শরীফুল ইসলাম ॥ বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট এখন অকার্যকর। অনেক দিন হলো এ জোটের কোন কার্যক্রম নেই। এককভাবে বিএনপিসহ ক’টি দল ছাড়া জোটের অন্য দলগুলো কোন কর্মসূচীই পালন করছে না। অধিকাংশ দলই রাজনৈতিক অঙ্গনে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে যে কোন সময় এ জোটের কার্যক্রম বিলুপ্ত হয়ে যেতে পারে বলে অভিজ্ঞ মহলের আশঙ্কা রয়েছে।
এদিকে দীর্ঘদিন ধরে ২০ দলীয় জোটের রাজনীতি অকার্যকর রাখায় বিএনপির প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ইতোমধ্যেই বেশ ক’টি রাজনৈতিক জোট ছেড়ে চলে গেছে। সর্বশেষ এ মাসের প্রথমভাগে বিএনপির সঙ্গ ছেড়েছে ২০ দলীয় জোটের শরিক দল খেলাফত মজলিস। এর আগেও ক’টি দল এ জোট ছেড়েছে। এর মধ্যে কোন কোন দল সরকারী দল আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দিয়েছে। আবার কোন কোন দল পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছে পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কোন্ দিকে যাবে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২০ দলীয় জোটকে উপেক্ষা করে গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে বিএনপি। এ জোটের অধীনে হাঁকডাক করে নির্বাচন করে ৩০০ আসনের মধ্যে মাত্র ৬টি আসনে বিজয়ী হয় বিএনপি। নির্বাচনে শোচনীয় পরাজয়ের পর নিজের দল ও ২০ দলীয় জোটকে রাজনীতিতে সক্রিয় না করে বিএনপি ভিন্ন পথে চলা শুরু করে। এক পর্যায়ে দলীয় কর্মসূচী জোরদারের চেয়ে সরকারের সঙ্গে সমঝোতা করে খালেদা জিয়াকে সাময়িকভাবে মুক্ত করতে বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে ২০ দলীয় জোটের একটি শরিক দলের চেয়ারম্যান জানান, বিএনপির রাজনীতি এখন কোন্ পথে তা আমরা বুঝতে পারছি না। এ দলটি না পারছে রাজপথে আন্দোলন করতে, না পারছে নির্বাচনের জন্য ভালভাবে প্রস্তুতি নিতে। এমনকি নিজের দলটিকেও ঢেলে সাজাতে পারছে না। আবার জোটের শরিক দলগুলোকেও মূল্যায়ন করতে পারছে না। এর ফলে ২০ দলীয় জোট এখন কার্যত অকার্যকর।
সর্বশেষ খেলাফত মজলিস ২০ দলীয় জোট ছাড়ার আগে সংবাদ সম্মেলন করে এর কারণ জানিয়েছে। দলটির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর হোসেন লিখিত বক্তব্যে জানান, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট রাজনৈতিকভাবে অকার্যকর। তাই আমরা এ জোট ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। অবশ্য আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই দলটির চেয়ারম্য্যান মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাকের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম মজলিসে শূরার বৈঠকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোট ছাড়ার সিদ্ধান্ত হয়। বৈঠকে ২ শতাশিক সদস্য উপস্থিতি ছিলেন। অধিকাংশ নেতা ২০ দলীয় জোট ছাড়ার পক্ষে মত দেন। আর এ সিদ্ধান্ত জনসম্মুখে প্রকাশ করতে সংবাদ সম্মেলন করা হয়।
খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব জাহাঙ্গীর হোসাইন জানান, দীর্ঘ ২২ বছর খেলাফত মজলিস ২০ দলীয় জোটে সক্রিয় ছিল। কিন্তু ২০১৯ সাল থেকে এ জোটের দৃশ্যমান কোন রাজনৈতিক তৎপরতা নেই। ২০১৮ সালে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনের মধ্য দিয়ে ২০ দলীয় জোটকে কার্যত অকার্যকর করা হয়। এমতাবস্থায় আদর্শিক, সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় দলের মজলিসে শূরার অধিবেশনে সিদ্ধান্ত হয় খেলাফত মজলিস একটি আদর্শিক সংগঠন হিসেবে স্বকীয়-স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্য নিয়ে ময়দানে ভূমিকা রাখবে এবং ২০ দলীয় জোটসহ সকল রাজনৈতিক জোটের সঙ্গ ত্যাগ করেছে।
এবছর সেপ্টেম্বর মাস থেকে ভবিষ্যত কর্মপন্থা ঠিক করতে দলের বিভিন্ন স্তরের নেতা ও সমমনা পেশাজীবী সংগঠনগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে মতবিনিময় করে বিএনপি হাইকমান্ড। এ সময় দলের অধিকাংশ নেতা ও পেশাজীবীদের একটি অংশ বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ করে নতুন উদ্যমে একক রাজনৈতিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। এ ছাড়া কিছু নেতা ও পেশাজীবী যুগপৎভাবে সমমনা দলগুলোর সঙ্গে রাজপথের আন্দোলনসহ বিভিন্ন ইস্যুতে কর্মসূচী পালনের প্রস্তাব দেন। আবার কেউ কেউ ডান, বাম ও মধ্যপন্থী দলগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গঠনের প্রস্তাব দেন।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, সর্বস্তরে দল গুছানোর কাজ এগিয়ে চলছে। এর পর সমমনা দলগুলোকে নিয়ে রাজপথে আন্দোলন কর্মসূচী পালনের প্রস্তুতি রয়েছে। যারা গণতন্ত্র ও ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে এমন রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে এক সঙ্গে বা যুগপৎ আন্দোলন হতে পারে। আর ২০ দলীয় জোট বা অন্য জোটের ভবিষ্যত কি হবে তা সময়ই বলে দেবে।
উল্লেখ্য, ১৯৯৯ সালের ৬ জানুয়ারি বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত ও ইসলামী ঐক্যজোট নিয়ে চারদলীয় জোট গঠন করা হয়। পরে এইচএম এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি এ জোট থেকে বেরিয়ে গেলে নাজিউর রহমান মঞ্জুর নেতৃত্বে গঠিত নতুন দল বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি) চারদলীয় জোটে সংযুক্ত হয়। চারদলীয় জোট ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে এবং বিজয়ের পর সরকার গঠন করে। চারদলীয় জোটের শরিক দল ইসলামী ঐক্যজোটে ছিল ছোট ছোট ৫টি ইসলামী দল। এক পর্যায়ে ইসলামী ঐক্যজোটের অন্যতম নেতা শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস চারদলীয় জোট ছেড়ে গেলে এর একাংশ থেকে যায় এবং তারা খেলাফত মজলিস নামে নতুন দল গঠন করে নিবন্ধন নেয়।
২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল চারদলীয় জোটের সঙ্গে নতুন ১২টি দলের সংযুক্তির মাধ্যমে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন জোরদার করতে বিএনপির নেতৃত্বে গঠন করা হয় ১৮দলীয় জোট। এর পর আরও ২টি রাজনৈতিক দল যোগদানের মাধ্যমে এ জোটের পরিধি বেড়ে দাঁড়ায় ২০ দলে। তবে পরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ২০-দলীয় জোট থেকে ইসলামী ঐক্যজোট, এনপিপি, ন্যাপ ও এনডিপি বেরিয়ে সরকারী দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের সঙ্গে যোগ দিলেও একই নামে এসব দলের একাংশ থেকে যায় ২০ দলীয় জোটে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর এক পর্যায়ে কর্নেল (অব.) অলি আহমেদের নেতৃত্বাধীন এলডিপিও ২০ দলীয় জোট থেকে দূরত্ব বজায় রেখে পৃথক রাজনৈতিক মঞ্চ গঠন করে। এর নাম জাতীয় মুক্তি মঞ্চ। এ মঞ্চ গঠনের পর নতুন করে ক’জন নেতাকে দিয়ে একই নামে নতুন এলডিপি গঠন করে জোটে রাখে বিএনপি। এ ছাড়া ২০ দলীয় জোট ছেড়ে যায় প্রয়াত নাজিউর রহমান মঞ্জুর ছেলে ব্যারিস্টার আন্দালিব রহমান পার্থের দল বিজেপিও। জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম নামের রাজনৈতিক দলও এ বছর ১৪ জুলাই ২০ দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে গেলে একই নামে আরেকটি অংশ রয়েছে এ জোটে। এভাবে ডামি দল বানিয়ে জোটে ২০ দলের সংখ্যা ঠিক রাখা হলেও এটি এখন অকার্যকর জোটে পরিণত হয়েছে।
বর্তমানে ২০ দলীয় জোটে থাকা শরিক দলগুলো হচ্ছে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী ঐক্যজোট, খেলাফত মজলিস (একাংশ), জাতীয় পার্টি (কাজী জাফর), লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) একাংশ, কল্যাণ পার্টি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনপিপি), জাতীয় গণতান্ত্রিক পার্টি (জাগপা), লেবার পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ ভাসানী), বাংলাদেশ ন্যাপ, ইসলামিক পার্টি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এনডিপি), মুসলিম লীগ, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, সাম্যবাদী দল, ডেমোক্রেটিক লীগ(ডিএল) ও জাতীয় দল।
সূত্র মতে, ২০ দলীয় জোটের নেতৃত্বে থাকা দল বিএনপির কার্যকলাপে হতাশ হয়েই জোট ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেয় খেলাফত মজলিসসহ বিভিন্ন দল। তাদের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে জোট নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে বিএনপির কারণে। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর সংসদ নির্বাচনের পূর্বাপর রাজনৈতিক কর্মপন্থা নির্ধারণে ২০ দলের শরিকরা গুরুত্ব হারায়। তাছাড়া বিএনপির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতাদের সাম্প্রতিক কার্যক্রমে তাদের মনে হয়েছে, তারা জোটে থাকা দলগুলোর ব্যাপারে খুব একটা আগ্রহী নন।
এদিকে নির্বাচন কমিশন ২০ দলীয় জোটের শরিক দল জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করায় এ দলটি এখন রাজনেতিকভাবে বেকায়দায় আছে। এ ছাড়া এ দলের রাজনীতি নিয়ে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন মহলের কড়া নজরদারি রয়েছে। তাই এ দলের নেতাকর্মীরা এখন রাজনীতিতে নিষ্ক্রিয়। ২০ দলীয় জোট অকার্যকর হওয়ার এটিও একটি অন্যতম কারণে বলে অভিজ্ঞ মহল মনে করছেন।
এদিকে ২০ দলীয় জোটকে অকার্যকর করে রাখায় বিএনপির প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন এ জোটের শরিক দল এলডিপির (অলি) মহাসচিব রেদোয়ান আহমেদ। সম্প্রতি দলীয় এক অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, ২০ দলীয় জোটকে বসিয়ে রাখলে এলডিপি বিকল্প পথে সক্রিয় হবে। বিএনপির উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা একলা চলো নীতি অবলম্বন করছেন। তবে আমরাও কিন্তু বসে থাকব না। আমরাও রাজনীতি করি। আমরাও দীন-দুনিয়ার খবর রাখি। দেশ-বিদেশের রাজনীতি নিয়ে আমাদের ধারণা আছে। এ জোটের যে আন্দোলন করার কথা ছিল, বিএনপির যে উদ্যোগ নেয়ার কথা, তা নেয়া হয়নি। এ ছাড়া বিএনপি এলডিপি সভাপতি অলি আহমেদের পরামর্শ নিচ্ছে না।