চা বাগান
এখানে-ওখানে ভেঙে পড়েছে মাটির দেওয়াল। অর্থের অভাবে নিজের থাকার ঘরটি ঠিকও করতে পারছেন না চা শ্রমিক পূর্ণিমা কন্দ। বছরখানেক আগে স্বামী অনিল কন্দের মৃত্যুর পর থেকেই ঘরের সাতজন বাসিন্দাকে নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই করছেন তিনি। তার আয়েই চলে সংসার। তিনি অসুস্থ হলে সবার ভাতের যোগাড় বন্ধ হয়ে যায়, কিংবা অন্যের কাছে হাত পাতা লাগে। নিত্যসঙ্গী অভাবে সবার শরিরে পুষ্টির অভাবও স্পষ্ট। আর্থিক এমন টানা পোড়নের মধ্যেই মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার আলীনগর চা বাগানের অন্যান্য শ্রমিকের সঙ্গে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে টানা ১৯ দিন কর্মবিরতীতে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। গত শুক্রবার সকালে কথা হয় পূর্ণিমা কন্দের সঙ্গে। কথা বলার আগেই ঘরের ভেতরটা দেখাতে চাইলেন পূর্ণিমা। দৃশ্যটা এমন, মনে হলো এই বুঝি মাটির দেওয়াল ভেঙ্গে পড়বে। এক ঘরেই গাদাগাদি করে বাস করছেন সাত জন সদস্য।
পূর্ণিমা জানালেন, ‘এখন কীভাবে আমাদের দিন যাচ্ছে, তা কেবল আমরাই জানি। দোকান থেকে বাকিতেও সদাই মিলছে না। গ্রামের ওই মাথার এক বাড়ি থেকে সকালে দুইলা (অল্প কিছু) চাইল ধার আইনা রানছি। রাতে কিতা (কি) রানমু এখন সেই চিন্তায় আছি।’ পূর্ণিমার বড় ছেলে রাখাল কন্দ পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। ২ মেয়ে গঙ্গা ও যমুনা পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে। ছোট ছেলে রাজা কন্দ পড়ে শিশু শ্রেণিতে। পূর্ণিমার ৭০ বছর বয়সী শ্বশুর গোজা কন্দ জানালেন, তারা এখন একবেলা ভাত খাচ্ছেন। বাকি ২ বেলা লবন দিয়ে লাল চা ও মুড়ি খেয়ে কাটাচ্ছেন। পূর্ণিমার শাশুড়ি সারো কন্দের বয়সও ৬০ পেরিয়েছে।
তিনি বলেন, ‘পুর্ণিমা শেষ যেবার পুরো মজুরি পাইসিলো, তখন বাজার থেকে আধাকেজি তেলাপিয়া মাছ আনছিলো।’ তবে এই পরিবারের সদস্যরা শেষ কবে মাংস খেয়েছেন তা মনে করতে পারেননি কেউ। চা বাগান এলাকায় প্রায় সব চা শ্রমিকের অবস্থাই পূর্ণিমা কন্দের মতো। সহজ করে বললে, মালিকপক্ষের কাছ থেকে অনুগ্রহের দান হিসেবে মোটাদাগে তিনটি জিনিস পায় চা শ্রমিকেরা। মাথা গোঁজার ঠাঁই হিসেবে ২২২ বর্গফুটের জায়গায় একখানা ঝুপড়ি, গড়ে ৩ কেজির মতো রেশন (চাল অথবা গম), আর প্যারাসিট্যামলনির্ভর চিকিৎসা সেবা। কিছু এনজিওর বদান্যতায় প্রাথমিক শিক্ষা কার্যক্রম চললেও সাংস্কৃতিক ভিন্নতা, সুযোগের সীমাবদ্ধতা, দারিদ্র্য ও যোগাযোগের বৈরী পরিবেশে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয় সেখানকার শিশুরা। দারিদ্র্যের থাবায় শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঝরে পড়ার হারও বেশ প্রবল।
খাদ্য বিষয়ক ইতিহাসবিদ এরিকা র্যাপোর্ট তার ‘এ থার্স্ট ফর এমপায়ার: হাউ টি শেপড মডার্ন ওয়ার্ল্ড’ বইতে লিখেছেন, ১৮৩০ সালের দিকে ব্রিটিশরা প্রতি বছর প্রায় ৪০ মিলিয়ন পাউন্ড চা পান করতো। এটা আসতো মূলত চীন থেকে। কিন্তু ব্রিটিশদের চায়ের প্রতি আগ্রহ তৈরি হয়েছিল আরও আগে থেকে। তখন মূলত চীন থেকে ব্রিটেনে চা আমদানি করা হতো। অ্যাংলো-ডাচ যুদ্ধের কারণে চীন চায়ের রপ্তানি বন্ধ করে দেয়ার পর ব্রিটিশরা বিকল্প উৎস খুঁজতে শুরু করে। চীনের ওপর নির্ভরশীলতা কাটাতে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় চা চাষের পরিকল্পনা শুরু করে। আসামে চায়ের একটি জাত আবিষ্কার করার পর ওই এলাকায় চা চাষে তারা বিশেষভাবে মনোযোগী হয়ে ওঠে।
এভাবে দার্জিলিং, আসাম, সিলেটে তারা কয়েকটি চা বাগান প্রতিষ্ঠা করে। বাংলাদেশে চায়ের চাষাবাদ প্রথম শুরু হয় ১৮৪০ সালে। চট্টগ্রামে কুণ্ডুদের বাগান নামে সেই চা বাগান অবশ্য সাফল্যের মুখ দেখেনি। এরপর ১৮৫৪ সালে সিলেটের মালনিছড়ায় প্রথম বাণিজ্যিক চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। তিন বছর পর সেই বাগান থেকে প্রথম বাণিজ্যিকভাবে চায়ের উৎপাদন শুরু হয়।
‘হিস্টরি অব টি গার্ডেনস অ্যান্ড টি ওয়ার্কার্স অফ বাংলাদেশ’ বইয়ে রিয়াদ মাহমুদ ও আলিদা বিনতে সাকি উল্লেখ করেছেন, ১৮৬০-৭০ সালের দিকে আসাম ও সিলেট অঞ্চলে চা বাগানে বাণিজ্যিক সাফল্য দেখা দেয়ায় অনেক বিদেশি কোম্পানি বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে ওঠে। ফলে চা বাগান বাড়তে শুরু করে। সেই সঙ্গে আরও বেশি শ্রমিকদের চাহিদা দেখা দেয়। ১৯১০ সালের মধ্যেই সিলেট এলাকায় ১৫৪টি চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়, যার মালিক ছিল ইউরোপীয়রা।
বাংলাদেশ চা-বোর্ডের তথ্য অনুসারে দেশের ১৬৭ চা-বাগানে ৫ লাখের বেশি চা-জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্থায়ী শ্রমিক প্রায় এক লাখ। শ্রমিকদের মধ্যে ৫২ শতাংশই নারী। পাতা বা কুঁড়ি তোলার প্রধান কাজটিই করেন নারী চা-শ্রমিকেরা। এর বাইরে নার্সারিতে চারা কলমের কাজ করেন। পুরুষ শ্রমিকরা বেশির ভাগ সময় চা বাগান পরিস্কার, চা বাগানে বিষ ব্যবহার, চকিদারী ও চা ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন। মৌলিক চাহিদা পূরণে মজুরি বৃদ্ধি, ভ‚মি অধিকার, বাসস্থান ও চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নসহ বিভিন্ন দাবি চা শ্রমিকদের। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রতিটি সরকার তা বাস্তবায়নের আশ্বাস দিলেও তা আলোরমুখ দেখেনি খুব একটা।
ফলে মানবেতর জীবনযাপন করতে হচ্ছে তাদের। চা শ্রমিকরা তাদের শ্রম দিয়ে চা বাগান আগলে রাখলেও তাদের শিক্ষা ও চিকিৎসা এখন সেই অবহেলিত রয়ে গেছে। সরকার তাদের আবাস্থল নিজ নিজ মালিকানায় করে দেবে বলেও এখনো এর কোনো অগ্রগতি হচ্ছে না। আর এ জন্য দীর্ঘদিন ধরে ভূমি নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম করে আসছেন চা শ্রমিকরা।
শিক্ষা, স্বাস্থ্য-বাসস্থান: মৌলিক চাহিদা যেখানে বিলাসিতা \ অধিকাংশ শ্রমিকদের কাছ থেকে জানা গেল, ঘরের সঙ্গে নেই রান্নাঘর বা টয়লেট সুবিধা। বৃষ্টির দিন ফুটা চাল দিয়ে পানি পড়ে। সেগুলোও মেরামত করে দেয় না মালিকপক্ষ। নিজেদের পয়সায় তা মেরামত করতে হয়। বেশিরভাগ শ্রমিকেরই নিজের বাসস্থান বা থাকার ঘর মেরামতে বাড়তি খরচের সংগতি নেই। তাই ভঙ্গুর ঘরেই থাকতে হয়। আবার কোথাও কোথাও একটি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকজন শ্রমিককে। ভাড়াউড়া বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি নুর মিয়া জনকণ্ঠকে বলেন, এখানে কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে গিয়ে বিভিন্ন সমস্যার মুখে পড়তে হয়। অনেক সেকশনে ছাউনি নেই। বৃষ্টির সময় কষ্টের সীমা থাকে না।
সরেজমিনে বিভিন্ন বাগান ঘুরে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চা বাগানে শ্রমিকদের অধিকাংশ সদস্যই কোনো না কোনো রোগে আক্রান্ত। রোগ বালাই যেন ওদের নিত্যসঙ্গী।অধিকাংশ চা বাগানের নির্ধারিত কম্পাউন্ডারে (হাসপাতাল) গেলে সব রোগের ঔষধ হিসেবে দেওয়া হয় কয়েকটি প্যারাসিটামল ট্যাবলেটল।
চা শ্রমিক নেতা বিজয় হাজরা জনকণ্ঠকে বলেন, একজন অসুস্থ চা শ্রমিক মেডিকেলে অসুস্থজণিত তালিকায় নাম লেখাতে গেলে দীর্ঘসময় ধরে মেডিকেলের বারান্দায় বসে অপেক্ষা করতে হয়। রোগীদের জন্য স্যালাইন, নাপা, ইসটাসিন, প্যারাসিটামল, মেট্রিক আর কুইনাইন ছাড়া এখানে আর কোনো ওষুধ পাওয়া যায় না। অন্যদিকে শ্রম আইন অনুযায়ী, দেশের কোনো চা বাগানে ২৫ জন শিক্ষার্থী থাকলেই সেখানে বাগান কর্তৃপক্ষকে স্কুল প্রতিষ্ঠা করতে হবে। কিন্তু এই নিয়ম মানে না অধিকাংশ বাগান মালিকরা। আবার সরকারিভাবে বিভিন্ন বাগানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও তা জনসংখ্যার অনুপাতে অপর্যাপ্ত বলে মনে করছেন চা শ্রমিক নেতারা। আবার কোনো কোনো বাগানে রয়েছে এনজিও পরিচালিত বিদ্যালয়ও। চা শ্রমিক নেতারা জানান, অধিকাংশ বাগানেই প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকলেও মাধ্যমিক শিক্ষার ব্যবস্থা নেই। ফলে প্রাথমিকের পরে ঝরে পড়েন বেশিরভাগ শিক্ষার্থী। মাধ্যমিক স্কুলে লেখাপড়া করার জন্য শিক্ষার্থীদের কয়েক কিলোমিটার দূরে যেতে হয়। আবার অর্থসংকটসহ নানা কারণে তারা ঝরে পড়েন।
তাই প্রতিটি বাগানের আশপাশে মাধ্যমিক স্কুল তৈরি করা প্রয়োজন। দুর্বার উন্নয়ন সহায়ক সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ও বিশ্ববিদ্যালয় চা ছাত্র সংসদের উপদেষ্টা রাজু দেশোয়ারা জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারের নানা চেষ্টায চা বাগানগুলো দিনদিন শিক্ষার হার বাড়ছে ঠিকই তবে যুগোপযোগী শিক্ষা পাচ্ছে না। তিনি বলেন, প্রাথমিক বিদ্যালয় পেরুলেই ঝরে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে। প্রধানত দারিদ্র্যতার কারণে বেশিরভাগ ছেলে মেয়েকেই জীবন সংগ্রামে জড়িয়ে পড়তে হয়। এ লড়াই বেঁচে থাকার। যে সকল শিক্ষার্থী দারিদ্র্যতার সাথে পেরে উঠতে পারে তারা স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজেও পড়ছে। তবে নানা প্রতিবন্ধকতায় জর্জরিত শিক্ষা জীবনে মাধ্যমিকে ভালো ফল না থাকায় অনেকেই ভালো কলেজে ভর্তি হতে পারে না। এমনিভাবে উচ্চ মাধ্যমিকেও ভালো ফল না থাকায় সরকারি কলেজেও সুযোগ পায় না। ফলে যারা নিজস্ব আগ্রহে পড়তে চায় তারা ডিগ্রি কোর্সে ভর্তি হয়। এই প্রতিযোগিতামূলক উচ্চশিক্ষায় এই ঝরে পড়ার হার অনেক বেশি। কারণ কলেজ পেরিয়ে অনেক যুবক-যুবতীকেই সংসারের হাল ধরতে হয় ফলে আর পড়াশোনা হয় না। যারাও অবশিষ্ট থাকে তারা সরকারি কলেজগুলোতে পড়ে। আর সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সুবিধা না পাওয়া, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো ফল না করা, আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তিতে প্রস্তুতি নিতে না পারা এ সকল নানাবিধ প্রতিবন্ধকতার শিকার চা বাগানের শিক্ষার্থীরা তবুও থেমে থাকে না। তুখোড় মেধা ও প্রবল আত্মবিশ্বাসের বলে এখন পর্যন্ত প্রায় ৮০ জন চা বাগানের শিক্ষার্থী ঢাবি, জাবি, জবি, রাবি, বেরোবি, কুবি, শাবিপ্রবি, সিকৃবি, ঢাকা মেডিকেল, সিলেট মেডিকেল পড়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে।
১৬৮ বছরে চা-শ্রমিকের দৈনিক মজুরি এখন ১৭০ টাকা
‘দেশে চা-শিল্পের ১৬৮ বছরের ইতিহাসে চা-শ্রমিকদের মজুরি এখন ১৭০ টাকা। অর্থাৎ চা শিল্পের ইতিহাস থেকে মাত্র ২ টাকা বেশি একজন শ্রমিকের দৈনিক মজুরি। টানা ১৯ দিন আন্দোলনের পর গত শনিবার চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারণ করে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে চা শ্রমিকদের দাবি ছিল দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকার। মজুরি বাড়ানোর দাবিতে ৯ আগস্ট থেকে দুই ঘণ্টা কর্মবিরতি এবং ১৩ আগস্ট থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশের চা–বাগানগুলোয় অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট করেছিলেন শ্রমিকেরা। দাবি আদায়ে এই সময়ে উত্তাল ছিল চা–বাগানগুলো। আন্দোলন সফল করতে শ্রমিকদের সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করতে দেখা গেছে।
চা-শ্রমিক সংঘ মৌলভীবাজারের আহ্বায়ক রাজদেও কৈরী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘চা-শিল্পের ১৬৮ বছরের ইতিহাসে আজ মজুরি দাঁড়াল মাত্র ১৭০ টাকা। যা ১ লিটার তেলের দামও না। বর্তমান বাজারদরের সঙ্গে সংগতি রেখে ৬-৭ জনের পরিবারের ভরণপোষণের জন্য দৈনিক ৬৭০ টাকা মজুরি, বছরে ১০ দিন নৈমিত্তিক ছুটি, অর্জিত ছুটি, গণতান্ত্রিক শ্রম আইন প্রণয়ন, নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সার্ভিসবুক ও ৯০ দিন কাজ করলেই একজনকে শ্রমিককে স্থায়ী করার বিষয়টি বাস্তবায়ন প্রয়োজন।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুারোর (বিবিএস) তথ্য অনুসারে, দেশে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮২৪ ডলার অর্থাৎ ২ লাখ ৬৮ হাজার ২৮০ টাকা। দৈনিক ১৭০ টাকা নতুন মজুরি নির্ধারণের পর চা-শ্রমিকদের সর্বোচ্চ আয় মাসিক ৫ হাজার ১০০ টাকা হিসেবে বার্ষিক আয় ৬১ হাজার ২০০ টাকা। তাদের মজুরি বাড়ানোর চুক্তি হওয়ার কথা প্রতি ২ বছর পর পর। ২০০৮ সালের পর গত ১৪ বছরে চা শ্রমিকদের মজুরি বেড়েছে সাড়ে ৮৭ টাকা। ২০০৮ সালে দৈনিক ভিত্তিতে নিয়োজিত একজন চা শ্রমিকের সর্বোচ্চ মজুরি ছিল ৩২ টাকা ৫০ পয়সা। ২০০৯ সালের জুলাই মাসে চা শ্রমিকদের জন্য দ্বিতীয়বারের মতো গঠিত নি¤œতম মজুরি বোর্ড চা শ্রমিকদের জন্য নি¤œতম দৈনিক মজুরি নির্ধারণ করে দেয়। তখন ‘এ’ ক্লাস বাগানের জন্য মজুরি নির্ধারণ হয় ৪৮ টাকা, ‘বি’ ক্লাস বাগানের জন্য ৪৬ টাকা এবং ‘সি’ ক্লাস বাগানের জন্য ৪৫ টাকা নির্ধারিত হয়। ২০১৪ সালের ১০ আগস্ট গোপন ব্যালটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয় বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের কার্যকরী পরিষদ। নির্বাচনের পর বাংলাদেশীয় চা সংসদের সঙ্গে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের যে চুক্তি হয় তাতে চা শ্রমিকের দৈনিক নগদ মজুরি দাঁড়ায় `এ` ক্লাস বাগানের জন্য ৮৫ টাকা, ‘বি’ ক্লাস বাগানের জন্য ৮৩ টাকা এবং ‘সি’ ক্লাস বাগানের জন্য ৮২ টাকা। এ বেতন কাঠামো ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে কার্যকর হয়। গোপন ব্যালটের মাধ্যমে চা শ্রমিক ইউনিয়নের তৃতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২০১৮ সালের ২৪ জুন। ২০১৯ সালের ১ জানুয়ারি থেকে দুই বছরের জন্য কার্যকর চুক্তিপত্র অনুসারে চা শ্রমিকদের মজুরি ‘এ’ ক্লাস বাগানের জন্য ১২০ টাকা, ‘বি’ ক্লাস বাগানের জন্য ১১৮ টাকা এবং ‘সি’ ক্লাস বাগানের জন্য ১১৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়। দৈনিক নগদ মজুরির পাশাপাশি শ্রমিক কলোনিতে একটি ঘর ছাড়াও প্রান্তিক সুবিধা হিসেবে চা শ্রমিকরা আরও কিছু সুবিধা পান। যেমন: ভাতা, হাজিরা উৎসাহ বোনাস, হ্রাসকৃত মূল্যে রেশন, ফসল উৎপাদনের জন্য ক্ষেতল্যান্ড ব্যবহারের সুযোগ (যে শ্রমিক এ সুযোগ গ্রহণ করে, তার রেশন আনুপাতিক হারে কেটে নেওয়া হয়), চিকিৎসা সুবিধা, প্রভিডেন্ট ফান্ড, পেনশন ইত্যাদি। দৈনিক মজুরি এবং অন্যান্য যেসব সুবিধা চা শ্রমিকরা পান সেসব যোগ করলে তাদের মোট দৈনিক প্রাপ্তি ২০২০ সালে এসে ২০০ টাকারও কম এমন দাবি বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও অন্যান্য অনেকের। এর মধ্যে ২০১৯ সালের শেষার্ধে চা শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণের জন্য তৃতীয়বারের মতো নি¤œতম মজুরি বোর্ড গঠন করে সরকার। মজুরি বোর্ডে শ্রমিকপক্ষের একমাত্র প্রতিনিধি ও বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের নির্বাহী উপদেষ্টা রামভজন কৈরী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘মজুরি নিয়ে এসব সমস্যার প্রধান হলো মজুরি বোর্ড। তারা এত মিটিং-আলোচনার পরও ওই সময় এক টাকাও বাড়াতে চায়নি। আমি মজুরি বোর্ডের কাছে যে প্রস্তাব করেছিলাম সেগুলো তারা উপেক্ষা করেছে। তাই আমি ওইসব মিটিং এ স্বাক্ষর না করেই বেরিয়ে এসেছি।’
শ্রমিকদের চরমভাবে হতাশ করে মঞ্জুরি বোর্ড ২০২১ সালের জুনে শ্রম মন্ত্রণালয়ে যে সুপারিশ পাঠায় তাতে শ্রমিকদের মজুরি না বাড়িয়ে ১২০ টাকাই রাখা হয়। বরং শ্রমিকরা এতদিন ধরে যেসব সুযোগ সুবিধা পেয়ে আসছেন তা কমানোর সুপারিশ করে মজুরি বোর্ড। অথচ চুক্তি অনুযায়ী, ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে চা-শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানোর কথা ছিল। বর্তমানে নতুন মজুরি বাড়ানো হলো ২০২২ সালের আগস্ট মাসে। অর্থাৎ নতুন মজুরির মেয়াদ শেষ আগামী ৪ মাস পর। এরপর আবার কবে নতুন মজুরি বাড়ানো এ বিষয়ে সুষ্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই কারও কাছে। চা-বাগান সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, শ্রমিকদের কঠোর পরিশ্রমে চা উৎপাদনে বাংলাদেশ নবমস্থানে ওঠে এসেছে। করোনাকালে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শ্রমিকরা উৎপাদনে সক্রিয় থাকায় ২০২১ সালে দেশে ৯৬ দশমিক ৫০৬ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদনের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়। প্রতিবেশী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চা-শ্রমিকরা দৈনিক ২৩২ রুপি (২৭৭ টাকা) পেয়েও মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলন করছেন। শ্রীলঙ্কা ও নেপালসহ শীর্ষ চা-উৎপাদনকারী দেশ চীন ও কেনিয়ার চেয়ে বাংলাদেশের চা-শ্রমিকদের মজুরি অনেক কম।
অন্যান্য সুযোগ–সুবিধায় ‘জোরাতালি’
শ্রমিকরা আসলে কী ধরনের সুযোগ-সুবিধা পায়, সেটি দেখতে মৌললীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার অন্তত ১০টি চা বাগানের তথ্য নিয়েছে জনকণ্ঠ। শ্রীমঙ্গল শহর থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি চা বাগান লাখাইছড়া। গত ১৯ আগস্ট এই চা-বাগানে পাহাড়ের সুড়ঙ্গ থেকে মাটি খুঁড়তে গিয়ে চাপা পড়ে চার চা শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। গত শুক্রবার সরেজমিন সেখানে গিয়ে দেখা যায়, অধিকাংশ মাটির ঘর টিনের ছাউনি ফুটা হয়ে যাওয়ায় চালের ওপর ত্রিপল টাঙানো হয়েছে। দেয়ালও খসে খসে পড়ে যাচ্ছে। অপর ঘরটিতে একটিও আস্ত টিন ব্যবহার করা হয়েছে কি না, সেটিও গভীর পর্যবেক্ষণের বিষয়। দেখলে মনে হয় পুরোনো টিনের অংশবিশেষ বা কুড়িয়ে পাওয়া টিন দিয়ে সেটি নির্মাণ করা হয়েছে। জোড়াতালি শতছিন্ন পোশাকের সঙ্গেই এর তুলনা মেলে। মাটির দেয়াল আর টিনের ছাউনির ২০ ফুট বাই ২০ ফুট একটি ঘরে ঠাঁই হয়েছে মিনা তাতির পরিবারের। কত বছর আগে সেটি বানিয়ে দেয়া হয়, সেটি মনে করতে পারেননি মিনা। ৬০ বছর বয়সী মিনা কেবল বলতে পারলেন, বিয়ের পর যখন বাগানে কাজ নেন, তখনই এটি বানিয়ে দেয় মালিক। ঘরের ওপর যে টিন রয়েছে, সেটি অবশ্য বাগান মালিক করে দেননি। ছন দিয়ে কোনো রকমে মাথা গোঁজার একটি ঠাঁই করে দেয়া হয়। মিনা বলেন, ‘ছন নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর নিজেরাই টিন লাগাইছি। এখন টিনও নষ্ট হইয়া গেছে। মেঘ আইলে ঘরে পানি পড়ে।’ অন্যদের ঘরও একই ধরনের জরাজীর্ণ। নষ্ট হলে মালিকপক্ষের সেটি মেরামত করে দেয়ার কথা থাকলেও তারা দেয় না। লাখাইছড়া চা-বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সদস্য শিক্তি কন্দ বলেন, শ্রমিকদের বেশিরভাগের ঘরই নিজেদের করা। তিনি বলেন, ‘আমাদের বাগানের হাতেগোনা কয়েকজন বাগানের দেয়া ঘরে থাকেন। বাকিরা নিজেদের তৈরি করা ঘরে থাকেন। ‘বাগানমালিক যে বলে আমাদের ঘর বাবদ দিনে ৭৬ টাকা কাটা হয়, তাহলে আমাদের প্রশ্ন কেন কাটা হয়? আর যারা বাগানের ঘরে থাকে তাদের ঘরের অবস্থাও খুব খারাপ। ভাড়া যেহেতু কাটা হয়, তাহলে মালিকপক্ষ থেকে ঘর মেরামত করে দেয়ার কথা, কিন্তু শ্রমিকরা নিজেরাই সেগুলো বছরের পর বছর ধরে মেরামত করে আসছে।’
শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভাড়াউড়া চা বাগানের শ্রমিক বাসন্তি বলেন, ‘ঘরগুলো ভেঙে পড়ছে। বৃষ্টি হলে পানিতে ঘর ভিজে যায়। ঘরে থাকা যায় না। বাগানের পক্ষ থেকে এগুলো মেরামত করে দেয়ার কথা থাকলেও সেটা করে না। নিজেরাই মেরামত করছি ঘরের। তাহলে কেন এই ঘরের ভাড়া মাসের মাস কাটা হবে?’
মাঠ পর্যায়ে দেখে আসা এই দুর্দশার সঙ্গে বাগান মালিকদের বয়ান মেলে না। মালিকদের সংগঠন চা-সংসদ, সিলেট ভ্যালির সভাপতি জি এম শিবলী জনকণ্ঠকে বলেন, ‘কিছু শ্রমিকের ঘর ভাঙা থাকলেও এখন বেশিরভাগ শ্রমিকেরই আবাসন অনেক ভালো। পাকা ঘরও দেয়া হচ্ছে। প্রতি বছর এসব মেরামতের জন্য টাকা দেয়া হয়। ‘কেবল ঘর নয়, ঘরের আশপাশেও অনেক জমি থাকে, যা তারা ব্যবহার করতে পারে। তারা চাষাবাদ করে, পশুপালন করে। সবকিছু মিলিয়েই একটা ন্যূনতম ঘর ভাড়া ধরা হয়েছে। এটা মোটেই বেশি কিছু নয়।’ শ্রমিকদের কী কী সুযোগ–সুবিধা দেওয়া হয়, সেগুলো গত শনিবার প্রধানমন্ত্রীর গণভবনে কে বৈঠকে তা তুলে ধরেছেন এক বাগানমালিক।
তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতি মাসে একজন শ্রমিককে ২ টাকা কেজি দরে ৪৬ কেজি চাল দিই। যে স্বাস্থ্যসেবা সুবিধা দেওয়া হয়, সেটির বাজারমূল্য সাড়ে সাত হাজার টাকা। এ ছাড়া তাদের থাকার জন্য পরিবারপ্রতি দেড় হাজার বর্গফুট জমিতে আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়।