
সদ্য স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে অসীম আবেগ
কলমের কালিতে মানপত্র, শরীরের রক্ত দিয়ে লেখা চিঠি

মোরসালিন মিজান ॥ বঙ্গবন্ধুকে ঘিরে বাঙালীর যে আবেগ উচ্ছ্বাস, সে তো সব সময়ই ছিল। তবে স্বাধীনতার পর পর মুক্ত ভূমিতে এ আবেগ উচ্ছ্বাস সর্বোচ্চ মাত্রায় প্রকাশিত হয়। এ সময় যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়ান তিনি। যেখানে গেছেন সেখানেই সদ্য স্বাধীন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানকে বিপুল আয়োজনে বরণ করে নেয়া হয়েছে। হাতে ফুল তুলে দেয়া হয়েছে। গলাভর্তি মালা। কাঁধে উত্তরীয়। তবে সম্মিলিত সকলের আবেগ অনুভূতি বিশেষভাবে প্রকাশিত হয়েছে মানপত্রে। প্রায় প্রত্যেক সমাবেশ থেকে মানপত্র উপহার পেয়েছেন বঙ্গবন্ধু। একই সময় ছিল চিঠির যুগ। নেতাকে সাধারণ মানুষও আবেগঘন চিঠি লিখেছেন।
এভাবে জমা হওয়া অসংখ্যা চিঠি ও মানপত্রের ৩৪টি এখন সংরক্ষিত হচ্ছে জাতীয় জাদুঘরে। ১৯৭২ সালে জাতির পিতা নিজে এগুলো জাদুঘরে প্রদান করেন। এরপর থেকে জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হচ্ছে স্মারকগুলো। জায়গার অভাব, তাই গ্যালারিতে প্রদর্শন করা হচ্ছে মাত্র তিনটি। বাকিগুলো স্টোর রুমে সংরক্ষণ করা হচ্ছে। মানপত্র ও চিঠিগুলো দেখতে অতি সাধারণ। তবে বঙ্গবন্ধুর জন্য কী পরিমাণ শ্রদ্ধা ও ভালবাসা জনগণের হৃদয়ে জমা ছিল তা এসবে চমৎকারভাবে ফুটে উঠেছে। শেখ মুজিবুর রহমানকে বর্ণনা করার পাশাপাশি এসবে তুলে ধরা হয়েছে বাঙালীর আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস। ব্যথা বেদনা আত্মত্যাগের স্মৃতি। প্রিয় নেতাকে কাছে পাওয়ার আকুলতা। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ১৯৭২ সালের ২৯ মার্চ প্রথম চট্টগ্রাম সফর করেন শেখ মুজিবুর রহমান। সেখানে তাঁকে নানা আয়োজনে বরণ করে নেয়ার পাশাপাশি একটি মানপত্র প্রদান করা হয়। এ মানপত্রে শেখ মুজিবকে বাঙালী জাতির ‘আত্মদর্শন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। নেতাকে উদ্দেশ করে লেখা হয়, ‘আপনি বাংলার পলিমাটিতে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের বীজ বপন করেছেন। বাংলার প্রবহমান নদীর ঘাটে ঘাটে আমরা সাড়ে সাত কোটি বাঙালী শ্যামল বর্ণে রক্তসূর্যকে মেহনতি মজবুত হাতে আকাশে তুলে ধরেছি।’ এ মানপত্রে শুধু বাংলাদেশের নেতা নয়, বিশ্বনেতা হিসেবে তুলে ধরা হয় বঙ্গবন্ধুকে। বলা হয়, ‘আপনি নিপীড়িত বিশ্বের মুক্তির অরুণোদয়।’ বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার কাজে সহায়তা করার অঙ্গীকার করে চট্টলার সংগ্রামী জনসগণ এতে লিখেন, ‘আপনার সোনার বাংলার প্রতি ঘরে আমরা সর্ব সংস্কার মুক্ত ভেদ মুক্ত এক মহান সমাজ গঠনের শপথ গ্রহণ করব। লোভ-লালসা পরিহার করে আমরা এ দেশের প্রতিটি সম্পদকে সকল মানুষের কল্যাণের জন্য নিয়োজিত করব।’ আরেকটি মানপত্র পাঠে জানা যায়, একই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি খুলনার পাইকগাছা পরিদর্শন করেন শেখ মুজিব। পাইকগাছা মহাবিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা তাঁকে কাছে পেয়ে যারপরনাই উৎফুল্ল হন। শিক্ষার্থীরা বঙ্গবন্ধুকে ‘বাঙালীর মুক্তি সেনানী’ সম্বোধন করে লিখেন, ‘সকালের নক্ষত্রটি যেমন আপনার অনাড়ম্বর কিরণধারা ঢেলে সমগ্র আকাশে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে তুমিও তেমনি স্বাধীনতার অতন্দ্রপ্রহরী রূপে সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীকরূপে, নিজের জীবন বিপন্ন করে স্বেচ্ছায় স্বচ্ছন্দচিত্তে বিরাট দায়িত্বভার স্কন্দে নিয়ে, স্থির লক্ষ্যের পানে শত ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যে ছুটে সহস্র অত্যাচার-অনাচারের বিরুদ্ধে লড়ে বাংলার ভাগ্যাকাশে উজ্জ্বল জ্যোতিষ্কর ন্যায় আবির্ভূত হয়ে বিশ্ববাসীকে একেবারে বিস্মিত করে দিয়েছ।’
যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশের চিত্রও ফুটে ওঠে মানপত্রে। শিক্ষার্থীরা লিখেন, ‘হে জয় বাংলার স্বপ্নদ্রষ্টা, যুদ্ধ শেষ হয়েছে বটে কিন্তু নিপীড়িত নিষ্পেষিত সর্বহারা জনগণ আজ আর এক বৃহত্তর যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। সে যুদ্ধ দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, সে যুদ্ধ শোষণমুক্ত সমদর্শী সমাজ গঠনের দায়িত্বে, সে যুদ্ধ বিশ্ব দরবারে নিজেদের যোগ্য স্থান অধিকারের তাগিদে।’ এ মানপত্রে মহান এ নেতার অবদানের কথা তুলে ধরে বলা হয়, ‘মানবকল্যাণ পাথেয় করে যেসব মহাপুরুষ যুগে যুগে বিশ্বের দ্বারে দ্বারে ন্যায়, সত্য ও প্রেমের অমর স্বাক্ষর বহন করে জগৎবাসীর কাছে বরিত হয়েছে তুমিও তাদের অনুসারী।’
১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে আয়োজিত জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে মানপত্র প্রদান করেন বরিশালের হরিগোবিন্দ সংস্কৃত মহাবিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ। জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত এ মানপত্রটি তিনি লিখেন সংস্কৃত ভাষায়। লেখাটি এ রকম: ‘মৃত্যুঞ্জয় স্ত¡ং শমনস্য গ্রাসাৎ/ সমাগতো দিব্য দ্যুতিশ্চিারায়ু:...।’ বাংলা তরজমা করলে দাঁড়ায়, মৃত্যুকে করিয়া জয়- হে মোর অমর/মৃত্যুঞ্জয় তুমি আজ...। মহৎ কল্যাণ কার্য তোমাতে অর্পিত...সুসিদ্ধ করিয়া তোল আপন সাধনা।
মানপত্র ছাড়াও বঙ্গবন্ধুকে ব্যক্তিগতভাবে অনেকে লিখেছেন। কখনও পাকিস্তানি হায়েনাদের হাতে ধর্ষিতা মেয়ের অসহায় বাবা নেতাকে তার মেয়ের দুঃসহ জীবনের কথা লিখে জানিয়েছেন। কখনও লিখেছে একেবারে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরাও। তেমনি একজন ঢাকা সিদ্ধেশ্বরী উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণীর ছাত্রী সুরাইয়া বেগম। ৫৩তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুকে শুভেচ্ছা জানিয়ে পত্র লিখে সে। ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ লেখা পত্রটি এখনও ফ্রেমে বাঁধানো। এর শিরোনাম ‘একটি নাম একটি শপথ।’ এতে জাতির জনকের নামের প্রতিটি অক্ষর ভেঙ্গে নতুন নতুন অর্থ করা হয়েছে। সব শেষে লেখাটি দাঁড়িয়েছে এ রকম- ‘মান রাখব এই বাংলার শপথ করি এসো সবাই মিলে।’ একই রকম আরেকটি লেখায় খিলগাঁও সরকারী উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র মোঃ আলী হাছান বখতিয়ার লিখেছে, ‘বন্ধু তুমি চির নিপীড়িত নির্যাতিত মানবের... ওহে মহান, ওহে মহামতি, কি দিয়ে করিব শ্রদ্ধাঞ্জলি?’
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাঙালীর পাশে দাঁড়িয়েছিল বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের সেনাবাহিনী। সেইসঙ্গে সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গের বাঙালীরা মুজিবকে গভীরভাবে ভালভাসতেন। একাধিক মানপত্রে সেই ভালবাসার প্রকাশ ঘটতে দেখা যায়। শুধু কলমের কালি বা ছাপার অক্ষরে নয়, নিজের শরীরের রক্ত দিয়ে একাধিক ব্যক্তি আবেগঘন চিঠি বা মানপত্র রচনা করেছেন। ভালবাসার কথা জানিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে। জনৈক নাগরিক নিজের শরীরে রক্ত দিয়ে দীর্ঘ পত্র রচনা করেছেন। বহু বছরের ব্যবধানে রক্ত শুকিয়ে বিবর্ণ হয়েছে। তবে লেখাগুলো বাঁচিয়ে রেখেছে অমূল্য সেই আবেগ।
এতে তিনি লিখেছেন, ‘দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে একটি শ্রেণী তথা একটি জাতি চেয়েছিল- একটা অবলা জাতির ওপর সামন্ততান্ত্রিক, সাম্প্রদায়িক, আমলাতান্ত্রিক, শোষণপূর্ণ রোলার চালিয়ে একটা জাতিকে শান্তিকামী দুনিয়ার বুক থেকে চিরতরে উচ্ছেদ ঘটাতে তারা চেয়েছিল দ্বিজাতি মনোভাব নিয়ে ধর্মের জিগির তুলে সরলপ্রাণ মানুষের মনের চাওয়াকে চিরতরে রুদ্ধ করে এক অর্থবিহীন মুসলিম রাষ্ট্র গঠন করতে- তারা চেয়েছিল দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য জিইয়ে রেখে আমলাতন্ত্রের কতগুলো মুখোশধারী শয়তানকে সবহারা মানুষের বুকের ওপর কুকুরের মতো লেলিয়ে দিয়ে তাদের দাবিকে চিরতরে রুদ্ধ করতে... কিন্তু তাদের সেই পরিকল্পনা শুধু পটে আঁকা ছবিই রয়ে গেল।’
এভাবে অদ্ভুত এক আবেগ অনুভূতির প্রকাশ ঘটে মানপত্রগুলোতে। ভিন্ন মাত্রায় প্রকাশিত হন বঙ্গবন্ধু। সেই সঙ্গে খুঁজে পাওয়া যায় বাঙালীর মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসটিও।
মানপত্র ও চিঠিগুলোর সংগ্রাহক ড. ফিরোজ মাহমুদ। বিশিষ্ট জাদুঘরবিদ ও জাদুঘরের তৎকালীন কর্মকর্তা সরাসরি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে এগুলো গ্রহণ করেন। সে স্মৃতি আজও তার কাছে অমলিন। কথা প্রসঙ্গে বলেন, ১৯৭২ সালের জুন মাসে আমাকে গণভবনে ডেকে পাঠান বঙ্গবন্ধু। মুক্তিযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্মারক তিনি আমার কাছে হস্তান্তর করেন। এ সময় খেয়াল করি, গণভবনের দেয়ালে টানানো রয়েছে বেশকিছু মানপত্র। এসবে কত যে আবেগ ভালবাসা মিশে আছে! সাহস করে এক সময় বঙ্গবন্ধুকে বলেই ফেললাম, ওগুলোও (মানপত্র) দিয়ে দিন। আবদার শুনে হেসে ফেলেন তিনি। কিছুক্ষণ সময় নিলেন। তার পর একজনকে ডেকে বলেন, দে ওকে সব নামিয়ে দিয়ে দে।
রক্ত দিয়ে লেখা মানপত্রটি দেয়ার ব্যাপারে কিছুটা দ্বিধায় পড়ে যান বঙ্গবন্ধু। বিশিষ্ট এ জাদুঘরবিদ তখন আবেদনের সুরে বলেন, ওটা দেবেন না? আবার হাসেন বঙ্গবন্ধু। স্বভাবসুলভ সরল ভঙ্গিতে বলেন, এইটাও নিয়ে যাবি? আমার থাকবে না একটাও? এর পর সেটিও নামিয়ে দেয়ার নির্দেশ দেন তিনি। ওই সময়, চিঠি ও মানপত্রের ভাষা বিশ্লেষণ করে ফিরোজ মাহমুদ বলেন, দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে। বঙ্গবন্ধু তখন পৃথিবীর খুব আলোচিত নেতাদের একজন। গোটা বিশ্বে তাঁকে নিয়ে আলোচনা। আর নিজের দেশের কথা তো বলাই বাহুল্য। ২৬ মার্চ পাকিস্তানীদের হাতে বন্দী হওয়ার পর ৯ মাস প্রিয় নেতাকে কেউ দেখেননি। অথচ তাঁর নামেই যুদ্ধ পরিচালনা করেন যোগ্য সতীর্থ তাজউদ্দীন। যুদ্ধে জয়ের পর আরও সফল আরও জনপ্রিয় নেতা হিসেবে দেশে ফেরেন বঙ্গবন্ধু। তাঁকে নিয়ে সাধারণ মানুষের এতদিনের সঞ্চিত আবেগ প্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি হয়। মানপত্র ও চিঠি সেই আবেগ ভালবাসার স্মারক।
জাদুঘরের কিপার নূরে নাসরিন বলেন, তৃণমূলের অতি সাধারণ মানুষ এগুলো লিখেছিলেন। সাহিত্য মূল্য অত হবে না হয়তো। কোনটিতে দু’একটা বানান ভুল। কোনটিতে দুর্বল বাক্য গঠন। দামী ফ্রেমে এগুলো বাঁধানো ছিল না। কালিও প্রায়শই শুকিয়ে গেছে। কিছু আবার প্রেসে ছাপানো। কিন্তু বিবর্ণ চেহারা। তবে নেতার প্রতি এসবে যে হৃদয়াবেগ ফুটে উঠেছে তা শুদ্ধ শুধু নয়, অতি পবিত্র। তাই বিশেষ যত্নে জাদুঘর এগুলো সংরক্ষণ করছে বলে জাানন তিনি।