ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৭ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

বুলেট ট্রেন প্রকল্প স্থগিত ॥ অপচয় ১১০ কোটি টাকা

প্রকাশিত: ২৩:২৯, ১১ জানুয়ারি ২০২২

বুলেট ট্রেন প্রকল্প স্থগিত ॥ অপচয় ১১০ কোটি টাকা

নয়ন চক্রবর্ত্তী, চট্টগ্রাম অফিস ॥ বাংলাদেশে বুলেট ট্রেন প্রয়োজন কিনা, তা নিয়ে শুরু থেকেই আলোচনা ছিল। বুলেট ট্রেন উচ্চগতির, যার পুরোটাই চলাচল হবে প্রায় উড়ালপথে এবং বিদ্যুতে। ইলেক্ট্রিক ট্র্যাকশনের মাধ্যমে হাইস্পিড রেলওয়ে পরিচালনার যুগে প্রবেশে করার কথা ছিল, যা সেকেন্ড স্টেজ। অথচ বাংলাদেশের ট্রেন চলাচল এখনও ফার্স্ট স্টেজেই পৌঁছাতে পারেনি । সঙ্গত কারণেই ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে ৫৫ মিনিটে বুলেট ট্রেন চালানোর যে স্বপ্ন রেল কর্তৃপক্ষ দেশবাসীকে দেখিয়েছিল, তা অধরাই থেকে গেছে। এ প্রকল্প স্থগিত হওয়ার নেপথ্য অনুসন্ধানে জানা যায়, সম্ভাব্যতা যাচাই ও নক্সা প্রণয়নের পর প্রকল্প থেকে সরে গেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। অথচ বুলেট ট্রেনের সমীক্ষার বিপরীতে প্রায় ১১০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে কর্তৃপক্ষ। বাস্তবতা না বুঝে এই মেগা প্রকল্প কেন নেয়া হল এসব প্রশ্নের কোন উত্তর মিলছে না। মুখে কুলুপ এঁটেছেন উর্ধতন কর্মকর্তারা। তবে অপরিকল্পিতভাবে কাজটি শুরু না হওয়ায় এক ধরনের স্বস্তিও এসেছে। রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন সম্প্রতি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জানিয়েছেন, আগে সিঙ্গেল লাইনগুলোকে ডাবল লাইন করা হচ্ছে। তবে বুলেট ট্রেনের প্রকল্প বাতিল করা হয়নি। ভবিষ্যতে যাতে প্রকল্প বাস্তবায়নে সমস্যা না হয় সেজন্য কাজ এগিয়ে রাখা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে পূর্বাঞ্চল রেলের বর্তমান শীর্ষ তিনজন কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে অনাগ্রহ প্রকাশ করেছেন। এরপর সাবেক দুই কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা জানিয়েছেন, বিষয়টি যেভাবে বলা হচ্ছে তা সঠিক নয়। এর পেছনে রয়েছে রাষ্ট্রীয় অর্থের অপচয়। এখন সকলে জানছে এটি হবে না কিংবা এটা সম্ভব নয়। কিন্তু বুলেট ট্রেন যে বিদ্যুতের মাধ্যমে চালিত হবে, এই বিষয়ে অনেকে জানে না। বাংলাদেশে বর্তমান রেলের অবকাঠামোতে বুলেট ট্রেন যে বাস্তবিক নয়, এমনটা খোদ রেলের প্রকৌশলীরা বারংবার বলেছিল ২০১৭ সালে। তবে বেশ কয়েক শীর্ষ কর্মকর্তার কারণেই তখন প্রকল্পটি নিয়ে বেশ তোড়জোড় শুরু হয়। ওই শীর্ষ কর্মকর্তারাই প্রকল্পটি অনেকটা চাপিয়ে দেয় মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রাথমিক অনুমোদনের জন্য, যার সম্ভাব্যতা যাচাই আর নক্সা প্রণয়নে শত কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। অনেকের অভিযোগ, এই ব্যয় যাতে হয় এমনই চেয়েছিলেন কিছু কর্মকর্তা। নাম গোপন রাখার শর্তে সাবেক কর্মকর্তারা বলেন, পাথরবিহীন রেলট্র্যাক এখনও বাংলাদেশে হয়নি। তাহলে কীভাবে বুলেট ট্রেন চলবে? আমাদের রেলপথের সংস্কার এখনও অনেক বাকি। এসবকে পাশ কাটিয়ে অর্থছাড় করে সমীক্ষা হয়েছে। কিন্তু আদৌ যে বুলেট ট্রেন সম্ভব না, এটি তো রেলের বর্তমান গতি দেখলে বুঝা যায়। এখনও ঢাকা- চট্টগ্রাম রেলপথে ট্রেন চলে সর্বোচ্চ ৪০ থেকে ৫০ কিলোমিটার গতিতে। ট্র্যাক ও রেলপথ সংস্কার না হওয়ায় এখনও যেসব নতুন ইঞ্জিন যুক্ত হয়েছে, সেগুলো সম্পূর্ণ গতিতে চলতে পারছে না । সেখানে বুলেট ট্রেন প্রকল্পের স্বপ্ন যারা দেখিয়েছে তারা মূলত একটি চক্র। যে চক্রটি রেলকে শেষ করে দিতে সবসময় সোচ্চার থাকে। কঠিন হলেও সত্য, এখনও দেশের রেলপথের যে সমস্যা তা দেখেই মূলত দাতা সংস্থাগুলো ঋণ দিতে রাজি হয়নি। কেননা তারা বলেছে রেলের অবকাঠামোর উন্নয়ন আগে হোক। তারপর বাস্তব চিত্র দেখে বুলেট ট্রেন আদৌ চলাচল করতে পারবে কিনা তা দেখে অর্থ দেয়ার বিষয়টি বিবেচনায় আসবে। পূর্বাঞ্চলীয় রেল ও মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে বুলেট ট্রেন প্রকল্প নেয়া হয়। নক্সা ও সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে খরচ করা হয় ১১৩ কোটি টাকা। রেল কর্তৃপক্ষ জানায়, ৫৫ মিনিটে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছানোর জন্য ৩৫০ কিলোমিটার উড়ালপথে বুলেট ট্রেন চলার কথা ছিল। শুধু তাই নয়, ট্র্যাকে থাকবে না কোন পাথর। মোট পাঁচটি দৃষ্টিনন্দন স্টেশনের মাধ্যমে বুলেট ট্রেনে যাত্রী ওঠানামা করবে। সেই স্টেশনগুলো হলো ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী ও চট্টগ্রাম। এসব বিষয়ে একাধিকবার বৈঠকও হয়। ২০২০ সালের এক বৈঠকে বুলেট ট্রেন কক্সবাজার পর্যন্ত যাওয়ার পরিকল্পনাও তারা নিয়ে নেন। অথচ সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে যে পরিকল্পনার যবনিকাপাত ঘটবে, তা অধিকাংশই জানতেন। গত বছরের জানুয়ারিতে খোদ রেলমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বৈঠকে বুলেট ট্রেনের নক্সা প্রণয়নের সঙ্গে জড়িত চীনা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা এবং রেল কর্তৃপক্ষের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা ছিলেন। তখনই কিন্তু জানানো হয়, ১ ঘণ্টা ১৫ মিনিটে বুলেট ট্রেন রাজধানী ঢাকা থেকে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে পৌঁছাতে সময় লাগবে। এসব করতে ব্যয়ের পরিমাণ ধরা হয়েছিল প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা। রেলের প্রকৌশলীরা বলছেন, বাংলাদেশের ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে, কাজটি শুরু হয়নি। অপরিকল্পিতভাবে যদি এটির কাজ শুরু হতো, তাহলে জমি অধিগ্রহণ নিয়ে ব্যাপক অস্থিতিশীল অবস্থা এবং অনিয়ম দুর্নীতির আখড়া হিসেবে দাঁড়াত এই প্রকল্প। যে ১ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের কথা উঠেছে তা মূলত দেড়গুণ বেড়ে যেত কয়েক মাসের মধ্যে। এটা যে দ্রতগতিতে চলবে সেই চলা যে বিদ্যুতের, এটির উপযোগী এখনও বাংলাদেশের রেলপথ না। তাই ভাল হয়েছে এটি যে সমীক্ষা করেই আপাতত ক্লোজ করেছে।
×