ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ০১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১৭ ভাদ্র ১৪৩১

মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করছে রাজউক

নতুনরূপে সাজবে মতিঝিল ॥ আবাসিক কাম বাণিজ্যিক এলাকা হবে

প্রকাশিত: ১১:১১, ৮ জানুয়ারি ২০২০

নতুনরূপে সাজবে মতিঝিল ॥ আবাসিক কাম বাণিজ্যিক এলাকা হবে

মশিউর রহমান খান ॥ রাজধানীর বাণিজ্যিক প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলকে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে নতুন রূপে সাজাতে চায় সরকার। দিনের বেলায় কোলাহল আর রাতের বেলায় সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্রের এলাকা মতিঝিলকে সরগরম এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হবে। শুধু বাণিজ্যিক কর্মকা-ের পরিচিতির বাইরে আবাসিক পরিবেশ তৈরিতে এ উদ্যোগ নিয়েছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী মতিঝিল শুধু বাণিজ্যিক নয় আবাসিক কাম বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হবে। রাজউক এ জন্য মতিঝিল এলাকার মাস্টারপ্ল্যান সংশোধন করে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে পার্ক, খেলার মাঠ, পথচারী ও এলাকায় বসবাসকারীদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে বিশ্রামের জায়গা তৈরি, পাবলিক টয়লেট স্থাপন, ছায়াঘেরা সবুজায়ন তৈরি, বাণিজ্যিক কাজের জন্য তৈরি ভবনের অব্যবহৃত বা কম কাজে লাগছে এমন ভবনের একাংশকে আবাসিক কাম বাণিজ্যিক স্থাপনার অনুমতি প্রদান, ফাঁকা ও অবৈধ দখলে থাকা জমি পুনরুদ্ধার করা, নতুন ভবনের নক্সা প্রণয়নে যাবতীয় নাগরিক সুবিধার সংস্থান রাখা, মতিঝিল এলাকায় বিশেষ করে শিশুদের জন্য পার্ক তৈরির জন্য নির্দেশনা দিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। এরই অংশ হিসেবে মাস্টারপ্ল্যান বা এ্যাকশন এরিয়া প্ল্যান প্রণয়নের উদ্যোগ নিয়েছে রাজউক। ডিটেইলস এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) অন্তর্ভুক্ত করে এ জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে মাঠে নেমেছেন ড্যাপ কর্মকর্তারা। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে প্রতিদিনের নির্দিষ্ট সময়ের বাইরের মতিঝিলকে নীরব ও শুনশান এলাকা থেকে বের করে ২৪ ঘণ্টাই সচল রাখতে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে মাঠে নেমেছে রাজউক। উন্নত বিশ্বের ন্যায় আদর্শ আরবান এলাকা তৈরিতে এ পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পৃথিবীর কোন শহরের একাংশ নির্দিষ্ট সময় শেষে নীরব হয়ে যায় না, ২৪ ঘণ্টাই কোন না কোন অংশের কাজ চলমান থাকে তথা ঘূর্ণায়মান কর্মকা- সচল থাকে। বর্তমানে ঢাকার মতিঝিল বিশেষ করে ব্যাংক, বীমা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য সকাল ৯ টা থেকে রাত সর্বোচ্চ আটটা পর্যন্ত সরগরম থাকে। কিন্তু এরপর এসব এলাকায় শুনশান নীরবতার সৃষ্টি হয়। লোকজনও তেমন একটা চলাচল করেন না বিধায় এলাকাটিতে দিনের সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র দেখা যায়। মূলত মডার্ন আরবান এরিয়া হিসেবে বিশ্বের কোন নগরেই দৈনিক একটি সময় কোলাহলপূর্ণ আর একটি সময় নীরব থাকতে পারে না। অপরদিকে ওই এলাকায় স্থাপিত বিশাল অট্টালিকাগুলোকে শতভাগ কাজে লাগাতেও এ উদ্যোগ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। রাজউক সূত্র জানায়, ১৯৭৪ সালের ২৬ আগস্ট তৎকালীন ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) মতিঝিল ও দিলকুশা এলাকাকে শতভাগ বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহারের জন্য লে আউট প্রণয়ন করে। এরপর ৪৫ বছর পেরিয়ে গেলেও বর্তমান চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কোন মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করেনি সাবেক ডিআইটি ও বর্তমান রাজউক। বিগত ৪৫ বছরে এ এলাকায় বিশাল বিশাল অট্টালিকা তৈরি করা হয়েছে। গরমকালে এসব সুউচ্চ ভবনের কারণে এই এলাকায় নাগরিকদের ভয়াবহ উত্তাপ সহ্য করতে হয়। আশপাশে সবুজের কোন প্রকার সমারোহ না থাকায়, পার্ক প্রতিষ্ঠা না করায় গরমের মাত্রা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে সমস্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে। এছাড়া পুরনো লে-আউটে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জন্য নক্সা প্রণয়ন করায় বিশাল এ এলাকায় বসবাসকারী নাগরিকদের শিশু সন্তানদের খেলার জন্য কোন পার্ক পর্যন্ত তৈরির ব্যবস্থা করা হয়নি। এছাড়া বর্তমানে মতিঝিল দিলকুশা এলাকায় প্রতিদিন লাখ লাখ লোক বাণিজ্যিক কর্মকা- পরিচালনার জন্য নিয়মিত আসা যাওয়া করলেও দুপুরে একটু বিশ্রাম নিতে বা প্রচ- রোদে ছায়ায় বসার মতো কোন পার্ক বা স্থান নেই। ফলে বাধ্য হয়ে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে এই এলাকায় আগতদের। যা সুস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অপরদিকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ঘিরে আশপাশে বাসস্থান গড়ে উঠলেও শিশুদের খেলার কোন পার্ক নেই। ফলে শিশুদের স্বাভাবিকভাবে খেলাধুলা করার পরিবেশ না থাকায় স্বাভাবিক কৈশোর জীবনও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ থেকে এলাকাবাসী ও যাতায়াতকারীদের পরিত্রাণ দিতে নতুন করে মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে এ এলাকার প্রতিটি জমিকে সর্বোচ্চ কাজে লাগাতে উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত বছরের ১৫ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয়ের স্থায়ী কমিটিকে রাজউকের দেয়া এ কার্যক্রম সম্পর্কিত অগ্রগতিমূলক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭৪ সালের পর পরবর্তীতে রাজউকের ১০/২০০০ তম সভায় মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকার সম্প্রসারিত রিভাইজড লে-আউট প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মতিঝিল এলাকার ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন ঘটলেও মাস্টারপ্ল্যান হালনাগাদ করা হয়নি। তাই স্থায়ী কমিটির সুপারিশের প্রেক্ষিতে মতিঝিলের মাস্টারপ্ল্যান বা এ্যাকশন এরিয়া প্ল্যান প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এতে চিলড্রেন্স পার্ক ও যাবতীয় নাগরিক সুবিধাদি সন্নিবেশিত করা হবে বলে জানায়। এরই অংশ হিসেবে ড্যাপ সংশ্লিষ্টরা এরিয়া প্ল্যান করতে তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করার কাজও শুরু করেছে বলে চিঠিতে জানানো হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজউকের ডিটেইলস এরিয়া প্ল্যানের (ড্যাপ) প্রকল্প পরিচালক আশরাফুল ইসলাম বলেন, রাজধানীর মতিঝিল দিলকুশা এলাকাটিকে তৎকালীন ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) থাকাকালীন বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে লে আউট প্ল্যান করা হয়। পরবর্তীতে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তন হলেও কোন প্রকার মাস্টারপ্ল্যান করা হয়নি। তাই চাহিদার প্রেক্ষিতে সরকার উক্ত এলাকায় মাস্টারপ্ল্যান করতে ও একটি শিশুপার্কসহ নাগরিকদের সার্বিক সুবিধার সংস্থান রেখে কিভাবে এলাকাটিকে আবাসিক কাম বাণিজ্যিক এলাকায় রূপান্তর করা যায় সে লক্ষ্যে কাজ করছি। মন্ত্রণালয়ের নিদের্শেই আমরা নাগরিকদের বিশ্রামের স্থান, পার্ক স্থাপন করা ও বেদখলে থাকা নানা জমি টিহ্নিত করে তা উদ্ধারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মূলত বাণিজ্যিকের পাশাপাশি আবাসিক এলাকা তৈরি করে দিনরাত কিভাবে মতিঝিলকে কোলাহলপূর্ণ আদর্শ আরবান এরিয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায় সে বিষয়েই মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হচ্ছে। রাজউক সূত্র জানায়, বর্তমানে মতিঝিল দিলকুশা এলাকায় সরকারের কমপক্ষে ৫-৭ একর জমি অবৈধ দখলে রয়েছে। এসব জমি উদ্ধার করবে সরকার। এজন্য জমির পরিমাণ ও স্থান চিহ্নিত করতে কাজ করছে রাজউক। গত বছরের ১১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত গৃহায়ন ও গণপূর্ত স্থায়ী কমিটির বৈঠকের ১০ নং সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রাজধানীর মতিঝিল এলাকার মাস্টারপ্ল্যানে বাধ্যতামূলকভাবে শিশুদের জন্য চিলড্রেন্স পার্ক অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়। এর প্রেক্ষিতে ড্যাপ কর্মকর্তারা তা বাস্তবায়নে মাঠে নেমেছেন। রাজউক সূত্র জানায়, আদর্শ আরবান এলাকা হিসেবে এমনভাবে মতিঝিলকে গড়ে তোলা হবে যাতে অফিস সময়ের বাইরেও দিনরাত সরগরম থাকবে মতিঝিল এলাকা। অপরদিকে বিশাল বিশাল অট্টালিকায় আবাসিক স্থাপনা হিসেবে ব্যবহার করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হবে। আর পার্ক স্থাপন ও সবুজায়নের উক্ত এলাকার সুউচ্চ ভবনের মাধ্যমে গরমের সময়ে সৃষ্ট উত্তপ্ত পরিবেশ কিছুটা হলেও স্তিমিত হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, সরকার সময়ের চাহিদা অনুযায়ী আবাসিক বাণিজ্যিক সবুজায়নসহ সব ধরনের সংস্থান রেখেই রাজধানীকে শতভাগ আদর্শ নগর হিসেবে বসবাসের উপযোগী করতে কাজ করছে। কম স্থানে অধিক লোকের আবাসন নিশ্চিত করতে চায় সরকার। একটি আদর্শ আরবান এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে আমরা প্রায় ৪৫ বছর নতুন করে চাহিদা অনুযায়ী একটি বাস্তবসম্মত মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি। এ এলাকাটিকে শুধু দিনের বেলায় বাণিজ্যিক কর্মকা-ের পরিচিতির বাইরেও রাতের আবাসিক পরিবেশ তৈরি করতে চাই। নতুন পরিকল্পনা অনুযায়ী চাহিদা মতে মতিঝিল শুধু বাণিজ্যিক নয় আবাসিক কাম বাণিজ্যিক এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হবে। রাজউক এ জন্য মতিঝিল এলাকার মাস্টারপ্ল্যান সংশোধন করে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে পার্ক খেলার মাঠ, পথচারী ও এলাকায় বসবাসকারীদের জন্য নির্দিষ্ট স্থানে বিশ্রামের স্থান তৈরি, পাবলিক টয়লেট স্থাপন, ছায়াঘেরা সবুজায়ন তৈরি, বাণিজ্যিক কাজের জন্য তৈরি ভবনের অব্যবহৃত বা কম কাজে লাগছে এমন ভবনের একাংশকে আবাসিক কাম বাণিজ্যিক স্থাপনার অনুমতি প্রদান করার পরিকল্পনা রয়েছে। এছাড়া ফাঁকা ও অবৈধ দখলে থাকা জমি পুনরুদ্ধার করা, নতুন ভবনের নক্সা প্রণয়নে যাবতীয় নাগরিক সুবিধাদির সংস্থান রাখাসহ মতিঝিল এলাকায় বিশেষ করে শিশুদের জন্য একটি শিশুপার্ক তৈরি করা হবে। এ লক্ষ্যেই রাজউক কাজ শুরু করেছে।
×