মিজানুর রহমান, সাতক্ষীরা ॥ সাতক্ষীরাবাসীর বহু প্রত্যাশার এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুত সাতক্ষীরা বাইপাস সড়ক যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়েছে। ১৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ১২ দশমিক ৩০ কিলোমিটার এই সড়কটির সংযোগ সাতক্ষীরা খুলনা সড়কের বিনেরপোতা থেকে এসে মিশেছে সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজের সামনে সাতক্ষীরা কালীগঞ্জ সড়কে। ব্যস্ততম এই সড়কের মেডিক্যাল কলেজের সামনে প্রধান সড়কে সংযোগ তৈরি করায় ভোমরা বন্দর থেকে আসা পণ্যবাহী ট্রাক ও এই সড়কে যাতায়াত করা প্রতিদিনের শত শত যাত্রীবাহী বাস এবং ট্রাকের ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে মেডিক্যাল কলেজ এলাকা ও এর ছাত্রছাত্রীরা। এই বাইপাস সড়কের মূল প্রকল্পের নাম ছিল ‘কন্সট্রাকসন অব সাতক্ষীরা টাউন বাইপাস উইথ এ লিঙ্ক টু ভোমরা ল্যান্ড পোর্ট।’ বাস্তবে এই প্রকল্পে বাকাল থেকে ভোমরা বন্দর পর্যন্ত এবং জিরো পয়েন্টে একটি কালভার্ট তৈরি করা হলেও বাইপাস সড়কের সঙ্গে ভোমরা লিঙ্ক রোডের কোন সংযোগ তৈরি হয়নি।
সাতক্ষীরা নাগরিক সমাজের অভিযোগ, একটি মহলের স্বার্থ রক্ষার জন্য বাকাল লিঙ্ক রোডের সঙ্গে সংযোগ না রেখেই জমি অধিগ্রহণ করে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য ব্যাহত করা হয়েছে। প্রকল্পের মূল নক্সা পরিবর্তন করা হয়েছে সাতক্ষীরাবাসীর এমন অভিযোগ অস্বীকার করে সড়ক ও জনপথ বিভাগের সাতক্ষীরার নির্বাহী প্রকৌশলী মঞ্জুরুল কবির সোমবার বিকেলে জনকণ্ঠকে বলেন, এমন অভিযোগের কোন বাস্তবতা নেই। তবে এই প্রকল্পের মধ্যে সংযোগ ছাড়াই কিভাবে ১২ কিলোমিটার দূরে জিরো পয়েন্টে কালভার্ট নির্মাণ করা হলো এমন প্রশ্নটি তিনি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, বিষয়টি এখন আলোচনা না করাই ভাল।
সাতক্ষীরা শহরের যানজট নিরসনে বাইপাস সড়ক নির্মাণের দাবি উঠতে থাকে ৯০-এর দশকের প্রথম দিকে। বৃহত্তর খুলনা উন্নয়ন সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি এবং বিভিন্ন সময়ে সাতক্ষীরার উন্নয়নে গঠিত বিভিন্ন নামের সংগঠন এই দাবি জানাতে থাকে। ১৯৯৬ সালে ভোমরা স্থলবন্দর চালু হওয়ার পর বাইপাস নির্মাণের এই দাবি আরও জোরালো হয়ে ওঠে। এর প্রেক্ষিতে ২০১০ সালের ২৩ জুলাই শ্যামনগরে এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাতক্ষীরায় বাইপাস সড়ক নির্মাণের ঘোষণা দেন। এর কিছু দিন পর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদ একনেকে ভোমরা স্থলবন্দর সড়ক হতে বিনেরপোতা পর্যন্ত ২২ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বাইপাস সড়কের জন্য ১১৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। কিন্তু পরবর্তীতে সেটি সংশোধন করা হয় এবং ১৭৬ কোটি টাকা ব্যয়ে সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজের সামনে থেকে লাবসা পলিটেনিক ইনস্টিটিউট সংলগ্ন সড়ক হয়ে বিনেরপোতা বিসিক শিল্প নগরী পর্যন্ত ১২ দশমিক ৩০ কিলোমিটার বাইপাস সড়ক নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। সাতক্ষীরা শহর বাইপাস সড়ক নির্মাণে ২০১৬ সালের আগস্ট মাসে একনেকের বৈঠকে ১৭৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা অনুমোদন দেয়ার পর ১৭ সালের ৩১ মার্চ সাতক্ষীরা-২ আসনের এমপি মীর মোস্তাক আহমেদ রবি’র উদ্বোধনের মাধ্যমে মূল সড়কের মাটির কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু করা হয়। সাতক্ষীরা সড়ক ও জনপদ (সওজ) বিভাগ থেকে ভোমরা স্থলবন্দর থেকে বিনেরপোতা পর্যন্ত ২২ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বাইপাস সড়কের জন্য ১১৬ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। প্রকল্পের বাইপাস সড়ক নির্মাণ শুরুর আগেই আলিপুর চেকপোস্ট থেকে ভোমরা স্থলবন্দর পর্যন্ত ১১কিলোমিটার দুই লেনের লিঙ্ক রোডের রাস্তা আগেই নির্মাণ করা হয়। বাকি ১২ দশমিক ৩০ কিলোমিটার রাস্তা তৈরি করতে ৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দ থাকলেও পরবর্তীতে এটি বৃদ্ধি পেয়ে ৯০ কোটিতে দাঁড়ায়। এই প্রকল্পে সড়কে মোট ৩৬ কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। বাইপাসের সঙ্গে সংযোগ না থাকলেও ভোমরা বন্দরের জিরো পয়েন্টে এই প্রকল্পেরই একটি কালভাট নির্মাণ করা হয়েছে। যেটি বাংলাদেশ ভারত আমদানি রফতানির সেতু হিসেবে কাজ করছে।
সড়ক ও জনপদ বিভাগের সূত্র জানায়, ২০১৫ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ে একটি সংশোধিত প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়। যেখানে ১২ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার দুই লেনের (২৪ ফুট চওড়া) সড়কের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ১৭৪ কোটি টাকা। কিন্তু একনেকে ১৭৬ কোটি ৬০ লাখ টাকা অনুমোদন দেয়া হয়। বাইপাসের জন্য পলাশপোল, কাশিমপুর, বাবুলিয়া, বাঁশঘাটা, লাবসা, মথুরাপুর, বিনেরপোতা এই আটটি মৌজার ৯২ দশমিক ৫৮ একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এই জমি অধিগ্রহণে ব্যয় করা হয় ৪৭ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। সড়কটি সাতক্ষীরা মেডিক্যাল কলেজের সামনে থেকে শুরু হয়ে সিটি কলেজের পেছন হয়ে কাশেমপুর গ্রাম দিয়ে পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট সংলগ্ন যশোর সড়কে গিয়ে মিশেছে। সেখান থেকে মুথরাপুর মোড় হয়ে খেজুরডাঙ্গি হয়ে বিনেরপোতা মেঘনা মোড়ে গিয়ে খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।
এদিকে সাতক্ষীরা সড়ক বিভাগের কর্মকর্তাদের স্বাক্ষরকৃত (০৮/০৬/২০১৬) তারিখে প্রকল্প প্রস্তাবনার নক্সার ওপরে শিরোনামে দেখা যায় ‘সাতক্ষীরা টাউন বাইপাস উইথ এ লিঙ্ক টু ভোমরা ল্যান্ড পোর্ট’ এবং কালো কালি দিয়ে সাতক্ষীরা-খুলনা মহাসড়কের বিনেরপোতা, সাতক্ষীরা-যশোর সড়কের লাবসা এবং আলিপুর চেকপোস্ট হয়ে ভোমরার দিকে কালো দাগ টানা হয়েছে। অথচ বাস্তবে মেডিক্যাল কলেজের সামনে সংযুক্ত হওয়া এই বাইপাস সড়কের সঙ্গে আলিপুর থেকে ভোমরা বন্দর পর্যন্ত সড়কের সঙ্গে সরাসরি কোন লিঙ্ক রাখা হয়নি।
এর পরও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত ও প্রতিশ্রুত সাতক্ষীরা বাইপাস সড়ক চালু হওয়ায় সাতক্ষীরাবাসীর কৃতজ্ঞতা ও প্রত্যাশা আরও বেড়েছে। সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতায় সাতক্ষীরার জন্য বাইপাস সড়ক একটি মাইলফলক বলে নাগরিক সমাজ মনে করেন। নাগরিক সমাজের প্রত্যাশা এই বাইপাস সড়কটি ঝুঁকিমুক্ত রাখতে মেডিক্যাল কলেজের সামনের সংযোগের আগে থেকে আলিপুর (বাকাল চেকপোস্ট) পর্যন্ত একটি লিঙ্ক রোড তৈরি করে ভোমরা বন্দরের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপন করলেই আমদানি-রফতানি কাজে ব্যবহৃত যানবাহনগুলো নির্বিঘেœ চলাচল করতে পারবে। বিপদ ও ঝুঁকিমুক্ত থাকতে পারবে মেডিক্যাল কলেজের শত শত শিক্ষার্থী এবং চিকিৎসাসেবা নিতে আসা সাতক্ষীরাবাসী।