
২২২ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা ॥ আহ্বায়ক সোলায়মান চৌধুরী, সদস্য সচিব মুজিবুর রহমান মঞ্জু
‘এবি পার্টি’ নামে জামায়াতের সংস্কারপন্থীদের নতুন দল গঠন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ‘জন আকাক্সক্ষা বাংলাদেশ’ নামে প্লাটফর্মে ঘর গোছানোর পর অবশেষে নতুন রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেছে জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্ব ও কর্মকা-ের বিরুদ্ধে সক্রিয় বিদ্রোহী ও সংস্কারপন্থীরা। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দল জামায়াতের বিদ্রোহী ও সংস্কারপন্থীদের সমন্বয়ে গড়া নতুন এ দলের নাম ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি)’।
শনিবার সকালে রাজধানীর বিজয়নগরে ‘সায়হাম স্কাই ভিউ’ টাওয়ারে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে নতুন দলের নাম ঘোষণা করেন বহিষ্কৃত জামায়াত নেতা ও ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জু। যার নেতৃত্বে গঠন করা হয়েছিল ‘জন আকাক্সক্ষা বাংলাদেশ’। মুজিবুর রহমান মঞ্জু নতুন দলের সদস্য সচিব। সংবাদ সম্মেলনে মেজর (অব) ডাঃ আবদুল ওহাব মিনার ও সুপ্রীমকোর্টের আইনজীবী তাজুল ইসলামসহ সাতজনকে যুগ্ম-আহ্বায়ক, নয়জনকে সহকারী সদস্য সচিবসহ ২২২ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটিও ঘোষণা করা হয়েছে। নতুন দলের আহ্বায়ক জামায়াত থেকে পদত্যাগ করা সাবেক সচিব এএফএম সোলায়মান চৌধুরী। সংবাদ সম্মেলনে মুজিবুর রহমান মঞ্জু নতুন দলের ঘোষণা দিয়ে বলেন, সমালোচকদের তির্যক ভ্রƒকুটি উপেক্ষা করে আমরা ঘোষণা করছি, আজ থেকে আমাদের দলের নাম ‘আমার বাংলাদেশ পার্টি’- এবি পার্টি। আমরা মনে করি, একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিজয় আমাদের জাতীয় ঐক্যের অন্যতম পাটাতন। এবি পার্টি সেই পাটাতনকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে বদ্ধপরিকর। ‘আমাদের দলের সঙ্গে জামায়াতের কোন সম্পর্ক নেই’ নতুন দলের নেতারা এমন ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, এটি একেবারেই স্বতন্ত্র একটি দল। জামায়াতের সঙ্গে রাজনৈতিক ও আদর্শিক কোন ধরনের সম্পর্ক নেই এবং ভবিষ্যতেও থাকবে না।
নতুন এ দলের বিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ঘটনা শুরু হয়েছিল গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের জরুরী সভায় সংস্কার ও একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে। সভায় একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়, দল বিলুপ্ত করে সমাজসেবার বিষয়েও নীতিগত সিদ্ধান্তও আসে সভায়। তবে বিষয়টি তখনও দলের মজলিশে শূরায় অনুমোদন পায়নি। দলটির নেতৃত্বের একটা অংশ এ ধরনের প্রস্তাবের পক্ষে অবস্থান নেন। এই অংশ একাত্তরের ভুল স্বীকার করে বর্তমান নামে দলকে সচল রাখতে অথবা নতুন নামে দল গঠন করতে চায়।
৯ বছর আগে অনেকটা একই রকম প্রস্তাব দিয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসি কার্যকর হওয়া জামায়াতের তখনকার সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। তিনি ২০১০ সালে গ্রেফতার হওয়ার কিছুদিন পর কারাগার থেকে দেয়া এক চিঠিতে প্রস্তাব করেছিলেন, যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আনা হয়েছে, তাদের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়ে সম্পূর্ণ নতুন দায়িত্বশীলদের হাতে জামায়াতকে যেন ছেড়ে দেয়া হয়। তবে মতিউর রহমান নিজামীর পরিবারসহ তখনকার জ্যেষ্ঠ নেতাদের বাধার কারণে সেটা আর এগোয়নি। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর জামায়াত ও শিবিরের একটি অংশ নতুন করে ওই প্রস্তাব সামনে আনে।
ঠিক এমন অবস্থায় গত বছরই ১৫ ফেব্রুয়ারি সংস্কার ও একাত্তরের ভূমিকার জন্য ক্ষমা চাওয়ায় নেতৃত্ব সাড়া না দেয়ার প্রতিবাদে দল থেকে পদত্যাগের ঘোষণা দেন লন্ডনে অবস্থানরত দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল প্রভাবশালী নেতা ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক।
যুক্তরাজ্য থেকে পাঠানো একটি চিঠিতে দলের আমির মকবুল আহমদের কাছে আব্দুর রাজ্জাক তার পদত্যাগপত্র পেশ করেন। দলটির এমন এক নেতার পদত্যাগে কিছুটা চাপের মধ্যে পড়েছিল শীর্ষ নেতৃত্ব। একটি অংশ তার পদত্যাগের পর নতুন করে সংগঠিত হয়ে চাপ তৈরি করে।
এমন অবস্থার মধ্যেই সংস্কারের দাবি তোলায় বহিষ্কার করা হয় ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি ও জামায়াতের ঢাকা মহানগর মজলিশে শূরার অন্যতম সদস্য মুজিবুর রহমান মঞ্জুকে। দুটি ঘটনার প্রভাব বুঝতে পেরে দলটির শীর্ষ নেতারা পরিস্থিতি সামাল দিতে সংস্কার ও ক্ষমা চাওয়ার বিষয়ে ‘কাজ হচ্ছে’ বলে প্রচার চালাতে থাকে। চলের মধ্যে অসন্তোষ সামাল দিতে একটি কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়েছিল।
কিন্তু এরই মধ্যে জামায়াতকে ‘স্বাধীনতাবিরোধী দল’ উল্লেখ করে দিনাজপুরের খানসামা উপজেলার ভেড়ভেড়ী ইউনিয়নের দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন মোঃ বখতিয়ার উদ্দিন। ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাকের পদত্যাগের খবরে ‘ভুল’ ভেঙ্গেছে বলে জানান তিনি। সেই ভুল শোধরাতেই জামায়াত থেকে পদত্যাগ করেন বখতিয়ার উদ্দিন।
জামায়াতের বর্তমান নেতৃত্ব ও কর্মকা-ের বিরুদ্ধে সক্রিয় বিদ্রোহী ও সংস্কারপন্থীরা ‘জন আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ’ নামে নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগ নিয়ে ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এমন ঘটনা জামায়াতের রাজনীতির ইতিহাসে কখনও দেখা যায়নি। গত বছরের ২৭ এপ্রিল যাত্রা শুরু হয়েছিল জন আকাক্সক্ষার বাংলাদেশ নামে নতুন এ রাজনৈতিক উদ্যোগের। এই উদ্যোগের মূলে আছেন জামায়াতের পদত্যাগী প্রভাবশালী সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক। রাজ্জাকের উদ্যোগকে সমর্থন দিচ্ছেন শিবিরের প্রতিষ্ঠাকালীন সেক্রেটারি ইংল্যান্ডে বসবাসকারী ড. আব্দুল বারী, ফরিদ আহমদ রেজাসহ কয়েকজন সাবেক প্রভাবশালী নেতা।
দেশে এই প্লাটফরমের মূল নেতৃত্ব দেন শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি জামায়াতের কেন্দ্রীয় মজলিশে শূরার সদস্য ও স্যাটেলাইট চ্যানেল দিগন্ত টেলিভিশনের উপ-নির্বাহী পরিচালক মুজিবুর রহমান মঞ্জু এবং জামায়াত ঘরানা আলোচিত আইনজীবী তাজুল ইসলাম। এরই মধ্যে এই উদ্যোগে জামায়াতের সর্বোচ্চ কেন্দ্রীয় পর্ষদ মজলিশে শূরা থেকে পদত্যাগ করে যুক্ত হয়েছেন সাবেক সচিব এএফএম সোলায়মান চৌধুরী। এছাড়াও ঢাকা মহানগরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কয়েকজন আলোচিত জামায়াত ও শিবিরের সাবেক নেতা যুক্ত হয়েছেন এই প্রক্রিয়ায়।
যুক্ত হন জামায়াতের চিকিৎসকদের সংগঠন এনডিএফের সাবেক সেক্রেটারি অধ্যাপক ডাঃ মেজর (অব) আব্দুল ওহাব মিনার, শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সভাপতি সাবেক কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জুবায়ের আহমদ, চট্টগ্রাম মহানগর শিবিরের সাবেক সভাপতি ও শিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় নেতা গোলাম ফারুক, সীতাকুন্ড উপজেলার সাবেক নির্বাচিত উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান মোস্তফা নূর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর ড. এনায়েত উল্লাহ পাটোয়ারী। কক্সবাজারের আলোচিত জামায়াত নেতা জাহাঙ্গীর কাসেম, এ্যাডভোকেট গোলাম ফারুক খান কায়সার, কক্সবাজার কলেজের সাবেক জিএস এনামুল হক শিকদার, কক্সবাজার কলেজের সাবেক ভিপি সৈয়দ করিম।
আরও যুক্ত হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাবেক সভাপতি রেজাউল করিম, শিবিরের সাবেক ঢাকা মহানগর সভাপতি সাজ্জাদ হোসেন, জামায়াতের ঢাকা মহানগরের সাবেক শূরা সদস্য ও তেজগাঁও থানা আমির সালাউদ্দিন আহমদ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের সাবেক সভাপতি ওবায়দুল্লাহ আল মামুন। আছেন জামায়াতের শ্রমিক উইং শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় ও জেলা উপজেলার বহু নেতা। বিএনপিসহ অন্যান্য দল থেকে থেকেও অনেকে যুক্ত হচ্ছেন এ উদ্যোগে। ইতোমধ্যেই যুক্ত হয়েছেন অনেক জেলা-উপজেলার বিএনপি ও তার অঙ্গ সংগঠনের বহু নেতা। উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করছেন বিএনপির বুদ্ধিজীবীরাও। আছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক প্রফেসর দিলারা চৌধুরীর মতো বিএনপিপন্থী বুদ্ধিজীবীও।
দলের আহ্বায়ক সোলায়মান চৌধুরী বলেন, ক্রান্তিলগ্নে দুর্নীতি ও লুটপাটের রাজনীতির পরিবর্তে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শামিল হয়ে শেষ সময়টুকু উৎসর্গ করতে চাই। আমাদের নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগের আহ্বান নিয়ে দেশের যে প্রান্তেই গিয়েছি মানুষের সমর্থন পেয়েছি। দলের আত্মপ্রকাশের এই শুভলগ্নে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান ও মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী সব শহীদ ও দেশপ্রেমিক নেতাদের গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি।
সদস্য সচিব মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার- এই তিন মূলনীতির ভিত্তিতে এবি পার্টির আত্মপ্রকাশ। অকার্যকর রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের জন্যই দরকার নতুন রাজনীতি। আমাদের লক্ষ্য কেবল গাল-সর্বস্ব স্লোগান নয়। রাষ্ট্রের পুনর্গঠন আমাদের অন্যতম এজেন্ডা। সাম্প্রতিক করোনা সঙ্কট আমাদের নতুন করে বুঝিয়ে দিয়েছে যে, কতটা ব্যর্থ এই সরকার রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে। কতটা প্রয়োজন আজ নতুন করে এই রাষ্ট্রকে গড়ার, যেটাকে আমরা বলছি মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণাপত্রের আলোকে দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র বিনির্মাণের লড়াই। আর সামনে আমাদের কথা ও কাজই প্রমাণ করবে আমরা কী চাই। আমরা মনে করি, একাত্তর সালের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও বিজয় আমাদের জাতীয় ঐক্যের অন্যতম পাটাতন। এবি পার্টি সেই পাটাতনকে সুদৃঢ় ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে বদ্ধ পরিকর।
এক প্রশ্নে মঞ্জু বলেন, আহ্বায়ক কমিটির দায়িত্ব হবে সব জেলায় কমিটি গঠন করা, দলের খসড়া গঠনতন্ত্র চূড়ান্ত করা এবং দ্রুততম সময়ে গণতান্ত্রিক ও গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় কনভেনশন করে দলের নেতৃত্ব নির্বাচন করা।
করোনাভাইরাসের মহামারী মোকাবেলায় ‘জনগণের পাশে থাকার’ অঙ্গীকার জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা আমাদের সীমিত সামর্থ্যে ২০ হাজার বিপদগ্রস্ত পরিবারকে খাদ্য সহায়তা দেয়ার কর্মসূচী শুরু করেছি। আপাতত আমাদের পরিকল্পনা হলো- এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ, মানব সেবাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে মনোনিবেশ করা এবং নীতিনির্ধারণী সুপারিশমালা প্রণয়ন। মহামারীর দুর্যোগ কেটে গেলে নতুন দলের কার্যক্রম শুরু হবে।