শংকর কুমার দে ॥ কাতারভিত্তিক টেলিভিশন আলজাজিরায় প্রচারিত ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ শিরোনামে বিতর্কিত প্রামাণ্যচিত্রের প্রতিবেদনটির নেপথ্যে কারা কাজ করেছে, তাদের অর্থের জোগানদাতা কারা? প্রচারিত প্রতিবেদনে প্রধান চরিত্র হিসেবে সামিউল আহমেদ খান ওরফে সামিকে উপস্থাপন করা হয়। ওই প্রতিবেদন প্রচারের পর সামিউলের নাম সামনে আসে। কিন্তু কে এই সামি? সামিউলসহ আলজাজিরার প্রতিবেদনের নেপথ্যের বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা।
প্রামাণ্যচিত্রের মতো করে প্রতিবেদনটি প্রচার করানোর নেপথ্যে যারা আছেন তাদের সবারই এক সময়ের পরিচয় তারা ‘হাওয়া ভবনের লোক’। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময়ে বনানীর হাওয়া ভবন খুলে দুই হাত ভরে দেশের সব সেক্টরের অর্থ লুটপাট ও দুর্নীতি করেছেন তারেক রহমান। মা বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তার বড় ছেলে তারেক রহমান হাওয়া ভবন খুলে লুটপাট ও দুর্নীতির সহযোগীরাই এখন বিদেশে পলাতক অবস্থায় থেকে প্রামাণ্য চিত্রের প্রতিবেদন তৈরি, প্রচার করানোর পেছনে কাজ করেছেন। মা বেগম খালেদা জিয়া ও বড় ছেলে তারেক রহমান দুই জনেই আদালত কর্তৃক সাজাপ্রাপ্ত আসামি। সরকারের অনুকম্পায় খালেদা জিয়া কারান্তরাল থেকে সাময়িকভাবে মুক্ত হলেও পুত্র তারেক রহমান সাজা মাথায় নিয়ে লন্ডনে পলাতক জীবন যাপন করে ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই রাষ্ট্রবিরোধী কর্মকাণ্ড, অপপ্রচার করে চলেছেন। যুদ্ধাপরাধী গোষ্ঠীর বংশবদের আর্থিক সহায়তায় লন্ডনে বসে তারেক রহমানের নির্দেশেই তার সহযোগীরা কাতারভিত্তিক টেলিভিশন আলজাজিরায় প্রচারিত প্রামাণ্য চিত্র আকারে প্রতিবেদনটি তৈরি ও প্রচার করানো হয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থার দাবি। গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে জানা গেছে, কাতার ভিত্তিক টেলিভিশন আলজাজিরায় ‘অল দ্য প্রাইম মিনিস্টারস মেন’ শিরোনামে বিতর্কিত প্রতিবেদন প্রচার করানোর পেছনে মুখ্য কুশীলবের ভূমিকায় ছিলেন সামিউল আলম ওরফে সামি। কিন্তু কে এই সামি? কি তার পরিচয়? অতীত কর্মকাণ্ড কি? এসব তথ্য বেরিয়ে এসেছে গোয়েন্দা সংস্থার তদন্তে। আলজাজিরায় প্রচারিত প্রতিবেদনটিতে সামিকে একজন হোটেল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়ানো হয়েছে। বুদাপেস্টে হোটেল ব্যবসা করেন তিনি। ‘কারী হাউজ’ নামে তার একটি হোটেল আছে বলে পরবর্তীতে জানা যায়। আলজাজিরায় সামি যেই পোষাকে প্রামাণ্য চিত্র প্রচার করিয়েছেন তার এক সপ্তাহের ব্যবধানে নেত্র নিউজ নামে এক সংবাদ মাধ্যমে সাক্ষাতকার দিয়েছেন। কিন্তু কে এই সামি?
সামির পরিচয় ॥ গোয়েন্দাদের তথ্য বিশ্নেষণে বেরিয়ে এসেছে, আলজাজিরা টেলিভিশনে সম্প্রতি প্রচারিত একটি প্রতিবেদনে অন্যতম প্রধান চরিত্র হিসেবে সামিউল আহমেদ খান ওরফে সামিকে উপস্থাপন করা হয়। ওই প্রতিবেদন প্রচারের পর সামিউলের নাম সামনে আসে। অনেক আগে থেকেই বিভিন্ন ধরনের অপকর্মে যুক্ত সামি। র্যাব কর্মকর্তা পরিচয়ে আর্থিক প্রতারণায় জড়িত থাকার ঘটনায় ২০০৬ সালে গ্রেফতারও হন তিনি। এ ছাড়া ২০২০ সালের মে মাসে র্যাবের একজন ডিএনডি ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্টে রমনা থানায় একটি মামলা করেন। ওই মামলার ১১ জন আসামির মধ্যে ৬ নম্বর আসামি সামি। অপকর্মের জন্য তিনি সেনানিবাসে নিষিদ্ধও হন। সামির প্রকৃত নাম সামিউল আহমেদ খান। তবে তথ্য গোপন করে সামিউল তার নামে যে পাসপোর্ট করেন, সেখানে তার নাম দেয়া হয় জুলকার সায়ের খান। এমনকি পাসপোর্টে বাবার নামও বদলে ফেলেন সামি। তার বাবার প্রকৃত নাম আবদুল বাসেত খান। তিনি অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল। তবে পাসপোর্টে বাবার নাম বদলে সামিউল রেখেছেন- ‘কর্নেল ওয়াসিত খান।’
সামি মূলত পাসপোর্টে কোন সেনা কর্মকর্তা তার র্যাঙ্কব্যাজ ব্যবহার করেন না। অনৈতিক সুবিধা নিতেই সামিউল তার পাসপোর্টে বাবার ভুয়া র্যাঙ্ক ব্যাজের পরিচয় দেন। অবসরপ্রাপ্ত লে. কর্নেল মোঃ আবদুল বাসেত খানের চার সন্তানের মধ্যে সামিউল আহমেদ খান সবার বড়। তার জন্ম ১৯৮৪ সালে। ১৪ বছর বয়সে সামিউল মাকে হারান। এর দুই বছর পর তার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন। মা হারানোর পর থেকেই ভুল পথে পা বাড়াতে থাকেন। অপকর্মের জন্য ক্যাডেট কলেজ থেকে বহিষ্কারও হন সামিউল। এরপর ভর্তি হন কুমিল্লার ইস্পাহানি স্কুলে। ছোটবেলা থেকে নানা অপকর্মে জড়ান সামিউল। ১৭ বছর বয়সে তার বিরুদ্ধে একটি ট্র্যাকসুট চুরির অভিযোগ ওঠে। ১৭ ইসিবিতে কর্মরত তৎকালীন মেজর ওয়াদুদের বিদেশ থেকে আনা ওই ট্র্যাকসুট চুরি করে ধরা পড়েন তিনি। এরপর ২০০০ সালের জুলাই মাসে টাইগার অফিসার্স থেকে হাতির দাঁত চুরির অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। সেটি চট্টগ্রামে নিউমার্কেটের অঙ্গনা জুয়েলার্সে বিক্রি করতে গিয়ে ধরা পড়েন সামি।
সামি বাবার চাকরির সুবাদে নিজেকে কখনও সেনাবাহিনীর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট, কখনও ক্যাপ্টেন হিসেবে পরিচয় দিতেন। এরপর ২০০১ সালের ২৮ ও ২৯ এপ্রিল ঢাকা সেনানিবাসে নিজেকে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পরিচয় দিয়ে প্রবেশ করেন তিনি। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বন্ধু উৎপলের কাছে নিজেকে সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে প্রমাণ করতে বেল্ট, বুট ও র্যাঙ্ক ও ইউনিফর্ম কেনেন সামিউল। উৎপলের বাসা থেকেই সেনাবাহিনীর ইউনিফর্ম পরে ট্যাক্সিক্যাব দিয়ে সেনানিবাসসহ ঢাকার একটি পত্রিকা অফিস, ধানমণ্ডির রাপা প্লাজা ও জাতীয় চিড়িয়াখানা ঘুরে জাহাঙ্গীর গেট হয়ে সিএমএইচে প্রবেশের সময় দুপুর ২টায় মিলিটারি পুলিশের (এমপি) হাতে ধরা পড়েন সামিউল। দুদিন পর বাবা অঙ্গীকারনামা দিয়ে তাকে ছাড়িয়ে আনেন। এ ধরনের গুরুতর অপরাধে জড়িত থাকায় ২০০২ সাল থেকেই সেনানিবাস ও সেনানিবাসের আওতাভুক্ত এলাকায় সামিউলকে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়। তার কার্যকলাপ সেনাবাহিনীর জন্য অনাকাক্সিক্ষত ও সংবেদনশীল হওয়ায় তার ব্যাপারে ওই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।
সামিউল ২০০৬ সালের ২০ জুলাই র্যাব কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে রাজধানীর ফার্মগেটের এ জে টেলিকমিউনিকেশন থেকে ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকার মোবাইল ফোন কিনে একটি ভুয়া চেক দেন।
একইভাবে প্রাইজ ক্লাব নামক একটি কম্পিউটার ফার্ম থেকে ল্যাপটপ কেনা নিয়েও প্রতারণা করেন। চেক ডিজঅনারের অভিযোগের ভিত্তিতে র্যাব-১ তাকে গ্রেফতার করে। এ ঘটনার পর অনিয়ন্ত্রিত ও উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাপনের জন্য সামিউলকে ত্যাজ্য করেন তার বাবা লে. কর্নেল (অব.) আবদুল বাসেত। ঠিক এর পরদিন কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসার পথে ২০০৬ সালের ২৩ জুলাই এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন বাসেত। ব্যক্তিগত জীবনেও প্রতারক ছিলেন সামিউল। প্রথম স্ত্রীর অনুমতি না নিয়েই সেনা কর্মকর্তা পরিচয়ে প্রতারণা করে দ্বিতীয় বিয়ে করেন। এ ছাড়া একটি রাষ্ট্রের দূতাবাস কর্মকর্তা পরিচয়ে ওই দেশে ভিসা দেয়ার কথা বলেও লাখ লাখ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ব্যবসায় যুক্ত করার কথা বলেও অনেকের কাছ থেকে অর্থ হাতান। শ্বশুরের টাকায় হাঙ্গেরিতে রেস্টুরেন্ট ব্যবসা করেন। এরপর বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়ান সামিউল।
সামিউল গুজব ছড়িয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে তরার অপচেষ্টার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। গত বছরের মে মাসে বিভিন্ন ভুয়া ফেসবুক এ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ, মহামারী করোনাভাইরাস সম্পর্কে গুজব, রাষ্ট্র ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করতে অপপ্রচার ও বিভ্রান্তি ছড়ানোর অভিযোগে ১১ জনের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মামলা করেন র্যাবের একজন কর্মকর্তা। ওই মামলার ৬ নম্বর আসামি ছিলেন সামিউল। মামলায় তার নাম লেখা ছিল- জুলকার নাইন সায়ের খান। মামলার এজাহারে আরও বলা হয়- অভিযুক্তরা জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি, অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপরাধ করেছেন। এছাড়া ‘আই এ্যাম বাংলাদেশী’ নামে একটি ফেসবুক পেইজট চালানোর অভিযোগে ১১ জনকে আসামি করে মামলা হয়। মামলার আসামিরা হলেন- সায়ের জুলকার নাইন, কার্টুনিস্ট আহমেদ কবির কিশোর, আশিক ইমরান, ফিলিপ শুমাখার, স্বপন ওয়াহিদ ও লেখক মুস্তাক আহমেদ, নেত্র নিউজের সাংবাদিক তাসনীম খলিল, সাহেদ আলম, ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীন, রাষ্ট্র চিন্তারকর্মী দিদারুল ইসলাম ভূঁইয়া ও মিনহাজ মান্নান। ডিজিটাল সিকিউরিটি এ্যাক্টে দায়ের ওই মামলার প্রতিবাদে কলাম লিখেছিলেন বিতর্কিত ডেভিড বার্গম্যান।
ঢাকা মহানগর পুলিশের রমনা বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, রমনা থানার মামলায় মাস খানেক এই মামলায় তিনজনকে আসামি করে চার্জশীট দিয়েছে পুলিশ। তারা হলেন আহমেদ কবির কিশোর, মুস্তাক আহমেদ ও দিদারুল ভূঁইয়া। সঠিক নাম-পরিচয় ও ঠিকানা সংগ্রহ করতে না পারায় জুলকার নাইনসহ ওই মামলার ৮ জনকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। চার্জশীটভুক্ত করা হয়েছে তিনজনকে। সামিউল ওরফে সামি তার নাম ব্যবহার না করায় এবং তার নাম পরিবর্তন জুলকার নাইন রাখায় প্রকৃত সামি চার্জশীট থেকে অব্যাহতি পেয়ে যায়। তবে এ মামলা পুনঃতদন্ত করে আবারও সাপ্লিমেন্টারি চার্জশীট দেয়ার জন্য আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।
গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা বলেন, বাংলাদেশকে টার্গেট করে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনী ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে আলজাজিরা ওই প্রতিবেদন প্রচার করেছে। যেই সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ যেভাবে উন্নয়ন ও অগ্রগতির ধারা বইছে সেই সময়ে আলজাজিরায় এ ধরনের প্রামাণ্যচিত্রের মতো একটি প্রতিবেদন প্রচার করা হলো কেন? বাংলাদেশের মাটিতে দেশী-বিদেশী অশুভ শক্তির পায়ের নিচে মাটি না থাকায় প্রতিহিংসার বশীভূত হয়ে বিদেশের মাটিতে বসে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আর যেই মুহূর্তে সেনা বাহিনীর প্রধান বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে ভ্রমণে আছেন, যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রধানের অভ্যর্থনা গ্রহণ করছেন, মতবিনিময় করে উন্নত সেনা বাহিনী তোলার চেষ্টায় আছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে কাতারভিত্তিক টেলিভিশন আলজাজিরায় সেনাবাহিনী প্রধানের বিরুদ্ধে অপপ্রচার করার অর্থই হচ্ছে সেনা বাহিনীকে ক্ষেপিয়ে তোলার অপচেষ্টা বৈ আর কিছুই নয় বলে গোয়েন্দা কর্মকর্তার দাবি।