মোরসালিন মিজান ॥ শৈশবের সেই গল্পটা আগে মনে করিয়ে দেয়া যাক। স্কুল চলছে। ক্লাসভর্তি শিক্ষার্থী। হঠাৎ ভয়ঙ্কর এক খবর ফাঁস হয়ে গেল। আজ টিকা দেয়া হবে। টিচার্স রুমে অচেনা লোকজন মোটা সুচ ইত্যাদি নিয়ে বসে আছে। একটু পরই ক্লাসে এসে ঢুকবে। সে কি আতঙ্ক! ফিসফাঁস আর থামে না। এর মাঝেই কেউ বনে যান টারজান। কেউবা ম্যাকগাইভার। বুদ্ধি খাটিয়ে স্কুল থেকে পালানোর পথ বের করে ফেলেন তারা। অচিরেই ফাঁকা হয়ে যায় ক্লাসরুম! সুতরাং টিকা নিয়ে ভয়ভীতি নতুন কিছু নয়। করোনা ভ্যাকসিন আসার পরও একধরনের ভয়ভীতি লক্ষ্য করা গেছে। এর বাইরে ছিল অপপ্রচার। স্থূল চিন্তার রাজনীতি। তবে আশার কথা যে, সহসাই সব দূর হয়েছে। গত কয়েকদিনে টিকা গ্রহণের হার বাড়েনি শুধু, এ নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনাও দেখা যাচ্ছে।
বহু সংক্রমণ ও মৃত্যু শেষে গত রবিবার থেকে শুরু হয় গণটিকাদান কর্মসূচী। সারাদেশে ওইদিন টিকা নেন ৩১ হাজার ১৬০ জন। সোমবার সংখ্যাটি বেড়ে হয় ৪৬ হাজার ৫০৯। মঙ্গলবার ছিল সর্বোচ্চ। সংখ্যার হিসেবে একথা পরিষ্কার যে, টিকা নিয়ে আগের সে ভয় আর নেই। এখন পর্যন্ত বড় কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার খবর সামনে আসেনি। তাই যারা দায়িত্বজ্ঞানহীন প্রোপাগান্ডায় মেতেছিলেন তারাও এখন টিকা নেয়ায় ব্যস্ত।
মঙ্গলবার মোহাম্মদপুর ফারটিলিটি সেন্টারে গিয়ে মজার দৃশ্য চোখে পড়ল। টিকা গ্রহণে আগ্রহীরা প্রায় সবাই বিরাট প্রস্তুতি নিয়ে এসেছেন। যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন? তৎক্ষণাৎ কোন পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দেয় যদি? পাশে দাঁড়ানো এক বা একাধিক সঙ্গী নিয়ে এসেছেন তারা। কিন্তু হায়! দিনশেষে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা।
একব্যক্তির কথা তো উল্লেখ না করলেই নয়। নাম সদরুল আলম। এসেছিলেন লালমাটিয়া থেকে। সবে চেয়ারে বসেছেন তিনি। বাহু উন্মুক্ত করেছেন। ভেবেছিলেন আরও কিছুটা সময় বসে থাকতে হবে। না, সেটি হলো না। বরং মুহূর্তেই দেয়া হয়ে গেল টিকা। পাশ ফিরে থাকার দৃশ্যটি তিনি আর দেখতে পেলেন না। নার্স তাকে উঠতে বললে অবাক হয়ে থাকলেন টিকাগ্রহণকারী। জানতে চাইলেন, সত্যি টিকা দিয়েছেন আমাকে? কখন? টেরই তো পেলাম না! কী বলেন?
এমন প্রতিক্রিয়া শুনে সবাই একসঙ্গে হেসে ওঠলেন। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে হাসিতে যোগ দিলেন টিকাগ্রহণকারী নিজেও।
আরেকজন টিকাগ্রহণকারী গত প্রায় এক বছর যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়ে এসেছেন। দেশে এসে টিকা নেয়ার অভিজ্ঞতা জানিয়ে তিনি বলেন, মানুষ কেন যে এত আমেরিকা আমেরিকা করে। দেশে কত ভাল কিছু হয়ে যাচ্ছে। এই যে এত দ্রুত টিকা চলে এলো, এখানে এসে টিকা নিয়েও নিলাম। এটা বড় ব্যাপার না? কোন ধরনের বিড়ম্বনার মুখোমুখি হননি জানিয়ে তিনি বলেন, নার্স আমার সঙ্গে এটা ওটা নিয়ে কথা বলছিলেন। বলতে বলতেই সিরিঞ্জটা ঢুকিয়ে দিলেন। হ্যাঁ, টের পেয়েছি। তবে বিশেষ ব্যথা অনুভব করিনি। তার মতে কেন্দ্রটির সেবার মান বিস্ময়কর রকমের ভাল।
একইদিন টিকাদান অব্যাহত ছিল ঢাকা মেডিক্যালে। গত দুদিনের চেয়ে এখানে টিকা নিতে আসা মানুষের সংখ্যা ছিল বেশি। এসেছিলেন বয়স্করাও। অশীতিপর এক দম্পতিকে দেখা গেল টিকা নিতে। রামপুরা থেকে এসেছিলেন তারা। স্বামী প্রকৌশলী আব্দুল মতিনের বয়স ৮৯ বছর। স্ত্রী অধ্যাপক রওশন আরার বয়স ৮১ বছর। দুজনই টিকা নেন। ‘টিকা যে নিলাম, নেয়ার সময় আমি তো টেরই পেলাম না’, বলছিলেন স্ত্রী। ‘তুমি পাইছ?’ জানতে চাইছিলেন স্বামীর কাছে। আব্দুল মতিন ‘না’ সূচক মাথা নাড়াতে দুবার ভাবলেন না। অন্যদের উৎসাহিত করতে তিনি বললেন, টিকা খুব জরুরী। সবার নেয়া উচিত।
এ দম্পতিকে দেখিয়ে চিকিৎসক তাসমিনা পারভীন বলছিলেন, প্রথম দুইদিনের তুলনায় এখন ভীতি অনেক কমে গেছে। টিকা নেয়া শেষে অনেকে হাসিমুখে ছবি তুলে বাড়ি ফিরে যাচ্ছেন। কোন সমস্যা হচ্ছে না।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের উপ-পরিচালক আলাউদ্দিন আল-আজাদও একই তথ্য দিলেন। বললেন, এ পর্যন্ত যারা টিকা নিয়েছেন তারা সবাই ভাল আছেন।
সাধারণ মানুষের পাশাপাশি স্বনামধন্য ব্যক্তিরাও টিকাগ্রহণ করছেন। মঙ্গলবার হুইল চেয়ারে করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রে আসেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। টিকা নেয়ার পর তিনি যে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন তো যথারীতি মজার। ৮৬ বছর বয়সী প্রবীণের ভাষায়, ‘নো ফিলিং এ্যাট অল।’ চেনা হাসিটি ধরে রেখেই তিনি বলেন, কিছু তো টেরই পাইলাম না। আগে যেসব ইঞ্জেকশন নিতাম, সেগুলোতে যেমন যাতনা হতো, তাও হয়নি।’ সবার প্রতি আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, আমার জীবন শেষই হয়ে গেছে। আমি তবু টিকা নিয়েছি। আপনারাও সকলে ভ্যাকসিন নিন। এটা আপনার এবং আপনার পরিবারের জন্য প্রয়োজন।
আগেরদিন সোমবার কোভিড-১৯ এর টিকা নিয়েছেন সংসদ সদস্য ও খ্যাতিমান অভিনেত্রী সুবর্ণা মুস্তাফা। জাতীয় সংসদ ভবনের টিকা কেন্দ্রে ভ্যাকসিন নেন তিনি। টিকা নেয়ার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করে তিনি লিখেছেন, আমার ভ্যাকসিন নেয়া সম্পন্ন হলো। ভ্যাকসিন রক্ষাকবচ। সারা পৃথিবীর সবাই ভ্যাকসিন নিচ্ছে। সারাদেশের মানুষকে টিকা নেয়ার পরামর্শ দেন তিনিও।
সস্ত্রীক টিকা নিয়েছেন পরিচালক বিপুল রায়হানও। টিকাগ্রহণ শেষে দুজনই করোনা জয়ের আনন্দ প্রকাশ করতে ভি চিহ্ন দেখান। তাদের এ ছবি ফেসবুকে পোস্ট করেছেন কন্যা ভাষা রায়হান।
এভাবে সবাই ভি চিহ্নের আওতায় আসুক। আজকের দিনে সবার এই তো চাওয়া।