ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২২ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

দেশে করোনার বিপজ্জনক মিউটেশন সক্রিয় নয়

প্রকাশিত: ২২:৪৬, ২২ জুলাই ২০২০

দেশে করোনার বিপজ্জনক মিউটেশন সক্রিয় নয়

ওয়াজেদ হীরা ॥ করোনা গবেষণায় আরও একধাপ এগিয়ে গেছে বাংলাদেশ। করোনা ভাইরাসের যে ধরনটি দাপটের সঙ্গে সংক্রমণ ঘটিয়ে চলেছে, তা শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছেন দেশের বিজ্ঞানীরা। জিন রহস্য উন্মোচন করে তারা বলছেন, একটি করোনাভাইরাসে ২৮টি প্রোটিন থাকে। বাহিরের আবরণকে স্পাইক প্রোটিন বলে। এর মধ্যে ‘ডি৬১৪জি’ মিউটেশন বাংলাদেশে সক্রিয় অর্থাৎ সংক্রমণের প্রধান কারণ। তবে আশার কথা হলো, করোনাভাইরাস মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ার জন্য দায়ী বিপজ্জনক মিউটেশনগুলো এখনও দেশে সক্রিয় হতে পারেনি। জানা গেছে, সর্বশেষ তথ্যে ২০ জুলাই পর্যন্ত দেশের বিজ্ঞানীরা ২২৬টি করোনা ভাইরাসের সম্পূর্ণ জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন করেছেন দেশের বিজ্ঞানীরা। এই ২২৬টি করোনাভাইরাসের পূর্ণাঙ্গ জিন রহস্য করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্সের উন্মুক্ত তথ্য-ভা-ার জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডাটা (জিসএআইডি) ও যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার ফর বায়োটেকনলিক্যাল ইনফরমেশনে (এনসিবিআই) প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৭৩টি করোনাভাইরাসের পূর্ণাঙ্গ জিনোম সিকোয়েন্স করেছে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) জিনোমিক রিসার্চ সেন্টারের একদল বিজ্ঞানী। বিসিএসআইআর ছাড়া আরও নয়টি সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান করোনাভাইরাসের জিন রহস্য উন্মোচনের গবেষণায় কাজ করছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াসেফ ওসমান বলেছেন, নির্দিষ্ট রোগের জন্য কার্যকর ভ্যাকসিন বা ওষুধ উদ্ভাবনের জন্য জিনোম সিকোয়েন্সিংকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনার জিন রহস্য বা জিন সিকোয়েন্স উন্মোচন হচ্ছে ভাইরাসটির পূর্ণাঙ্গ জীবন রহস্য বের করা। এতে করে করোনাভাইরাসের গতি, প্রকৃতি, আচরণগত বৈশিষ্ট্য জানা যাচ্ছে। জিনের ভেতরেই সব তথ্য লুকানো থাকে। জিন রহস্য বের করার মাধ্যমে কোন প্রাণী বা করোনাভাইরাসের রূপান্তরের (মিউটেশন) ধারা বোঝা যায়। এতে করে ভাইরাসটির গতি-প্রকৃতি বুঝে ভ্যাকসিন তৈরির কাজ সুগম হয়। বিসিএসআইআরের বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশে করোনাভাইরাস ইতোমধ্যে তার জিনোমিক পর্যায়ে ৫৯০টি ও এমাইনো এসিড পর্যায় ২৭৩টি পরিবর্তন ঘটিয়েছে। ‘ডি৬১৪জি’ নম্বর মিউটেশন সক্রিয় বাংলাদেশে। সম্প্রতি, বাংলাদেশ শিল্প ও বিজ্ঞান গবেষণা পরিষদের (বিসিএসআইআর) ডেজিগনেটেড রেফারেন্স ইনস্টিটিউট ফর কেমিক্যাল মেজারমেন্টস (ডিআরআইসিএম) ল্যাবে এর বিস্তারিত তুলে ধরেন জিনোমিক রিসার্চ ল্যাবের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ সেলিম খান। সে সময় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মোঃ আনোয়ার হোসেন এবং ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন এ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের পরিচালক এ কে এম শামসুজ্জামানসহ অন্যরাও উপস্থিত ছিলেন। জিনোমিক রিসার্চ সেন্টারের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ সেলিম খান জানান, যেসব দেশে করোনা মহামারী আকারে ছড়িয়েছে সেসব দেশে ভাইরাসটির জিনে ৩১০ নম্বর থেকে ৫১৮ নম্বর মিউটেশন ধারা মারাত্মকভাবে সক্রিয় ছিল, বাংলাদেশে এখনও এটি দেখা যায়নি। বিসিএসআইআরের বিজ্ঞানী জানান, দেশে সংক্রমিত হওয়া করোনাভাইরাসের ধরন দেখে বোঝা গেছে, ‘ডি৬১৪জি’ নম্বর মিউটেশন ধারা এখানে সক্রিয়। এটিই বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণ ঘটানোর প্রধান কারণ। জিন রহস্য উন্মোচন হওয়া করোনাভাইরাসের ৯৫ শতাংশের মধ্যে এটি সক্রিয় ছিল বলে বিজ্ঞানীরা দেখতে পেয়েছেন। বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসটির ধরন আলাদা বলে জানিয়েছেন জিনোমিক রিসার্চ সেন্টারের বিজ্ঞানীরা। জিন রহস্য উন্মোচন করে তারা বলছেন, করোনাভাইরাসটি বিভিন্ন পরিবেশে গিয়ে দ্রুত পরিবর্তন করে। ফলে ভ্যাকসিন তৈরির কাজটি দেরি হচ্ছে। যদি করোনাভাইরাসের শরীরের প্রোটিন ও নিওক্লিড লেভেলে এত রূপান্তর না হতো তবে আরও দ্রুত ভ্যাকসিন তৈরি করা যেত। জিনোমিক রিসার্চ সেন্টারের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ সেলিম খান জনকণ্ঠকে বলেন, করোনাভাইরাস হলো পজিটিভ সেন্স জঘঅ ভাইরাস, বাংলাদেশে সিকুয়েন্স হওয়া করোনাভাইরাসগুলোর জঘঅ ২৯৯০৩ বেইসেস লম্বা। এই ভাইরাসে সাধারণত ১৪টা স্টপ কোডন থাকে, ১৪টা কোডিং সিকুয়েন্স বা ওপেন রিডিং ফ্রেম থাকে। ওপেন রিডিং ফ্রেম ১ধন ট্রান্সলেট হয়ে ১৬টা নন-স্ট্রাকচারাল প্রোটিন তৈরি করে, এই ১৬টা নন- স্ট্রাকচারাল প্রোটিন সবাই মিলে একসঙ্গে পলিপ্রোটিন থাকা অবস্থায় ৭০৯৭ এমাইনো এসিড লম্বা থাকে। জঘঅ এর ৩’ প্রাইম এন্ডে এদের ৪টা স্ট্রাকচারাল প্রোটিন কোডিং সিকুয়েন্স থাকে যা স্পাইক প্রোটিন (১২৭৪ এমানো এসিড লম্বা), এনভেলপ প্রোটিন (৭৬ এমানো এসিড লম্বা), মেমব্রেন প্রোটিন (২২৩ এমানো এসিড লম্বা), ও নিউক্লিওক্যাপ্সিড প্রোটিন (৪২০ এমানো এসিড লম্বা) তৈরি করে। এই ছাড়াও আরও কিছু প্রোটিন থাকে। বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোঃ সেলিম খান আরও বলেন, করোনাভাইরাসে সর্বমোট ২৮টি প্রোটিন থাকতে পারে, এদের মধ্যে বাংলাদেশে ২২টি প্রোটিনের এমাইনো এসিডে মিউটেশন পাওয়া গেছে। এই ২৮টা প্রোটিনের মধ্যে একটা প্রোটিন হলো স্পাইক প্রোটিন। স্পাইক প্রোটিন ১২৭৪ এমানো এসিড লম্বা, এই এমাইনো এসিডগুলো কোডিং সিকুয়েন্স হলো জঘঅ এর ২১৫৬০ থেকে ২৫৩৮৬ পর্যন্ত মোট ৩৮২৬টা নিউক্লোটাইড বেইসেস। এই স্পাইক প্রোটিনের দুইটা সাব ইউনিট থাকে। আরও জানা গেছে, ৩টা স্পাইক প্রোটিন ভাইরাসের আউটার সারফেসে এমনভাবে একসঙ্গে থাকে যে দেখতে করোনা বা মুকুটের মতো লাগে, তাই এই ভাইরাসকে করোনাভাইরাস বলা হয়। সেলিম খান বলেন, বাংলাদেশে এই স্পাইক প্রোটিনে ৬০টা আলাদা পজিশনে নিউক্লিওটাইড পরিবর্তনের ফলে ৩৬টা এমাইনো এসিডে পরিবর্তন হয়। বাকি ২৪টা পজিশনে নিউক্লিওটাইড পরিবর্তন হওয়ার ফলে এমাইনো এসিডের কোন পরিবর্তন হয় নাই। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ৯৬ শতাংশ ক্ষেত্রেই জি৬১৪ ভ্যারিয়ান্টটির উপস্থিত থাকায় বলা যেতে পারে দেশে করোনাভাইরাস সংক্রমণের জন্য এই ভ্যারিয়ান্টটি মূলত দায়ী। পৃথিবীর অন্য দেশে রিসেপ্টর বাইন্ডিং ডোমেইনে ১১১টা পজিশনে এমাইনো এসিডের পরিবর্তন হলেও বাংলাদেশে মূলত স্পাইক প্রোটিনের জইউ শেষ প্রান্তে দুইটি এমাইনো এসিডের পরিবর্তন হয়েছে। দেশে করোনাভাইরাসের স্পাইক প্রোটিনে ৩৬টির মধ্যে ৯টি হলো ইউনিক মিউটেশন যা পৃথিবীর আর কোথাও হয় নাই, এই ৯টি হলো এস১৩, এইচ১৪, এল২৬, এফ১৪০-ডিলেটেড, ওয়াই১৪৪-ডিলেটেড, ওয়াই২১১, কিউ৫১৬, এস৫৯৪ ও এফ৬৬০। বিসিএসআইআরের বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাসে এক হাজার ২৭৪টি স্পাইক প্রোটিনের মধ্যে ২১২ থেকে ৫২৩ পর্যন্ত হলো গুরুত্বপূর্ণ স্পাইক প্রোটিন। এর মধ্যে আমরা কোন মিউটেশন পাইনি। ‘ডি৬১৪-জি’ করোনাভাইরাসের যে স্ট্রেনটি সিকোয়েন্সিংয়ে শনাক্ত হয়েছে, তা কিন্তু এর বাইরে পড়ছে। সেলিম খান বলেন, আমরা ২১২ থেকে ৫২৩ পর্যন্ত ৯টি মিউটেশন পেয়েছি ইউনিক। এই মিউটেশনগুলো পৃথিবীর অন্য কোথাও ঘটেনি। আমাদের নজর রাখতে হবে, আমরা আরও ইউনিক মিউটেশন পাই কি না। জানা গেছে, যেসব দেশে করোনা মহামারী আকারে ছড়িয়েছে সেসব দেশে করোনাভাইরাসের জিনে ৩৪৬ নম্বর থেকে ৫১২ নম্বর মিউটেশন মারাত্মকভাবে সক্রিয় ছিল, যা বাংলাদেশে এখনও দেখা যায়নি। এটা একটা স্বস্তির কথা। তবে করোনাভাইরাস যেহেতু দ্রুত রূপান্তর হয়, তাই বড় পরিসরে এর জিন রহস্য উন্মোচনের কাজটি অব্যাহত রাখা জরুরী। বিসিএসআইআরের বিজ্ঞানীরা সেটাই করছেন বলেও জানা গেছে। টিকা তৈরির ক্ষেত্রে এই গবেষণার গুরুত্ব তুলে ধরে ড. সেলিম খান বলেন, যখন কোন ওষুধ, টিকা তৈরি করা হবে তখন এসব মিউটেশন মাথায় রেখে করতে হবে। জিনোমিক রিসার্চ সেন্টারের গবেষক দলটি ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন এ্যান্ড রেফারেল সেন্টারের সহযোগিতায় সারাদেশ থেকে নমুনা ও রোগীদের মেডিক্যাল হিস্ট্রি সংগ্রহ করার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। গত ২৩ মে থেকে করোনাভাইরাসের জিন রহস্য বের করার কাজ শুরু করে গবেষক দলটি। এতে ৯ বিজ্ঞানী, ৫ ভাইরোলজিস্টসহ ২০ জন কাজ করছেন বলেও জানা গেছে। গবেষক দলটি গত ২৬ মার্চ প্রথমবারের মতো করোনাভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স উন্মোচন করে, যা আন্তর্জাতিক তথ্য-ভা-ার জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডাটাতে (জিসএআইডি) প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের মাঝে ইনফ্লুয়েঞ্জা, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া রোগের পরিচিত ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিসিএসআইআর এর তথ্য অনুসারে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বসবাসরত বিভিন্ন বয়সীদের কাছ থেকে ১৩৩টি নমুনা সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন আবিষ্কারে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা। বাংলাদেশসহ এই অঞ্চলে করোনার প্রতিষেধক উদ্ভাবনে জিনোম সিকোয়েন্সির বিষয়টি তারা বিবেচনা করবে বলেও জানা গেছে। বিসিএসআইআর এর তথ্যমতে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিভিন্ন বয়সী মানুষের কাছ থেকে ১৩৩টি নমুনা সংগ্রহ করা হয়েছিল। আন্তর্জাতিক জিন ব্যাংকের রিপোর্ট ২১ জুলাই সর্বশেষ তথ্য অনুসারে, এ পর্যন্ত ৬৮ হাজার ৬শ’ ৮৮টি জিনোম সিকোয়েন্সিং সম্পন্ন হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের ২২৬ এবং প্রতিবেশী দেশ ভারতের অবদান ১৫৮৬। ভাইরাস দ্রুত বংশবিস্তার করে, তাই এর জিনোম সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তিত হতে থাকে। জিনোম সিকোয়েন্স থেকে ভাইরাসের আদি উৎস সম্পর্কে জানা যায়। এক্ষেত্রে ভাইরাস যদি দ্রুত জেনেটিক উপাদান পরিবর্তন করে তাহলে ওষুধ কিংবা টিকা কার্যকর নাও হতে পারে। তাই কোভিড-১৯ এর বিরুদ্ধে স্থায়ী এবং কার্যকর ভ্যাকসিন তৈরি এখন মূল চ্যালেঞ্জ। ভবিষ্যতে কোন অঞ্চলে ভাইরাসের প্রতিষেধক কাজ না করলে জিনোম থেকে এর কারণ বোঝার একটা সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের।
×