ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার বিষয়ক ভার্চুয়াল সম্মেলনে সমন্বিত দায়িত্বশীলতা ও অংশীদারিত্বমূলক মনোভাবের ওপর গুরুত্বারোপ

এক সঙ্গে লড়তে হবে ॥ করোনা মোকাবেলায় পাঁচ দফা প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর

প্রকাশিত: ১০:৪২, ২৪ এপ্রিল ২০২০

এক সঙ্গে লড়তে হবে ॥ করোনা মোকাবেলায় পাঁচ দফা প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা করোনাভাইরাসে সৃষ্ট সঙ্কটে সমন্বিত দায়িত্বশীলতা এবং অংশীদারিত্বমূলক মনোভাবের ওপর গুরুত্বারোপ করে ঐক্যবদ্ধ ও সমন্বিত উদ্যোগের মাধ্যমে করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলায় এক সঙ্গে লড়াই করার জন্য বিশ্ব সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট পাঁচ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করে তিনি বলেন, বৈশ্বিক ঐক্যের মাধ্যমে একসঙ্গে করোনা যুদ্ধ মোকাবেলায় হচ্ছে একমাত্র উপায়। সবাইকে এক সঙ্গে এই সঙ্কটের মোকাবেলা করতে হবে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিতে কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় আঞ্চলিক সহযোগিতা জোরদার বিষয়ক এক ভার্চুয়াল সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী এ আহ্বান জানান। ‘এনহ্যান্সিং রিজিওন্যাল কো-অপারেশন ইন সাউথ এশিয়া টু কমব্যাট কোভিড-১৯ রিলেটেড ইমপ্যাক্ট অন ইটস ইকোনমিকস’ শীর্ষক এ ভার্চুয়াল সম্মেলনের আয়োজন করে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ)। বিশ্ব সম্প্রদায়ের উদ্দেশে করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্ব সম্ভবতগত একশো বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় সঙ্কটের মুখোমুখি। সুতরাং সবাই এক সঙ্গে সঙ্কটের মোকাবেলা করা দরকার। প্রতিটি সমাজ থেকে সমন্বিত দায়িত্বশীলতা এবং অংশীদারিত্বমূলক মনোভাব প্রয়োজন। ‘বিচ্ছিন্নতার নীতি বাস্তবমুখী নয়’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্ব ইতোমধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে লড়াই করছে। এখন করোনাভাইরাস আমাদের অস্তিত্বকে চ্যালেঞ্জ করছে। বিশ্বায়নের বর্তমান পর্যায়ে একটি দেশকে পুরো বিশ্ব থেকে আলাদা রাখা সম্ভব নয় এবং এখানে বিচ্ছিন্নতার নীতি আর কাজ করবে না। তিনি বলেন, আমরা জানি না এই মহামারী কতদিন থাকবে। এটি ইতোমধ্যে অর্থনীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। অর্থনীতি, ব্যবসা ও সমাজের স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে; ভয় এবং ট্রমা কাটাতে জনগণকে সহযোগিতা করতে হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করতে হবে। গণভবন প্রান্ত থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বাংলাদেশের সরকারপ্রধান আন্তর্জাতিক ভার্চুয়াল এই সম্মেলনে অংশ নিয়ে আরও বরেন, বিশ্ব একটি সঙ্কটময় পরিস্থিতি অতিক্রম করছে। এই সঙ্কট মোকাবেলায় আমাদের যথাযথ পদক্ষেপসমূহ গ্রহণ করতে হবে। বিশ্বের বর্তমান সঙ্কটময় পরিস্থিতি মোকাবেলায় সুনির্দিষ্ট পাঁচটি বিষয়ে সবাইকে মনোযোগী হওয়ার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। প্রথমত সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর মধ্যে দারিদ্র এবং বৈষম্য দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। গেল এক দশকে আমরা আমাদের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অর্ধেক দারিদ্র্যসীমা থেকে বের করে এনেছিলাম। তাদের অনেকে এখন আবার পূর্বের অবস্থানে ফিরে যেতে পারে। সুতরাং বিশ্বকে মানবকল্যাণ, বৈষম্যদূরীকরণ, দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সহায়তা এবং কোভিড-১৯ এর পূর্বের অর্থনৈতিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিতে নতুন করে ভাবতে হবে। প্রধানমন্ত্রী তাঁর দ্বিতীয় দফা প্রস্তাবনায় বলেন, আমাদের প্রয়োজন জি-৭, জি-২০ এবং ওইসিডির মতো সংগঠনগুলো হতে দৃঢ় ও পরিকল্পিত বৈশ্বিক নেতৃত্ব। জাতিসংঘ নেতৃত্বাধীন বহুপাক্ষিক ব্যবস্থাকেও এগিয়ে আসা উচিত। আমি অধ্যাপক সোয়াবকে (বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরোমের প্রতিষ্ঠাতা) প্রশংসা করছি। কারন তিনি সংক্রামক রোগগুলোকে ২০২০ এর বৈশ্বিক ঝুঁকি সম্পর্কিত প্রতিবেদনে অন্যতম মুখ্য ঝুঁকি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। সুতরাং ফোরাম এবং জাতিসংঘের উচিত সরকার এবং বিশ্ব ব্যবসাকে এ বিষয়ে একত্রিত করা এবং নেতৃত্ব দেয়া। তৃতীয়ত, আমরা ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী ব্যবসা, কাজ এবং উৎপাদনে পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছি। কোভিড পরবর্তী সময়ে, নতুন নীতি, স্ট্যান্ডার্ড ও পদ্ধতি দেখব। ইতামধ্যে আমরা দেখছি সরবরাহ চেইনে থাকা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডকে যথাযথ দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিচ্ছে না। সুতরাং আমাদের এমন কৌশল ও বাস্তবমুখী সহায়তা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে যেন বাংলাদেশের মতো দেশগুলো টিকে থাকতে পারে। চতুর্থত, অভিবাসী কর্মীরা বেকারত্বসহ অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতি পার করছেন। এটি দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতিকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলছে। সুতরাং বোঝা ও দায়িত্ব শেয়ার করার মতো আমাদের এমন একটি অর্থপূর্ণ বৈশ্বিক কৌশল ও পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে এবং পঞ্চমত, এই মহামারীর সময়ে আমরা কার্যকরীভাবে বেশকিছু ডিজিটাল প্রযুক্তি ও যন্ত্রপাতির ব্যবহার করেছি। যেমন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সংক্রমণ চিহ্নিত করা। ভবিষ্যতের প্রস্তুতির জন্য আমরা বিভিন্ন সেক্টরে এই রকম উদ্ভাবনীমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারি। প্রধানমন্ত্রী সম্মেলনে তাঁর বক্তব্যে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকারের নেয়া বিভিন্ন পদক্ষেপ এবং বাংলাদেশের সঙ্কটের কথাও বিশ্ব নেতৃবৃন্দের সামনে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মহামারীর প্রাদুর্ভাবের কারনে উন্নয়নশীল দেশ হিসাবে বাংলাদেশ সরবরাহ ও চাহিদা দ্বিমুখী সঙ্কটের সম্মুখীন। এই সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। করোনা সৃষ্ট সঙ্কট মোকাবেলায় সরকার থেকে বিভিন্ন খাতে প্রায় ১১ দশমিক ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্যাকেজ ঘোষণার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই প্যাকেজগুলোর মূল সুবিধা ভোগ করবে উৎপাদন ও সেবা খাত, কৃষি ও সামাজিক সুরক্ষামূলক খাতসমূহ। এই সহায়তা প্যাকেজটি আমাদের জিডিপির শতকরা ৩ দশমিক ৩ ভাগের সমান। করোনা সঙ্কট দীর্ঘায়িত হলে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের পর্যাপ্ত খাদ্য মজুদ রয়েছে। তবে সঙ্কট প্রলম্বিত হলে দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশ হিসেবে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে বিবেচিত হবে। কৃষি উৎপাদন বাড়াতে প্রধানমন্ত্রী এ সময় শুধু কৃষি খাতে প্রায় সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার প্রণোদনা দেয়ার কথাও উল্লেখ করেন। সামজিক সুরক্ষায় সহায়তার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রায় ৫ কোটি লোককে সরাসরি নগদ অর্থ সহায়তা প্রদান করতে যাচ্ছি। ৬শ’ হাজার টন খাদ্যশস্য ইতোমধ্যে দেশের দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষদের সরবরাহের জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া ১ দশমিক ১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থীর বিষয়টিও সরকারের সার্বিক পরিকল্পনায় রয়েছে বলে সম্মেলনে জানান প্রধানমন্ত্রী।
×