ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৭ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রাহায়ণ ১৪৩১

’গ্রহজনিত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা’র সাধারণ প্রস্তাব জাতীয় সংসদে গৃহীত

প্রকাশিত: ১০:০৩, ১৩ নভেম্বর ২০১৯

’গ্রহজনিত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা’র সাধারণ প্রস্তাব জাতীয় সংসদে গৃহীত

সংসদ রিপোর্টার ॥ জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অস্তিত্বের সঙ্কট, উপর্যুপরি দুর্যোগের ভয়াবহ আঘাত, জীব-বৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি এবং সম্পদের অমিতাচারী ব্যবহারের প্রেক্ষাপটে আনীত ’গ্রহজনিত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা’র সাধারণ প্রস্তাব জাতীয় সংসদে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে। কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ (১) বিধি অনুসারে সরকারি দলের সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী এ সাধারণ প্রস্তাবটি উত্থাপন করলে আলোচনা শেষে কন্ঠভোটে তা সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। জলবায়ু নিয়ে বাংলাদেশের আন্দোলনকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যেতে বিশ্বের মধ্যে প্রথম ও একমাত্র বাংলাদেশের সংসদ যারা সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহজনিত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করলো। স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে বুধবার রাতে আনীত সাধারণ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নেন সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা বলেছেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি ও ক্ষতির শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু এই সঙ্কটের জন্য বাংলাদেশ দায়ী না হলেও এর শিকার হতে চলেছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের ১৯টি উপকূলীয় জেলা ডুবে যাবে। উন্নত দেশগুলো কার্বন নিঃসরণের ফলে আমাদের মতো দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন আজ হুমকির মুখে পড়েছে। তাই ক্ষতির শিকার হতে যাওয়া সব দেশকে একজোট হয়ে সঙ্কট সৃষ্টিকারী দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে, ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে। সারাবিশ্বের জন্য গৃহীত প্রস্তাবটি একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। উত্থাপিত সাধারণ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নেন আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা ও সাবেক মন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, বেগম মতিয়া চৌধৃুরী, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহাব উদ্দীন, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, সরকারি দলের মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম, কাজী নাবিল আহমেদ, নজরুল ইসলাম বাবু, ওয়াশিকা আয়শা খান, জাসদের শিরীন আখতার, বিএনপির হারুনুর রশীদ, বেগম রুমিন ফারজানা, বিরোধী দল জাতীয় পার্টির ডা. রুস্তম আলী ফরাজী ও মুজিবুল হক চুন্নু। আলোচনার পর স্পীকার প্রস্তাবটি ভোটে দিলে কন্ঠভোটে তা সর্বসম্মতক্রমে গৃহীত হয়। সাবের হোসেন চৌধুরীর প্রস্তাবটি ছিল- ’সংসদের অভিমত এই যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অস্তিত্বের সঙ্কট, উপর্যুপরী দুর্যোগের ভয়াবহ আঘাত এবং চরম ভাবাপন্ন আবহাওয়ার বৃদ্ধি, জীব-বৈচিত্র্যের অপূরণীয় ক্ষতি, খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার আশঙ্কা, ক্রমবর্ধমান পানি সঙ্কট, মহাসগরগুলোর ওপর অভাবনীয় চাপ এবং সম্পদের অমিতাচারী ব্যবহারের প্রেক্ষাপটে গ্রহজনিত জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হোক।’ আলোচনায় অংশ নিয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেন, প্রস্তাবটি গ্রহণের ফলে সারাবিশ্বে বাংলাদেশ সমাদৃত ও প্রশংসিত হবে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা বলেছেন, অতীতের যে কোন সময়ের তুলনায় এখন বিশ্বের উষ্ণতা বাড়ছে, সমুদ্রপিষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে ৬ষ্ঠ স্থানে আছে বাংলাদেশ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে বাংলাদেশের ১০টি উপকূলীয় জেলা একদিন ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সাবেক কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী প্রস্তাবটি সমর্থন করে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু ও পরিবেশ রক্ষায় গৃহীত পদক্ষেপ গ্রহণ করায় জাতিসংঘ থেকে চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ পুরস্কার অর্জন করেছেন। রামপাল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সবকিছু না জেনেশুনেই অনেকে বিদেশ থেকে টাকা এনে দোকান খুলে দেশের প্রতি দরদ দেখান, নানা কথা বলে বিভ্রান্তি ছড়ান। শেখ হাসিনা বিদেশী টাকার ওপর নির্ভর করেননি, জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় নিজস্ব ফান্ড করে কাজ করে যাচ্ছেন। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, বিশ্বের ২০ ভাগ লোক নিজেদের স্বার্থে কার্বণ নিঃসরণ করে, তাতে ৮০ ভাগ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এটা মানবতাবিরোধী কাজ, এটা মেনে নেয়া যায় না। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ হচ্ছে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। উপকূলীয় ১০টি জেলার মানুষ সবসময় আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটায়। জলবায়ু পরিবর্তনে দেশের উন্নয়নকে ব্যাপকভাবে বাধাগ্রস্ত করছে। উন্নত বিশ্বের কার্বণ নিঃসরণের কারণে উষ্ণতা বাড়ছে, বরফ গলে যাচ্ছে। পরিবেশ বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন, আগামী ৫০ বছরে দেশের উপকূলীয় ১০টি জেলা বিলীন হয়ে যাবে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়কমন্ত্রী মোহাম্মদ শাহাব উদ্দীন বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশও একটি ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। বিশ্বের ঝুঁকিপূর্ণ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ উঠানামা করে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের অর্জিত উন্নয়ন ব্যহত করছে এবং করবে। বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর ৩ কোটি ৯০ লাখ মানুষ সরাসরি ক্ষতির মধ্যে পড়বে। প্রস্তাবের পক্ষে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, মানুষের বসবাস উপযোগী সৌরজগতের একমাত্র গ্রহ পৃথিবী আজ বৈশ্বিক উষ্ণতা ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হুমকির কারণে বিপন্নপ্রায়। আমাদের প্রিয় এ গ্রহটি মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ ছাড়াও জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানাবিধ জটিলতায় নিপতিত। অতিব্যবহার ও অপব্যবহারে সমুদ্রসম্পদ শেষ হয়ে আসছে। সামনের সময়ে সারা বিশ্বের প্রায় ২৩টি উন্নত দেশের পার্লামেন্ট তাদের দেশে জলবায়ু জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছে। কিন্তু যেসব কারণে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিসহ নানাবিধ সঙ্কটের সৃষ্টি, বাংলাদেশ তার জন্য দায়ী না হলেও এর শিকার হতে চলেছে। তাই প্রস্তাবটি গৃহীত হলে সারাবিশ্বের জন্য একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, প্যারিস সম্মেলনে গৃহীত প্রতিশ্রুতিগুলো প্রস্তাবে অন্তর্ভূক্ত করা উচিত। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ যে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে এবং সঙ্কট মোকাবেলায় নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন সেগুলোও প্রস্তাবে থাকলে ভাল হতো। বিদ্যুত প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, কার্বণ নিঃসরণের ক্ষেত্রে ব্যালান্স সৃষ্টি করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে কাবিখার বরাদ্দ সোলার প্যানেল করা হচ্ছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে বায়ু দুষণ হবে না সেটা এসেসমেন্ট করেই করা হয়েছে। ব্রিক ফিল্ড থেকে যে পরিমাণ কার্বণ নিঃসরণ হচ্ছে, তা রামপাল বিদ্যুত কেন্দ্র থেকে কয়েকগুণ বেশি। সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম বলেন, আমরা বড় ধরণের বিপর্যয়ের দিকে যাচ্ছি। বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, বরফ গলে যাচ্ছে। বনভূমিগুলো পুড়ে যাচ্ছে। সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, নোনা পানি ঢুকে ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করছে। তাই যেসব রাষ্ট্র আমাদের মতো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তারা সবাই মিলে ঐক্যজোট করে কার্বণ নিঃসরণকারী দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারি, তবে এটি ফলপ্রসু হবে। জাসদের শিরীন আখতার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নতুন প্রজন্মের আজ আকুতি- আগামী পৃথিবীতে আমাদের নিঃশ্বাসের ব্যবস্থা করে দাও। একদিকে হিমালয়ের বরফ গলে যাচ্ছে, বন উজাড় হয়ে যাচ্ছে, প্রকৃতি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সুন্দরবন বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আমাদের রক্ষা করে যাচ্ছে। এই সুন্দরবনকে আমাদের রক্ষা করতে হবে। পৃথিবীকে রক্ষা করতে হলে, বাংলাদেশকে রক্ষা করতে হলে উপকূলে ব্যাপক বনায়ন করতে হবে, নদীগুলোকে রক্ষা করতে হবে। বিএনপির বেগম রুবিন ফারজানা বলেন, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে ঝুঁকি ও ক্ষতির শিকার হচ্ছে বাংলাদেশ। অথচ এ জন্য বাংলাদেশ মোটেও দায়ী নয়। প্রশ্ন হলো- বাংলাদেশ সঠিক পদক্ষেপ নিচ্ছে কি না। সবাইকে একজোট হয়ে সঙ্কট সৃষ্ট্কিারী দেশগুলোর ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। জাতীয় পার্টির ডা. রুস্তম আলী ফরাজী বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সারাবিশ্বে অক্সিজেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। উন্নত দেশগুলো কার্বন নিঃসরণের ফলে আমাদের মতো দেশের কোটি কোটি মানুষের জীবন আজ হুমকির মুখে পড়েছে। কার্বণ নিঃসরণ বন্ধ না হলে সারাবিশ্বই হবে বসবাসের অনুপযোগী। বিএনপির হারুনুর রশীদ বলেন, সারাবিশ্বে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য আমরা মানুষরাই দায়ী। আমাদের ১৭-১৮ কোটি দেশে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় কী পদক্ষেপ নিয়েছি, সেটাই বড় কথা। ঢাকা মহানগরীতে দ্ইু কোটি মানুষ বসবাস করছে, কিন্তু বর্জ্য নিষ্কাষণ ব্যবস্থাপনায় আমরা কী পদক্ষেপ নিয়েছি? উন্নত দেশগুলো কয়লা বর্জন করলেও আমরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুত কেন্দ্র করছি কেন?
×