
রহিম শেখ ॥ ডিজিটাল যুগে ইন্টারনেট এখন বেশ সহজলভ্য। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা এবং স্মার্টফোনের সহজপ্রাপ্যতার কারণে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যাও দিন দিন বাড়ছে। একই সঙ্গে প্রযুক্তির অপব্যবহারে বাড়ছে বিভিন্ন অপরাধ। তরুণ-তরুণীরা বিগো, লাইকি-টিকটকের অশ্লীল ভিডিওতে নাচ, গান ও অভিনয়ের পাশাপাশি নিজেদের ধূমপান ও সিসা গ্রহণ করার ভিডিও আপলোড করছেন। ‘ফ্রি ফায়ার ও পাবজি’ গেম কিশোর-কিশোরী ও তরুণদের মধ্যে ভয়ঙ্কর আসক্তি তৈরি করছে। এ নিয়ে গত ১৮ জুলাই ‘ডিজিটাল আসক্তি’ শিরোনামে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ শুরু করে দৈনিক জনকণ্ঠ। এরপর পাবজি-ফ্রি ফায়ার গেমসহ লাইকি, বিগোর মতো ভিডিও স্ট্রিমিং এ্যাপ বন্ধের দাবি উঠে বিভিন্ন মহলে। এরপর চলতি মাসের ১৬ আগস্ট উচ্চ আদালত ‘ক্ষতিকারক’ অনলাইন গেমের সব ধরনের লিংক বা ইন্টারনেট গেটওয়ে তিন মাসের জন্য বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষতিকর গেম বন্ধ করা সম্ভব। তবে ভিডিও স্ট্রিমিং এ্যাপ ব্যবহার রোধ করা কঠিন। কারণ অনেক ক্ষেত্রে বিকল্প পদ্ধতিতে সেগুলো ব্যবহার করা যায়। এজন্য প্রযুক্তির ফাঁকফোকরও বন্ধের পরামর্শ তাদের। একই সঙ্গে শিশু-কিশোরদের এসব আসক্তি থেকে ফেরাতে দ্রুততম সময়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিটিআরসির তথ্য মতে, দেশে এখন ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১১ কোটি ৬১ লাখ ৪০ হাজার। এর মধ্যে ব্রডব্যান্ড (আইএসপি ও পিএসটিএন) ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা মাত্র ৯৮ লাখ ১০ হাজার। অর্থাৎ ১০ কোটি ৬৩ লাখ ৩০ হাজার মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রয়েছে দেশের তরুণসমাজ ও কিশোর-কিশোরী। শিশু-কিশোররা অনলাইন ঘেঁটে শুধু শিক্ষামূলক কনটেন্টই দেখছে এমন নয়। সামাজিক প্রেক্ষাপটে যায় না এমন অনেক অনৈতিক কনটেন্টও খোঁজ করছে। নিজেদের জীবনেও তার প্রয়োগ করার চেষ্টা চালাচ্ছে। ফেসবুক, মেসেঞ্জার, হোয়াটসএ্যাপ, ভাইবার, ইমোর বিভিন্ন গ্রুপে পরিকল্পনা হয় গ্যাং কালচারের। বেসরকারী ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের এক গবেষণা বলছে, দেশে ২ কোটি ৬০ লাখ মানুষ বিভিন্ন ডিজিটাল গেম খেলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে দিনে দু-তিন ঘণ্টা গেম খেলে কাটানোর প্রবণতা রয়েছে। দেশে তরুণদের মধ্যে বেশি জনপ্রিয় ফ্রি ফায়ার, পাবজি, ক্লাস অব ক্ল্যানস, মাইন ক্র্যাফট, কাউন্টার স্ট্রাইক গ্লোবাল অফেন্স, কল অব ডিউটি ওয়ার জোনের মতো সহিংসতাপূর্ণ গেম। এসব গেমে অস্ত্রের ব্যবহার, মেরে ফেলা ও বোমাবাজি রয়েছে। সহিংসতাপূর্ণ গেম মানুষের ওপর কী ধরনের প্রভাব ফেলে তা নিয়ে আমেরিকান সাইকোলজিক্যাল এ্যাসোসিয়েশনের দুটি গবেষণায় দুধরনের ফলাফল দেখা যায়। একটিতে দেখা যায়, যাদের মধ্যে সহিংসতাপূর্ণ মনোভাব থাকে, তারা এসব গেম খেলে সহিংস আচরণ করতে পারে। আরেকটি গবেষণায় বলা হয়, এ ধরনের ভিডিও গেম সাময়িক সময়ের জন্য হলেও সহিংস আচরণ উসকে দিতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও অনলাইন গেম আসক্তিকে মানসিক সমস্যা হিসেবে গ্রহণ করেছে। করোনাকালে শিশু-কিশোর ও তরুণ-তরুণীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা অনলাইন গেম খেলে কাটানোর বিষয়টি নিয়ে অনেক অভিভাবক উদ্বিগ্ন। দীর্ঘক্ষণ ডিজিটাল ডিভাইসের পর্দার সামনে থাকলে শিশু-কিশোরদের চোখের নানা সমস্যা হতে পারে বলেও জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
এদিকে রাজধানীর পল্লবীর বাউনিয়াবাঁধে ভাড়ায় মিলছে ফ্রি ফায়ার গেমস খেলার মোবাইল। এজন্য যত্রতত্র গড়ে উঠেছে ভিডিও গেমসের দোকান। এ সব দোকানে ঘণ্টা হিসাবে মোবাইল ভাড়া দেয়া হয়। স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা মোবাইলে ফ্রি ফায়ার গেমসে ব্যস্ত থাকে। প্রতি ঘণ্টায় গেমসের মোবাইল ভাড়া দেয়া হচ্ছে ৮০-১০০ টাকায়। আর প্রতি গেমে ৩৫-৪০ টাকা। স্থানীয়রা বলেছেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ফ্রি ফায়ার গেমেসের প্রতি আসক্তি জন্মেছে। এজন্য তারা যত্রতত্র গড়ে ওঠা ভিডিও গেমসের দোকানকে দায়ী করছেন। সরেজমিনে পল্লবীর ১১ নম্বর বাউনিয়াবাঁধ ঘুরে দেখা যায়, সুরভী স্কুল, আইডিয়াল হাইস্কুল ঘিরে এ-ব্লক, ই-ব্লক ও ডি-ব্লকে ৫০টির মতো ফ্রি ফায়ার গেমস খেলার দোকান গড়ে উঠেছে। প্রত্যেক দোকানে ২৫-৩০টি মোবাইল রয়েছে। ফ্রি ফায়ার খেলার জন্য এসব মোবাইল ঘণ্টা অথবা প্রতি গেম হিসাবে ভাড়া দেয়া হয়। অনেক শিক্ষার্থী খেলার টাকা জোগাড় করতে না পেরে বাসা থেকে টাকা চুরি করে। টিফিন কিংবা জামা-কাপড় কেনার কথা বলে এ টাকা দিয়ে ফ্রি ফায়ার গেমস খেলে। এজন্য মাঝেমধ্যে ভুক্তভোগী পরিবার ও ভিডিও গেমস দোকান মালিকরা বাকবিতন্ডায় জড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে। গত ২ দিন আগে বাউনিয়াবাঁধ এলাকার ভিডিও গেমসের সবচেয়ে বড় দোকান মালিক জুলহাসের সঙ্গে এক ভুক্তভোগী পরিবারের বচসা হয়।
একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা জাহিদ বলেন, আমার সন্তান ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। স্কুল বন্ধ থাকায় এলাকায় গড়ে উঠে ফ্রি ফায়ার গেমসের দোকান। সেখানে সারাক্ষণ টাকা দিয়ে গেমস খেলে। বাসার আলমারি থেকে টাকা নিয়ে গেমসের দোকানে যায়। দোকানদারকে নিষেধ করলে বলে আমি কি আপনার সন্তানকে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসছি। চারদিকে গেমসের দোকানের ছড়াছড়ি। ছেলেকে কোনভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না। দোকানগুলো বন্ধ থাকলে আমরা অভিভাবকরা উপকৃত হতাম। প্রয়োজনে আপনারা রাতে এসে দেখতে পারেন কিভাবে বাচ্চারা গেমস খেলে সময় নষ্ট করছে। কামাল নামে স্থানীয় বাসিন্দা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফ্রি ফায়ার গেমস নিয়ে একটি মন্তব্য করেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘সাবাধান হয়ে যান যারা ফ্রি ফায়ার নিয়ে বিজনেস করছেন। ছোট ছোট বাচ্চাদের কাছে মোবাইল ভাড়া দিয়ে ফ্রি ফায়ার খেলা বন্ধ করুন। আদেশ ক্রমে বাউনিয়াবাঁধ যুব সমাজ।’
এ নিয়ে গত জুলাই মাসে ‘ডিজিটাল আসক্তি’ শিরোনামে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক জনকণ্ঠ। এরপর পাবজি-ফ্রি ফায়ার গেমসহ লাইকি, বিগোর মতো ভিডিও স্ট্রিমিং এ্যাপ বন্ধের দাবি উঠে বিভিন্ন মহলে। এর আগে গত ২৪ জুন মানবাধিকার সংগঠন ‘ল এ্যান্ড লাইফ ফাউন্ডেশনে’র পক্ষে একটি রিট দায়ের করা হয়। এরপর গত ১৬ আগস্ট পাবজি-ফ্রি ফায়ার গেমসহ লাইকি, বিগোর মতো ভিডিও স্ট্রিমিং এ্যাপ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন উচ্চ আদালত। ওইদিন এক রিটের প্রাথমিক শুনানি নিয়ে বিচারপতি মোঃ মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি মোঃ কামরুল হোসেন মোল্লার সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ রুল জারি করেন। রুলে দেশের অনলাইন প্ল্যাটফর্ম থেকে পাবজি, ফ্রি ফায়ার, লাইকি, বিগো লাইভের মতো গেম ও এ্যাপের সব ধরনের লিঙ্ক বা ইন্টারনেট গেটওয়ে নিষিদ্ধ বা অপসারণ বা ব্লক করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়। আদালত অনলাইন গেম-এ্যাপ নিয়মিত তদারকি এবং এ বিষয়ে নির্দেশিকা (গাইডলাইন) তৈরি করতে বিশেষজ্ঞ ও কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন একটি কমিটি গঠন করতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না, সে বিষয়েও রুল দিয়েছেন। ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব, বিটিআরসির চেয়ারম্যান, শিক্ষাসচিব, স্বরাষ্ট্রসচিব, আইনসচিব, স্বাস্থ্যসচিব, পুলিশের মহাপরিদর্শক, বাংলাদেশ ব্যাংকসহ বিবাদীদের ২৬ আগস্টের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
তবে উদ্বিগ্ন অভিভাবকরা সব গেম নয়, ক্ষতিকর গেম ও এ্যাপ বন্ধের পক্ষে। তারা উচ্চ আদালতের নির্দেশের পর স্বস্তির কথা জানিয়েছেন। রাজধানীর মিরপুর ১৩ নম্বরের বাসিন্দা নাসরিন বেগম জনকণ্ঠকে বলেন, ‘তিন মাসের জন্য নয়, আদালত যেন পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে এসব ক্ষতিকর গেম স্থায়ীভাবে বন্ধ করে দেন।’ ‘ক্ষতিকারক’ গেম ও এ্যাপ বন্ধ করা সম্ভব কি না, জানতে চাইলে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির জনকণ্ঠকে বলেন, ‘গেম প্রযুক্তিগতভাবে একটা পর্যায় পর্যন্ত বন্ধ করা যায়। প্রতিটি এ্যাপ্লিকেশন নির্দিষ্ট কিছু উৎস মেইনটেইন করে। এগুলো যদি চিহ্নিত করে ব্লক করা হয় তাহলে তা বন্ধ হয়ে যায়। ফেসবুক যেমন বন্ধ করা যায়, তেমনি এগুলোও বন্ধ করা যাবে।’ তিনি বলেন, ‘গেমের সঙ্গে অন্য এ্যাপ্লিকেশনের একটা পার্থক্য আছে। গেম খুব রিয়েল টাইম হতে হয়। গেমিং সার্ভার থেকে ব্যবহারকারীর দূরত্ব যত কম হবে, পারফরম্যান্স তত ভাল হবে। তখন ভিপিএন দিয়ে খেলা কঠিন।’ ভিডিও স্ট্রিমিং এ্যাপ বন্ধের বিষয়ে সুমন আহমেদ বলেন, ‘স্বাভাবিক ইন্টারনেটে এসব এ্যাপ চালানো বন্ধ করা যাবে। কেউ যদি ভিপিএন দিয়ে চালায়, তখন পুরোপুরি বন্ধ করা যায় না। তখন হয়তো ভিপিএন বন্ধের প্রসঙ্গ আসবে। এক ভিপিএন বন্ধ করলে অন্য ভিপিএন আসবে।’