিদ্যুতেও। মোংলায় ৫৫ মেগাওয়াট ক্ষমতার বায়ুবিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করতে যাচ্ছে সরকার। এ জন্য বাংলাদেশ বিদ্যুত উন্নয়ন বোর্ড-বিপিডিবি গত রবিবার সন্ধ্যায় চীনের একটি কনসোর্টিয়ামের সঙ্গে চুক্তি সই করেছে। এই চুক্তির আওতায় কনসোর্টিয়াম অব ইনভিশন এনার্জি, জিয়াংসু কোম্পানি লিমিটেড, চায়না, এসকিউ ট্রেডিং এ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, বাংলাদেশ ইনভিশন রিনিউয়েবল এনার্জি লিমিটেড, হংকংয়ের যৌথ উদ্যোগে এই মোংলা গ্রিন পাওয়ার প্লান্ট নির্মাণ করবে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমানে যদিও বায়ু থেকে মাত্র ২৯ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন করা হয় কিন্তু ৩টি প্রকল্পের মাধ্যমে ১৪৫ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের কাজ চলমান। ৫টি প্রকল্পের অধীনে আরও ২৩০ মেগাওয়াট বায়ুবিদ্যুত প্রক্রিয়াধীন। বায়ুভিত্তিক বিদ্যুতকেন্দ্রের আকার আরও বড় হবে। বিদ্যুত বিভাগ আমেরিকার ন্যাশনাল রিনিউয়েবল এনার্জি ল্যাবরেটরি প্রদত্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে বলছে, বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকা বিশেষত খুলনার দাকোপ, চট্টগ্রামের আনোয়ারা এবং চাঁদপুরের নদী মোহনার এলাকায় ১০০ মিটার উচ্চতায় বাতাসের গড়বেগ প্রতি সেকেন্ডে ৬ মিটারের বেশি, যা বায়ুবিদ্যুত উৎপাদনে অত্যন্ত সম্ভাবনাময়। পিডিবি জানায়, ২০ বছর মেয়াদী এই কেন্দ্র থেকে প্রতি ইউনিট বিদ্যুত কেনা হবে ১৩ টাকায়। প্রকল্পটির আনুমানিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৯৬.৫৯৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। চুক্তি সইয়ের দুই বছরের মধ্য কেন্দ্রটি উৎপাদনে আসার কথা রয়েছে।
বায়ুবিদ্যুতের আকার বড় করার বিষয়ে নসরুল হামিদ বলেন, বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অন্যতম উৎস হিসেবে বায়ুবিদ্যুতের আকার দিনে দিনে আরও বড় হবে। উপকূলীয় অঞ্চলসহ দেশের ৯টি স্থানে বায়ুবিদ্যুতের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের উদ্দেশে বায়ু প্রবাহের তথ্য-উপাত্ত (ডাটা) সংগ্রহ করে ওয়াইন্ড ম্যাপিং কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়েছে। সার্বিক উপযুক্ততা যাচাই করে বায়ুবিদ্যুত প্রকল্প গ্রহণ করা হবে।
জোর দেয়া হচ্ছে সৌরবিদ্যুত উৎপাদনেও। সৌরবিদ্যুত উৎপাদনে ইতোমধ্যে সরকারী কোম্পানিগুলোকে লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বেসরকারী উদ্যোক্তারাও সৌর বিদ্যুতকেন্দ্র নির্মাণে দৌড়ঝাঁপ করছে। বিদ্যুত বিভাগ বলছে, ভারত তাদের দেশের ফসিল ফুয়েল বা জীবাশ্ম জ্বালানিতে বিদ্যুত উৎপাদনকারীদের একটি লক্ষ্য নির্ধারণ করে দিয়েছে।
বিদ্যুত উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো যে পরিমাণ বিদ্যুত উৎপাদন করবে তার ১০ ভাগ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুত উৎপাদন করতে হবে। এই নীতিতে দেশটিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুত উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অগ্রসর হয়েছে। যদিও বাংলাদেশে এ ধরনের কোন বাধ্যবাধকতা নেই কিন্তু তবুও পিছিয়ে নেই সরকার। পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী দেশে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনায় ৩ হাজার ৬৬৬ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে।
পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, সোলার পার্ক থেকে এক হাজার ৪০০ মেগাওয়াট, সোলার রুফটপ থেকে ৬৩৫ মেগাওয়াট, সোলার হোম সিস্টেম থেকে ১০০ মেগাওয়াট, সোলার সেচ প্রকল্প থেকে ৬৩৭ মেগাওয়াট, বায়ুবিদ্যুত থেকে ৬৩৭ মেগাওয়াট, বায়োমাস বা বিশেষ করে ধানের তুষ থেকে ২৭৫ মেগাওয়াট, এনিমেল ওয়েস্ট থেকে ১০ মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে। আরও ৬০ মেগাওয়াটের জলবিদ্যুত এবং ৩ মেগাওয়াটের হাইব্রিড বিদ্যুকেন্দ্রও নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে।
এসব উৎসের পাশাপাশি নবায়নযোগ্য জ্বালানির নতুন উৎস হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল ব্যবহারেরও চেষ্টা করা হচ্ছে। সম্প্রতি বিদ্যুত বিভাগ এ সংক্রান্ত একটি গবেষণা করার উদ্যোগ নিয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সঙ্কটের মধ্যে হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল হতে পারে নতুন জ্বালানি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল দিয়ে বিদ্যুত উৎপাদনের পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। যা বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে কাজ করছে বাংলাদেশও।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্রাইটেরিয়া পূরণে আমদানি করা হচ্ছে জলবিদ্যুতও। এ বিষয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, নেপাল থেকে ৫৫০ মেগাওয়াট জলবিদ্যুত আনবে বাংলাদেশ। প্রাথমিকভাবে জিটুজি ভিত্তিতে ৫০ মেগাওয়াট বিদ্যুত আমদানির বিষয়ে দুই দেশ ঐকমত্যে পৌঁছেছে। এই বিদ্যুত ভারত হয়ে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা দিয়ে দেশে আসবে। এ জন্য দিল্লীর সঙ্গে ঢাকা ও কাঠমা-ুর ত্রিপক্ষীয় চুক্তি সই করতে হবে। এ সংক্রান্ত সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশ ও নেপাল যৌথভাবে ভারতকে অনুরোধ করতে রাজি হয়েছে বলেও জানান তিনি।
সাম্প্রতি নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দেয়ার প্রসঙ্গে মোহাম্মদ হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, এ ধরনের বিদ্যুত উৎপাদনের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে আমাদের বিদেশ থেকে জ্বালানি আমদানি করতে হবে না। একইসঙ্গে পরিবেশেরও দূষণ হবে না। আমরা হাইড্রোজেন ফুয়েল সেল নিয়ে গবেষণা করছি। এছাড়া নতুন নতুন উৎস থেকে বিদ্যুত উৎপাদন করা যায় কিনা তাও দেখা হচ্ছে। তিনি বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। যা চট্টগ্রামের কাপ্তাই-এ কর্ণফুলী নদীর ওপর দেশের প্রথম পানিবিদ্যুত কেন্দ্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে ১৯৫৭ সালে শুরু হয়। ১৯৮৮ সালের অক্টোবর মাসে এই কেন্দ্রে ৫০ মেগাওয়াট কাপলান টাইপের টার্বাইন সংবলিত চতুর্থ এবং পঞ্চম ইউনিট স্থাপন করা হয় যাতে মোট বিদ্যুত উৎপাদন ২৩০ মেগাওয়াট পর্যন্ত বৃদ্ধি পায়। আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে সিলেটে প্রথম সোলার হোম সিস্টেম স্থাপনে বেসরকারী উদ্যোগ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। পরবর্তীতে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেড (ইডকল) কর্তৃক সোলার হোম সিস্টেম (এসএইচএস) কর্মসূচী ব্যাপকভাবে সম্প্রসারিত হয়। ১৯৯৬ সালে এসএইচএস চালু হওয়ার পর থেকে এটি বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্মসূচী। এ পর্যন্ত প্রায় ৬ মিলিয়ন সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইডকলের মাধ্যমে সরকার কর্তৃক গৃহীত সমন্বিত কর্মসূচীর কারণে এর সংখ্যা বাড়ছে। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক সঙ্কটে নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রসারে বিদ্যুত বিভাগ নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছে বলেও দাবি করেন তিনি।