ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ে অনন্য ভূমিকা রাখে রেডিও

প্রকাশিত: ২৩:২০, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২২

মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ে অনন্য ভূমিকা রাখে রেডিও

সমুদ্র হক ॥ মুক্তিযুদ্ধে রণাঙ্গনে হানাদার পাকিস্তানী সেনাদের বিরুদ্ধে লড়েছে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধকে দ্রুত এগিয়ে নিয়েছে। বেতার ও বেতারের শব্দসেনারা কত শক্তিশালী, নয় মাসে বিজয় অর্জন করে বুঝিয়ে দিয়েছে বাঙালীরা। মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল চাঙ্গা এবং বিজয়ে অনন্য ভূমিকা ছিল বেতারের। বেতারের এই শক্তি নিয়েই সারাবিশ্বে আজ পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব বেতার দিবস’। ইংরেজীতে ‘ওয়ার্ল্ড রেডিও ডে’। এবারের থিম ‘রেডিও এ্যান্ড ট্রাস্ট’। বাংলা ভাবানুবাদে বেতার এবং বিশ্বাস। ২০১৪ সালে জাতিসংঘে ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনের ৩৬তম অধিবেশনে সদস্য দেশগুলোর অনুমোদনে বিশ্ব বেতার দিবস ঘোষণা করা হয় প্রতিবছর ১৩ ফেব্রুয়ারি। দিবসটির তাৎপর্যে জানানো হয়, ১৯৪৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘের নিজস্ব বেতার কেন্দ্রটির যাত্রা শুরু হয়। এই তারিখটি সার্বজনীনভাবে ধরে রাখতেই দিবসটিকে অনুমোদন দেয়া হয়। বেতার সাংবাদিকতা শক্তিশালী হয়ে মানুষের দুয়ারে পৌঁছে গেছে। বাংলাদেশের সার্বিক উন্নয়নে বেতার সম্প্রচার বিপ্লব ঘটিয়েছে। সরকার পরিচালিত বাংলাদেশ বেতারসহ প্রাইভেট রেডিও, বাণিজ্যিক রেডিও, এফএম (ফ্রিকোয়েন্সি মড্যুলেশন) রেডিও, কমিউনিটি রেডিও নিত্যদিন খবরের পাশাপাশি জনকল্যাণে বহুমাত্রিক অনুষ্ঠান প্রচার করছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে ১৬ ডিসেম্বর তারিখটি স্বর্ণোজ্জ্বল হয়ে আছে আমাদের বিজয়ে। আমাদের অহঙ্কারে। ৮৩ বছর আগে। ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকার মাটিতে চালু হয় একটি বেতার কেন্দ্র। প্রথম নাম ছিল ‘ঢাকা ধ্বনি বিস্তার কেন্দ্র’। বেনিয়া ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলা ভাষায় এমন সুন্দর নামকরণ কে করেছিলেন তা জানা যায়নি। তবে বাঙালীর বাংলা ভাষাকে জাতীয় মর্যাদা এবং বাঙালীর নিজেদের একটি স্বাধীন ভূ-খ-ের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করার ব্ল্যাঙ্ক (সাদা) পাতার যাত্রা শুরু হয়েছিল এই তারিখে। এই বেতার কেন্দ্র প্রথম স্থাপিত হয় ৬২, নাজিম উদ্দিন রোডে (যা বর্তমানে শেখ বোরহান উদ্দিন পোস্ট গ্রাজুয়েট কলেজ)। কয়েকবছর পর বেতার কেন্দ্রটি স্থানান্তরিত হয় শাহবাগে। অনেক ইতিহাস এই বেতার কেন্দ্র নিয়ে। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেবেন। এই ভাষণ বেতারে সরাসরি সম্প্রচারিত হওয়ার কথা। ওই সময়ে দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ রেডিও সেট খুলে অধীর আগ্রহে অপেক্ষায়। সময় বয়ে যায় রেসকোর্স ময়দানে কানেক্টিভিটি হয় না। পাকিস্তান সেনারা প্রচার বন্ধ করে দেয়। ফুঁসে ওঠে বাঙালী। পরেরদিন সকাল আটটায় জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ভাষণ প্রচার করে। এরপর ‘বাংলাদেশ বেতার’ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নাম লেখায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১৯৭১ সালের ২৫ মে মুক্তাঞ্চল থেকে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র নামে অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর নামকরণ হয় ‘বাংলাদেশ বেতার’। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে উত্তরাঞ্চলের পাকশীর রূপপুর বাজারে প্রতিদিন সন্ধ্যায় একজন চা দোকানী রেডিও সেট চালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের খবর শোনাতেন। বিশ্ব বেতার দিবসে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধকে বিজয়ের দিকে এগিয়ে নিতে রেডিও ছিল শক্তিশালী মাধ্যম। দেশে বাংলাদেশ বেতারের ঢাকা কেন্দ্রের কয়েকটি শাখা এবং আঞ্চলিক কেন্দ্র রয়েছে ১৩টি। শেরেবাংলা নগরে জাতীয় বেতার ভবনে ঢাকা ক, খ, গ নামের তিনটি চ্যানেলে অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে। এরমধ্যে ঢাকা চট্টগ্রাম রাজশাহী খুলনা রংপুর ও সিলেটে বেতারের এফএম ব্যান্ড চালু আছে। প্রাইভেট এফএম ব্যান্ডের রেডিও চালু আছে অন্তত ৩২টি। এর বাইরে স্বল্প ফ্রিকোয়েন্সির কমিউনিটি রেডিও চালু আছে ১৮টি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় দেশের কমিউনিটি রেডিওগুলো বড় ভূমিকা পালন করছে। কমিউনিটি রেডিওর প্রচার সীমিত এলাকার মধ্যে হওয়ায় বর্তমানে সরকারের অনুমতি নিয়ে নিজস্ব ওয়েবসাইটে ধারণকৃত অনুষ্ঠান আপলোড করা হচ্ছে। ফলে বিশ্বের মানুষ দেশের উন্নয়নের কথা শুনতে পারছেন। বর্তমানে একটি কমিউনিটি রেডিও চারধারে ১৭ কিলোমিটারের আকাশসীমার মধ্যে অনুষ্ঠান প্রচার করতে পারে। বর্তমানে মোটরগাড়িতে রেডিও, নেটে অনুষ্ঠানের আলাদা ডিভাইস ও বক্স আছে। বেতার আবিষ্কারক ইতালির বিজ্ঞানী জুগলিমো মার্কনি ১৮৯৫ সালে রেডিও আবিষ্কার করেন। পৃথিবীতে আসে রেডিও ওয়েভ (বেতার তরঙ্গ)। প্রযুক্তির এগিয়ে চলার পথ। শব্দের এই রেডিও ওয়েভ থেকে আবিষ্কার হতে থাকে নতুন পৃথিবীর কোটি কোটি পথের বহুমাত্রিক প্রযুক্তি। মাইক্রোওয়েভ লিঙ্কও এখন অনেক এগিয়েছে। শব্দ তরঙ্গ থেকে অনু তরঙ্গের কিলোবাইট, মেগাবাইট, গিগা বাইট, মাইক্রো গিগাবাইট পৃথিবীকে অনেক দূরের পথে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রেডিওর আরও কথা ॥ রেডিও বিজ্ঞানী রেজিনাল্ড ফেনডেন রেডিও সম্প্রচার শুরু করেন ১৯০৬ সালের ডিসেম্বরে। ১৯১৮ সালে লি দ্য ফরেস্ট নিউইয়র্কে হাইব্রিজ অঞ্চলে বিশ্বের প্রথম রেডিও স্টেশন নির্মাণ করেন। ১৯৩৬ সালে ভারতে অফিসিয়াল ইম্পেরিয়াল রেডিও শুরু হয়েছিল। পরে তা অল ইন্ডিয়া রেডিও নামে চালু হয়। ১৯৩৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় চালু হয় ‘ঢাকা ধ্বনি বিস্তার কেন্দ্র’ (রেডিও ট্রান্সমিশন ঢাকা)। বিশ্ব বেতার দিবসে ঢাকার এই ধ্বনি বিস্তার কেন্দ্র ইথারে পৌঁছে গেছে দেশে দেশে।
×