ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

বিষয়টি কেন্দ্র পর্যন্ত গড়িয়েছে

চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের কোন্দল ফের প্রকাশ্যে

প্রকাশিত: ২৩:৩৭, ৯ জানুয়ারি ২০২২

চট্টগ্রাম নগর আওয়ামী লীগের কোন্দল ফের প্রকাশ্যে

নয়ন চক্রবর্ত্তী, চট্টগ্রাম অফিস ॥ তৃণমূল সম্মেলনকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগে পুরনো বিরোধ আবার দৃশ্যমান হয়েছে। নগরীর সকল সাংগঠনিক ওয়ার্ডের কয়েকটি ছাড়া বেশিরভাগ ওয়ার্ডে সম্মেলন শেষ হয়েছে। পরিপূর্ণ সম্মেলন শেষ করার আগেই কেন্দ্রে নালিশ দেয়ায় দুপক্ষের মীমাংসার দায়িত্ব নেয় আওয়ামী লীগ। এসব দ্বন্দ্বের কারণে প্রকাশ্যে এসেছে গ্রুপিং। তবে নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের একপেশে মনোভাব গঠনতন্ত্রবহির্ভূত সিদ্ধান্তের অভিযোগ তুলেছেন অপরপক্ষের আওয়ামী লীগ নেতারা। তবে তারা দাবি করেছেন, মূলত সঠিক নিয়মনীতির ব্যত্যয় হওয়ায় আমরা কেন্দ্রে বিষয়টি তুলে ধরেছি এর বাইরে কোন নেতাকে বা কোন পক্ষকে আটকানোর জন্য বিষয়টি নালিশ দেয়া হয়েছে তেমন নয়। এদিকে ৮ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে কার্যনির্বাহী কমিটির সভা হওয়ার কথা থাকলেও তা হচ্ছে না চট্টগ্রামে। তবে বিরোধ নিরসনের বৈঠক আগামী ১৬ জানুয়ারি হবে বলে জানা গেছে। প্রসঙ্গত, নগর আওয়ামী লীগের বর্তমানে দুটি গ্রুপ প্রকাশ্যে রয়েছে। এর মধ্যে সাবেক সভাপতি প্রয়াত মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীদের নেতৃত্ব দেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। অপরদিকে দলের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক মেয়র আজম নাছির উদ্দীন অপরপক্ষটির নেতৃত্বে রয়েছেন। এর মধ্যে গত ২২ ডিসেম্বর নগর কমিটির মহিবুল হাসান নওফেলপন্থী পরিচিত নেতারা ঢাকায় গিয়ে সম্মেলনের বিষয়ে নানা অভিযোগ তুলেন। যার প্রেক্ষিতে ওয়ার্ড সম্মেলন বন্ধ রাখার ঘোষণা আসে। সিদ্ধান্ত হয় ৮ জানুয়ারি নগর কমিটির কার্যনির্বাহী সভায় এ সংক্রান্ত মীমাংসা হবে। তারপর সম্মেলন শুরুর তারিখ ঘোষণা করা হবে। কিন্তু তা না হওয়ায় বিষয়টি আদৌ কোন পর্যায়ে যাচ্ছে তা নিয়ে টক অব দ্য টাউন। বর্তমান নগর কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের পক্ষে রয়েছে। অপরদিকে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের পক্ষে রয়েছে নগর কমিটির শীর্ষ নেতারা। যারা চট্টগ্রাম নগরীর গুরুত্বপূর্ণ পদেও আছেন। কেন্দ্রীয় প্রতিনিধি দলের উপস্থিতিতে অক্টোবরে সদস্য সংগ্রহ প্রক্রিয়া নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন স্থানীয় কয়েকজন নেতা। এরপর এসব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে তারা কিছু নির্দেশনাও দেন। তবে গত ১৪ নবেম্বর কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় সদস্য বাছাই ও তৃণমূলের সম্মেলন আয়োজন নগর কমিটির সিনিয়র নেতাদের তত্ত্বাবধানে হওয়ার প্রস্তাব ওঠে। আলোচনা ছাড়া ইউনিট সম্মেলনের তারিখ নির্ধারণ নিয়েও ভিন্নমত দেন নগরের সহ-সভাপতি ও সাবেক সিটি প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন। তবে এসব বিষয়কে পাত্তা না দিয়ে কেন্দ্রীয় নির্দেশনার বাধ্যবাধকতা আছে উল্লেখ করে পাঁচটি ওয়ার্ডের ইউনিট সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করেন নগর সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির। এরপর ১৬ নবেম্বর শুরুর দিনই দেওয়ান বাজার ওয়ার্ডে ক ইউনিটের সম্মেলন বিক্ষোভের মুখে স্থগিত করা হয়। সেখানে মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীদের সদস্য ফরম না দেয়া এবং সম্মেলনে তাদের আমন্ত্রণ না জানানোর অভিযোগ তুলেন নেতাকর্মীরা। এরপর পরদিন গ ইউনিটের সম্মেলনেও তারা বিক্ষোভ করেন। এদিকে চট্টগ্রামে ৪৩টি সাংগঠনিক ওয়ার্ডের ১২৯টি ইউনিটের কয়েকটি ছাড়া প্রায় সব ইউনিটে সম্মেলন শেষ করা হয়েছে। মূলত এসব ইউনিট কমিটিতে নগর কমিটির সভাপতি ও সাধারণ গঠনতন্ত্রবহির্ভূত এবং একপেশে সিদ্ধান্ত নিয়ে সম্মেলন করেছে অভিযোগ তুলেন নেতারা। তাদের অভিযোগ, সদস্যপদ নবায়ন না করে, যাচাই-বাছাই ছাড়াই পছন্দের লোক বসিয়ে নামমাত্র সম্মেলন করা হয়েছে। এসব অভিযোগের বিষয়ে যোগাযোগের চেষ্টা করেও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিনের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে তার অনুসারী কমিটির এক নেতা জানান, স্বচ্ছতার সঙ্গে ইউনিট সম্মেলন হয়েছে। এসব মূলত ষড়যন্ত্র। মিথ্যা অভিযোগ তুলে স্থগিত করেছে ইউনিট সম্মেলন। এসবের পেছনে রয়েছে পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র। দলে মতপার্থক্য থাকতে পারে কিন্তু যেখানে ঢাকায় গিয়ে নালিশ দিয়েছে তা নগর আওয়ামী লীগের জন্য সম্মানহানি হয়েছে। নগর কমিটির এই শীর্ষ নেতা জানান, লোকজন দিয়ে যে ফরম পূরণের কথা উঠছে তারা তো আওয়ামী লীগ করে। ত্যাগী নেতারাই নেতৃত্বে আসছে এটা অনেকে মেনে নিতে পারেনি। উল্লেখ্য, নগর আওয়ামী লীগে দুপক্ষের বিরোধ আরও জোরালো হয়ে ওঠে ২৮ ডিসেম্বর রাতে। নগরীর ফিরিঙ্গি বাজার এলাকার দোভাষ বাড়িতে চউক চেয়ারম্যান জহিরুল আলম দোভাষ, সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন, ইব্রাহিম হোসেন চৌধুরী বাবুল, মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এবং পতেঙ্গা আসনের এমপি লতিফ এক বৈঠকে বসেন। যদিও সেই বৈঠক নিয়ে তারা মুখ না খুললেও আজম নাছির অনুসারীদের অভিযোগ আ জ ম নাছির উদ্দিনকে কোণঠাসা করতে তারা একাট্টা হয়েছে। তবে আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, ইউনিট পর্যায়ে স্বচ্ছতা থাকলে তা নগর আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনে স্বচ্ছতা আসবে। বড় দলটি যাতে কোন বিতর্কে না পড়ে এজন্যই কেন্দ্রে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে নগর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি সিটি কর্পোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা মূলত ইউনিট পর্যায়ে যেসব অনিয়ম হচ্ছে তা তুলে ধরেছি। যে প্রক্রিয়ায় সম্মেলন হওয়ার কথা যে নিয়মে হওয়ার কথা তা হচ্ছে না। সংগঠনের নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে যা হয়েছে সে বিষয়ে কেন্দ্র অবহিত করা হয়েছে। মূলত এর বাইরে আর কিছুই নয়। আজম নাছির উদ্দিনকে কোণঠাসা করতে আপনার এক হয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে সুজন বলেন, এটি সত্যি নয়। উনাকে সাধারণ সম্পাদক করেছেন আমাদের জননেত্রী। সুতরাং কোনকিছুর পরিবর্তন করলে তিনি সিদ্ধান্ত দিবেন। উনাকে সরানো কোন অভিপ্রায় নেই আমাদের। সকল কিছুই নেত্রীর ওপর নির্ভর। আমরা চাই সংগঠনে নিয়মনীতি যাতে ব্যত্যয় না ঘটে। তিনি আরও বলেন, দলে যা সিদ্ধান্ত হয়, সেই অনুযায়ী কর্মকা- হলে বিরোধের কিছু হতো না। সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুসারে সকল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হলে তো কেন্দ্রে অভিযোগ দিতে হতো না। এখানে আমাদের ব্যক্তিগত কোন বিষয়কে প্রাধান্য দিইনি, দলের তৃণমূলের বিষয়গুলো কেন্দ্রকে জানানো হয়েছে। আগামী ১৬ জানুয়ারি বৈঠক হবে। ওই বৈঠকে পরবর্তী সিদ্ধান্ত হবে। এদিকে সম্মেলন করার জন্য ওয়ার্কিং কমিটি যেভাবে সিদ্ধান্ত দিয়েছে ঠিক সেভাবে ইউনিট সম্মেলন হচ্ছে না। যার ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও চলছে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ। এছাড়া এলাকায় এলাকায় বিরোধ এখন তুঙ্গে। নগর আওয়ামী লীগের যেসব ইউনিট সম্মেলন হয়েছে সেখানে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পছন্দের লোকের আধিক্য রয়েছে অভিযোগ তৃণমূল নেতাকর্মীদের। তারা বলছেন, ন্যূনতম চাঁদা না দিয়ে সদস্যপদ নবায়ন না করে বেশিরভাগকে দলের সদস্য করে গ্রুপিং জিইয়ে রাখতে নীলনক্সা প্রণয়ন করেছে সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন। তবে নাছির অনুসারীরা বলছেন, মূলত মহিউদ্দিন অনুসারীরা চান নওফেলপন্থী সকলেই যেন কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদ পান এজন্যই বিষয়গুলো মানতে পারছে না তারা। নাছির অনুসারীদের ভাষ্য, ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইউনিট সম্মেলন হয়েছে। এসবের দায়িত্বে নগর কমিটির বিভিন্ন নেতারা ছিল। কারও ব্যক্তিগত ইচ্ছের প্রতিফলন ছিল না। এদিকে নগর আওয়ামী লীগে একসময়ে একাধিক ধারার গ্রুপিং থাকলেও বর্তমানে প্রয়াত সভাপতি এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর অনুসারীদের পাল্লা ভারি। তাদের সঙ্গে বর্তমান মেয়র রেজাউল করিম, সাবেক চউক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, এমপি লতিফ এমনকি সাবেক মন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসিও মহিউদ্দিন চৌধুরী বলয়ে এখন। এ ধারাটির বর্তমান নেতৃত্ব দিচ্ছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী।
×