ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ১০ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

বিলুপ্তির পথে হাজং ভাষাবৈচিত্র্য

প্রকাশিত: ২৩:১৭, ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২২

বিলুপ্তির পথে হাজং ভাষাবৈচিত্র্য

নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও মাতৃভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে না হাজং শিক্ষার্থীরা। এ কারণে প্রাক-প্রাথমিকেই অন্যদের তুলনায় পিছিয়ে যাচ্ছে তারা। পাশাপাশি হারিয়ে যাচ্ছে তাদের ভাষাবৈচিত্র্যও। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের নেত্রকোনা, ময়মনসিংহ, শেরপুর, সুনামগঞ্জ ও সিলেটের আংশিক এলাকার ১০৮টি গ্রামে হাজং সম্প্রদায়ের বসবাস। সর্বশেষ পরিচালিত আদমশুমারি অনুযায়ী এদের জনসংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। গারোপাহাড় অঞ্চলে বসবাসরত এই ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রয়েছে। তাদের ভাষার নাম ‘হাজং ভাষা’। এ ভাষার সঙ্গে অহমিয়া ও বাংলা ভাষার গভীর সংমিশ্রণ থাকলেও উচ্চারণগত ভিন্নতা আছে। কিন্তু স্কুল-কলেজে এ ভাষা চর্চার কোন সুযোগ না থাকায় বাংলা ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে পড়ছেন তারা। ফলে হারিয়ে যাচ্ছে তাদের নিজস্ব ভাষাবৈচিত্র্য। বাংলাদেশ জাতীয় হাজং সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক পল্টন হাজং বলেন, হাজং জনগোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে হাজং ভাষায় কথা বলেন। এ কারণে তাদের ছেলেমেয়েরাও হাজং ভাষায় অভ্যস্ত হয়ে ওঠে। কিন্তু তারা যখন প্রাক-প্রাথমিকে ভর্তির পর তাদের খুব সমস্যায় পড়তে হয়। কারণ প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে হাজং ভাষার প্রচলন নেই। এছাড়া বেশিরভাগ শিক্ষকও বাঙালী। এ কারণে শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকÑউভয়েরই পরস্পরের ভাষা বুঝতে অসুবিধা হয়। হাজং শিশুরা খুব সহজে বাংলা ভাষা আয়ত্ত করতে পারে না। এটি তাদের আস্তে আস্তে আয়ত্ত করতে হয়। ততদিনে তারা অন্য শিক্ষার্থীদের তুলনায় পিছিয়ে যায়। শিক্ষা জীবনের শুরুতেই তাদের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই দীর্ঘদিন ধরে সরকারের কাছে প্রাক প্রাথমিকে হাজং ভাষায় লেখাপড়ার সুযোগ সৃষ্টি করার দাবি জানিয়ে আসছি। কিন্তু সরকার চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো ও সাঁওতাল ভাষায় কারিকুলাম তৈরি করলেও আজও হাজং ভাষায় কারিকুলাম তৈরির উদ্যোগ নেয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ জাতীয় হাজং সংগঠন, হাজং মাতা রাশিমনি কল্যাণ ট্রাস্ট, অক্সফাম ও পপিসহ কয়েকটি এনজিওর উদ্যোগে দুর্গাপুর উপজেলার গোপালপুর, মেনকি, লক্ষ্মীপুর ও ভবানিপুর এলাকার শিশুদের নিয়ে একই সঙ্গে হাজং ও বাংলা ভাষা শেখার জন্য প্রাক-প্রাথমিকের আদলে কয়েকটি হাজং বিকাশ কেন্দ্র চালু করা হয়েছিল। ছাপানো হয়েছিল হাজং ভাষার কয়েকটি পাঠ্য বইও। কিন্তু কয়েকবছর চলার পর অর্থাভাবে ওই পাইলট প্রকল্পগুলো বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া হাজং জনগোষ্ঠী দিনদিন বাংলা ভাষায় অভ্যস্ত হওয়ার কারণে তাদের নিজ ভাষায় রচিত গান, গল্প, কবিতা, ধাঁধাঁ ও প্রবাদ-প্রবচনসহ লোকসাহিত্য-সংস্কৃতির অনেক উপাদান-অনুষঙ্গও হারিয়ে যাচ্ছে। আগে তাদের সামাজিক বা ধর্মীয় উৎসব-পার্বণে হাজং ভাষার গান ও নৃত্যগীত করতে দেখা যেত। এখন সেসব ক্ষেত্রেও বাংলা ভাষা প্রাধান্য পাচ্ছে। লেখালেখিতেও হাজং ভাষার ব্যবহার খুব কম। এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুর্গাপুরের বিরিশিরিতে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত ‘ক্ষুদ্র ও নৃগোষ্ঠীর কালচারাল একাডেমি’র পরিচালক সুজন হাজং বলেন, আমরা একাডেমির উদ্যোগে হাজং ভাষায় লেখা গান, কবিতা, গল্প, ধাঁধাঁ ও প্রবাদ-প্রবচন সংগ্রহ, সম্পাদনা এবং সঙ্কলন আকারে প্রকাশ করে যাচ্ছি। তাছাড়া তাদের দেউলী উৎসবসহ বড় বড় উৎসব-পার্বণ ও কৃষ্টি-সংস্কৃতিগুলোও পালন এবং চর্চায় উদ্বুদ্ধ করছি। -সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা
×