শংকর কুমার দে ॥ বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য জঙ্গী হামলায় অর্থ সরবরাহ করেছে পাকিস্তান। গুলশান হলি আর্টিজান রেস্তরাঁয় জঙ্গী হামলার তদন্তে বের হয়ে এসেছে, এ ঘটনায় অর্থ সরবরাহ করেছে এক পাকিস্তানী নাগরিক। ওই পাকিস্তানী দুবাই থেকে হুন্ডির মাধ্যমে তিন দফায় অর্থ সরবরাহ করেছে জঙ্গীদের কাছে। জঙ্গীদের কাছে অর্থ সরবরাহ করেছে ঢাকার এক অমুসলিম হুন্ডি ব্যবসায়ী। হলি আর্টিজানে হামলার অভিযোগপত্রের বাইরে রয়ে গেছে হামলাকারী জঙ্গীদের অর্থ প্রেরণকারী দুবাই প্রবাসী পাকিস্তানী নাগরিক ও ঢাকার এক অমুসলিম হুন্ডি ব্যবসায়ীর নাম। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার তিন বছর পূর্তি হলেও জঙ্গীদের কাছে অর্থ প্রেরণকারী ও অর্থ গ্রহণকারীসহ অনেক কিছুই এখনও রহস্যাবৃতই রয়ে গেছে। এ খবর জানিয়েছে তদন্ত সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, হলি আর্টিজানে হামলার জন্য হামলাকারী জঙ্গীদের কাছে ৩০ লাখ টাকা পাঠায় এক পাকিস্তানী নাগরিক। দুবাই থেকে তিন দফায় হুন্ডির মাধ্যমে জঙ্গীদের কাছে পাঠানো টাকা ঢাকায় গ্রহণ করে এক অমুসলিম হুন্ডি ব্যবসায়ী। ঢাকার একজন অমুসলিম হুন্ডি ব্যবসায়ীর মাধ্যমে এ অর্থ পৌঁছে যায় জঙ্গীদের হাতে। হুন্ডির মাধ্যমে আসা টাকা গ্রহণ করে সাব্বির ওরফে চকোলেট নামে নতুন ধারার জামাআ’তুল মুজাহিদীন বাংলাদেশের (জেএমবি) এক জঙ্গী। এ ধরনের তথ্য জানিয়েছে গুলশান হামলা মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) এক কর্মকর্তা।
পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, পাকিস্তানী নাগরিকের পাঠানো অর্থ দিয়ে জঙ্গী হামলার জন্য অস্ত্র কেনা হয় ভারতের বিহার রাজ্যের একটি গোপন কারখানা থেকে। প্রতিটি একে-২২ মেশিনগান কিনতে জঙ্গীদের খরচ পড়ে ৯০ হাজার টাকা। ভারতের বিহার রাজ্যের পাটনায় টাকা পাঠানোর প্রমাণও মিলেছে তদন্তে। গুলশানে হামলাকারীদের অর্থের উৎস জানা গেছে তদন্তে। কারা কীভাবে কোন মাধ্যমে এসব টাকা পাঠিয়েছে এবং কারা গ্রহণ করেছে সেটাও জানা গেছে। কিন্তু অভিযোগপত্রে এসব উল্লেখ করা হয়নি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার দিন ১ জুলাই ছিল ২৫ রমজান। রোজার মধ্যেই গুলশানে হামলাকারীদের কাছে ৩ দফায় টাকা পাঠানো হয় মধ্যপ্রাচ্যের দুবাই থেকে। এর মধ্যে প্রথম দফায় পাঠানো হয় ৮ লাখ ৭০ হাজার টাকা, দ্বিতীয় দফায় ১০ লাখ ৮০ হাজার টাকা ও তৃতীয় দফায় ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। দুবাই থেকে ‘হ্যান্ড পেমেন্ট’ পদ্ধতি অনুসরণ করে এ অর্থ চলে আসে সরাসরি রাজধানীর এক হুন্ডি ব্যবসায়ীর কাছে। অমুসলিম ওই হুন্ডি ব্যবসায়ী ওই অর্থ গ্রহণ করে। তার কাছ থেকে এই টাকা বুঝে নেয় সাব্বির ওরফে চকোলেট।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, পাকিস্তানী নাগরিকের দুবাই থেকে ঢাকায় এক অমুসলিম হুন্ডি ব্যবসায়ীর কাছে অর্থ পাঠানোর বিষয়টি তদন্তে উঠে আসার পর ওই অমুসলিম ব্যবসায়ীর হদিস পাওয়া যায়নি। তদন্তের স্বার্থে প্রথম থেকেই ওই অমুসলিম ব্যবসায়ীর নাম প্রকাশ করেননি তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ। জঙ্গীদের টাকা গ্রহণকারী সাব্বিরকে গোয়েন্দা জালে আনা সম্ভব হলেও তার প্রকৃত নাম সাব্বির নাকি জঙ্গী সংগঠনের সাংগঠনিক নাম সেটাও জানা যায়নি। তবে এই সাব্বির নিজেকে নতুন ধারার জেএমবি সদস্য হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলার মাস্টারমাইন্ড তামিম চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ এই সাব্বির ওরফে চকলেট। এটা তার ছদ্মনাম হতে পারে। গোয়েন্দারা টাকা প্রেরণকারী ওই পাকিস্তানির নামও জানতে পেরেছেন। তবে তারও সেটা ছদ্মনাম কিনা নিশ্চিত হতে পারেননি। হলি আর্টিজানে হামলাকারীদের অর্থ প্রেরণকারী ও গ্রহণকারী উভয়েই গ্রেফতার এড়িয়ে বাইরে থাকায় প্রথম থেকেই তাদের নামের বিষয়ে গোপনীয়তা রক্ষা করে গেছেন তদন্তকারী কর্তৃপক্ষ।
তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গুলশান হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গী হামলায় জঙ্গীরা ৫টি নাইন এমএম পিস্তল, তিনটি একে-২২ মেশিনগান ব্যবহার করে। তাদের কাছে ছিল একে-২২ মেশিনগানের ৭টি ও ৯ এমএম পিস্তলের ৬টি ম্যাগাজিন। তারা চার শতাধিক রাউন্ড গুলি ব্যবহার করে। একে-২২ মেশিনগান ও নাইন এমএম পিস্তলের অধিকাংশই ভারতের বিহার রাজ্যের একটি গোপন কারখানায় তৈরি হয়। প্রতিটি একে-২২ মেশিনগান ক্রয়ে তাদের খরচ পড়ে ৯০ হাজার টাকা। অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহের জন্য হুন্ডির মাধ্যমে ভারতের বিহার রাজ্যের পাটনায় অর্থ প্রেরণের তথ্যও পেয়েছেন গোয়েন্দারা। বিষয়টি সংবেদনশীল হওয়ায় এ ব্যাপারে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করা হয়েছে। হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার অস্ত্র কেনার টাকা বাংলাদেশ থেকে পাটনায় পাঠানো হয়েছে, না পাকিস্তান কিংবা দুবাই থেকে সরাসরি পাটনায় পেমেন্ট করা হয়েছে বিষয়টি স্পষ্ট করেননি তদন্তকারীরা।
গোয়েন্দা সংস্থার একজন কর্মকর্তা বলেন, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠন হরকাতুল জিহাদ বাংলাদেশের (হুজি-বি) এক সাবেক নেতা বিপুল পরিমাণ অর্থ দুবাই থেকে বাংলাদেশে পাঠায়। হুজির পাঠানো অর্থের সঙ্গে গুলশান হামলার জন্য প্রেরিত অর্থের কোন যোগসাজশ আছে কিনা তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। পুরান ঢাকা থেকে গ্রেফতার হুজির ঢাকা মহানগরীর আমির মাওলানা নাজিম উদ্দিনের কাছে প্রতিমাসে দুবাই থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আসত। যা দিয়ে হুজিকে নতুনভাবে সংগঠিত করছিল নাজিম। তার কাছে আসা অর্থ পৌঁছে যেত গুলশান হামলার দুই মাস্টারমাইন্ড সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ও বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম চৌধুরীর কাছে। হলি আর্টিজানে জঙ্গী হামলার সময় দেশেই ছিল এই দুই মাস্টারমাইন্ড। এরা নতুন ধারার জেএমবি সদস্য। যারা নিজেদের মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক জঙ্গী সংগঠন আইএসের অনুসারী বলে পরিচয় দেন।