অনলাইন ডেস্ক ॥ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাকে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগে বিশ্বের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে মনে করা হচ্ছে ।এর প্রধান কারণ শহরটির ঘনবসতি। তবে ভূমিকম্পের শহরটির ঝুঁকি কমাতে এ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকল্প ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলা হয়। কিন্ত বাস্তবতা হয়েছে পরিকল্পনার বেশিরভাগই আলোর মুখ দেখেনি।
আর্থ অবজারভেটরি সেন্টারের তথ্য মতে, ইন্ডিয়ান, ইউরেশিয়ান এবং বার্মা,এই তিনটি প্লেটের সংযোগস্থলে বাংলাদেশের অবস্থান।যা বড় ধরণের ভূমিকম্পের ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
প্রতিবারই বড় কোন ভূমিকম্প হওয়ার পরই ব্যাপক তৎপরতা দেখা যায়, যা ধামাচাপা পড়ে থাকে বড় ধরণের আরেকটি ভূমিকম্প আঘাত হানার আগ পর্যন্ত।
অল্প জায়গায় বহুতল ভবন :
রাজধানীর পুরানো ঢাকাকে বালা হচ্ছে সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ এলাক। কেননা এখানে সরু অলিগলির দুই পাশে গেলে দেখা যাবে এখনও গায়ে গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রয়েছে অসংখ্য ভবন। সর্বোচ্চ তিন তলা গাঁথুনির ভীত যে ভবনটির, সেখানে নির্দ্বিধায় তোলা হচ্ছে ৫ তলা/ ৬ তলা।
জগন্নাথ পাড়া এলাকায় শুক্রবার ভোররাতের ভূমিকম্পে একটি পাঁচ তলা বাড়িতে কেঁপে উঠে। সেখানে বাস করে এক পরিবারের অন্তত ১৫ জন সদস্য।
ভূমিকম্পের পর আতঙ্কিত মানুষদের ভবনের নীচে রাস্তায় ঠাঁই নেয়ার জায়গাটুকু নেই। পুরানো ঢাকার বাসিন্দারা তাই ভূমিকম্পের সময় আতঙ্কে থাকেন। এতো অল্প জায়গায় এমন বহুতল ভবন ভূমিকম্প বা অন্য যেকোনো দুর্যোগের ক্ষেত্রে ভয়াবহ ঝুঁকিপূর্ণ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
পরিকল্পনার বাস্তবায়ন নেই :
সাধারণত প্রতি ১০০ বছর পর বড় ধরনের ভূমিকম্প হয়ে থাকে এমন তথ্য দিয়েছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আক্তার ।
সবশেষ ১৮২২ এবং ১৯১৮ সালে মধুপুর ফল্টে বড় ভূমিকম্প হয়েছিল। সে হিসেবে আরেকটি বড় ভূমিকম্পের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে বাংলাদেশ। সবচেয়ে ঝুঁকিতে রয়েছে ঢাকা।
২০০৯ সালে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচি (সিডিএমপি) ও জাইকার যৌথ জরিপে জানা গেছে, ঢাকায় সাত বা তার বেশি মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলে, শহরের ৭২ হাজার ভবন ভেঙে পড়বে এবং এক লাখ ৩৫ হাজার ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তৈরি হবে সাত কোটি টন কনক্রিটের স্তূপ।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স সূত্রে জানা গিয়েছে, ঢাকা শহরের ৭৬ শতাংশ রাস্তা সরু হওয়ায় ভূমিকম্প হলে উদ্ধার তৎপরতা চালানো কঠিন হয়ে যাবে।
এছাড়া ৬০ শতাংশ ভবন মূল নকশা পরিবর্তন করে গড়ে ওঠায় বড় ধরণের ভূমিকম্পের সময় এই অপরিকল্পিত ভবনগুলো সঙ্গে সঙ্গে ধসে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
সেই সঙ্গে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির লাইনে বিস্ফোরণ ঘটে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।
ভূমিকম্প অসহনশীল ভবন :
ভূমিকম্প অসহনশীল ভবনগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সংস্কার বা ধ্বংস করার পরিকল্পনা করা হলেও তার বাস্তবায়ন হয়নি।
এছাড়া ২০১৫ সালে নেপালে উচ্চমাত্রার ভূমিকম্পের প্রভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছিলো। সে সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাউন্সিলের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিলো 'ন্যাশনাল ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার' প্রতিষ্ঠার। সিদ্ধান্তটিও এখনও পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
আলোর মুখ দেখেনি ওই বৈঠকে ন্যাশনাল ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এনডিএমআইএস) নামে একটি ওয়েবসাইট তৈরির সিদ্ধান্তটি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, সবচেয়ে বড় দুর্বলতার জায়গা হল বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ভবন নির্মাণ না করা এবং সেগুলো মনিটর করে কোন ব্যবস্থা না নেয়া।
ঢাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে, তারসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ভূমিকম্পে দুর্যোগের ঝুঁকি এই তথ্য জানান পুরোকৌশলবিদ মেহেদী আহমেদ আনসারি ।
তিনি ঢাকার ঘিঞ্জি এবং অভিজাত এলাকার বহুতল ভবন পরীক্ষা নিরীক্ষা করে দেখেছেন বেশিরভাগই উচ্চমাত্রার ভূমিকম্প সহনশীল নয়। কারণ এগুলো বিল্ডিং কোড অনুসারে তৈরি করা হয়নি।
এ ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো গুড়িয়ে ফেলা কিংবা ভূমিকম্প সহনশীল করে সংস্কার করা প্রয়োজন হলেও তার কোন ক্ষেত্রেই অগ্রগতি হয়নি বলে তিনি অভিযোগ করেন।
অগ্রগতি সামান্য :
এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকম্পের প্রস্তুতি বলতে কয়েকটি কাজ হয়েছে। যমন, সরকারী অর্থায়নে অন্তত একশ কোটি টাকা খরচ করে ফায়ার সার্ভিসের জন্য নানা উপকরণ কেনা।
সেই সঙ্গে রাজউকের অধীনে আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্প চালু করা, যারা ভবনের ভূমিকম্প সহনশীলতার বিষয়টি নজরদারি করে এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়।
সেই প্রকল্প হাতেগোনা কয়েকটি সরকারী গুরুত্বপূর্ণ দফতর, স্কুল ও হাসপাতালের ভূমিকম্প সহনশীলতা পরীক্ষা নিরীক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের সাবেক মহাপরিচালক আলী আহমদ খান বলেন, "আমাদের দেশে কোড মেনে বিল্ডিং করা হয় না। এটা কারা নজরদারি করবে সেখানেও সমন্বয়হীনতা রয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের তৎপর হওয়া খুব প্রয়োজন"
অপর দিকে রাজউকের নগর পরিকল্পনাবিদ মাহফুজা আক্তার বলছেন, কোন ভবন ভূমিকম্প সহনশীল কিনা সেটা খতিয়ে দেখার কোন সক্ষমতা তাদের নেই।
সূত্র : বিবিসি বাংলা (সানজানা চৌধুরী)