রহিম শেখ ॥ অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক রেখে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেয়ার নতুন বিধান চালু করা হচ্ছে। এ লক্ষ্যে রফতানি পণ্যের কাঁচামাল, ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে রাখা আমানতের সনদপত্র, কার্যাদেশ বা ওয়ার্ক অর্ডার, সোনাদানার মতো ১০ ধরনের অস্থাবর সম্পত্তি ঋণের জামানতের জন্য বিবেচনা করা হবে। নতুন ও ছোট ব্যবসায়ীদের সহজে ঋণ পাওয়ার সুযোগ সৃষ্টির জন্য জামানত সুরক্ষা (অস্থাবর সম্পত্তি) আইন করতে যাচ্ছে সরকার। যেখানে অস্থাবর সম্পত্তি জামানত হিসেবে বিবেচনা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এই আইনের খসড়া তৈরি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ মতামত চেয়ে খসড়া আইন তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে। আইনের খসড়ায় বলা হয়েছে, প্রচলিত ঋণ ব্যবস্থায় অস্থাবর সম্পত্তিকে জামানত হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আরও বেশি মানুষের কাছে ঋণ সহজলভ্য করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
খসড়া আইনে বলা হয়েছে, রফতানি পণ্য তৈরির কাঁচামালের যথাযথ নথিপত্র থাকলে তা ঋণের জামানত হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানে থাকা আমানতের সনদপত্রও জামানত হিসেবে বিবেচিত হবে। স্বর্ণ, রৌপ্য ও অন্যান্য মূল্যবান ধাতু, যার ওজন ও বিশুদ্ধতার বিষয়ে স্বীকৃত কর্তৃপক্ষের সনদ আছে, তাও জামানত হিসেবে রাখা যাবে। নিবন্ধিত মানসম্পন্ন কোম্পানির শেয়ার সার্টিফিকেট, মেধাস্বত্ব অধিকার এবং কার্যাদেশ জামানত হিসেবে বিবেচনা করা যাবে। এছাড়া আসবাবপত্র, ফলদ ও ঔষধি গাছ, ইলেকট্রনিক পণ্য, সফটওয়্যার, এ্যাপস যার মূল্য হিসাব করা যায়, সেগুলো ঋণের জামানত হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। যান্ত্রিক বা অযান্ত্রিক যানবাহন ও খনিজসম্পদ জামানত হিসেবে গণ্য হবে। এছাড়া যথাযথভাবে সংরক্ষিত কৃষিজাত পণ্য, প্রক্রিয়াজাত মৎস্য বা জলজ প্রাণী এবং আয় উৎসারী জীবজন্তু জামানতের জন্য বিবেচিত হবে।
সাধারণত মেয়াদী ঋণ, চলতি মূলধন ইত্যাদি ঋণ নিতে গেলে ব্যাংক জামানত চায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে জমি ও ভবনই জামানত হিসেবে গণ্য করা হয়। এর পাশাপাশি কিছুক্ষেত্রে ব্যক্তিগত জামানত, সঞ্চয়পত্রের সনদ ও ডিপিএসের বিপরীতে ঋণ বিতরণ করে ব্যাংক। তবে সেগুলো ব্যবসায়িক ঋণের বেলায় প্রযোজ্য হয় না। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ী যে পরিমাণ ঋণ নিতে চান, তার চেয়ে বেশি মূল্যের স্থাবর সম্পত্তি জামানত হিসেবে ব্যাংককে দিতে হয়। ফলে ছোট উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা পর্যাপ্ত জামানতের অভাবে প্রয়োজনীয় ঋণও পান না। এ অবস্থার পরিবর্তনের জন্য স্থাবর সম্পত্তির পাশাপাশি অস্থাবর সম্পত্তিও ঋণের জামানত হিসেবে গণ্য করার জন্য আইন করা হচ্ছে।
জানা গেছে, অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধক আইন করার জন্য আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা দিচ্ছে বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফিন্যান্স কর্পোরেশন বা আইএফসি। আইনের খসড়া তৈরিতে সমন্বয়ের দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইনক্লুশন বিভাগ। এছাড়া অর্থ মন্ত্রণালয়, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি ও নীতি, এসএমই এ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস, ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও আইন বিভাগের মতামত নেয়া হয়েছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি বেসরকারী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জনকণ্ঠকে বলেন, কারখানার যন্ত্রপাতি, কম্পিউটার, চেয়ার-টেবিল, জমির ফসল ও আসবাবপত্র কোনভাবেই ব্যাংকের পক্ষে বন্ধক রেখে ঋণ দেয়া সম্ভব নয়। এর কোন স্থায়িত্ব নেই। এটা নষ্ট হলে ব্যাংক কার কাছে যাবে ঋণের টাকা তুলতে। এ আইন বাস্তবায়ন হলে ব্যাংকখাত বড় ধরনের সঙ্কটে পড়বে। কারণ জমি, ভবন বা ফ্ল্যাটের মতো স্থাবর সম্পত্তি জামানত রেখেও ব্যাংকগুলোকে অনেক ক্ষেত্রে বিপাকে পড়তে হয়। তাদের মতে, এ আইন বাস্তবায়ন একটি অবাস্তব চিন্তা। যা প্রভাবশালীদের লুটপাটের রাজত্ব কায়েমের একটি অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে পরিগণিত হবে।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, জমি, ভবন বা ফ্ল্যাটের মতো স্থাবর সম্পত্তি জামানত রেখে ঋণ দিয়েও বিপাকে পড়তে হচ্ছে ব্যাংককে। তারপর এ আইন করলে আরও বিপাকে পড়তে হবে। তাই অস্থাবর সম্পত্তি বন্ধকী আইন ব্যাংকের ক্ষেত্রে বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে। এমনকি এটা বাস্তবায়ন করলে ব্যাংকখাতে তেমন কোন পরিবর্তন আসবে বলেও মনে হয় না। ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, দু’একটি অস্থাবর সম্পত্তিকে ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে চিহ্নিত করে দেয়া যেতে পারে। যা ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে হতে পারে। যেমনÑ গাড়ি, প্লেন বা হেলিকপ্টার, বন্ড বা সঞ্চয়পত্র এবং গহনাকে নির্ধারণ করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে গহনাকে অবশ্যই ব্যাংকের ভল্টে গচ্ছিত রাখতে হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।